বনলতা সেন
(জীবনানন্দ দাশ – বনলতা সেন)হাজার বছর ধরে আমি পথ
হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে,
সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের
অন্ধকারে মালয় সাগরে
অনেক ঘুরেছি আমি;
বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে
সেখানে ছিলাম আমি;
আরো দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে;
আমি ক্লান্ত প্রাণ এক,
চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,
আমারে দুদণ্ড শান্তি দিয়েছিলো
নাটোরের বনলতা সেন।
চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,
মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য;
অতিদূর সমুদ্রের ’পর
হাল ভেঙে যে নাবিক হারায়েছে দিশা
সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে
চোখে দেখে দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর,
তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে; বলেছে সে ,
‘এতোদিন কোথায় ছিলেন?’
পাখির নীড়ের মত চোখ
তুলে নাটোরের বনলতা সেন।
সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন
সন্ধ্যা আসে;
ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল;
পৃথিবীর সব রঙ নিভে গেলে
পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন
তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল;
সব পাখি ঘরে আসে —
সব নদী- ফুরায় এ-জীবনের সব লেনদেন;
থাকে শুধু অন্ধকার,
মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।
অদ্ভত আঁধার এক
অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ-পৃথিবীতে আজ,যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দ্যাখে তারা;
যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই –
প্রীতি নেই – করুণার আলোড়ন নেই
পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া।
যাদের গভীর আস্থা আছে আজো মানুষের প্রতি
এখনো যাদের কাছে স্বাভাবিক ব’লে মনে হয়
মহত্ সত্য বা রীতি, কিংবা শিল্প অথবা সাধনা
শকুন ও শেয়ালের খাদ্য আজ তাদের হৃদয়।
কুড়ি বছর পরে
আবার বছর কুড়ি পরে তার সাথে দেখা হয় যদি!আবার বছর কুড়ি পরে-
হয়তো ধানের ছড়ার পাশে
কার্তিকের মাসে-
তখন সন্ধ্যার কাক ঘরে ফেরে-তখন হলুদ নদী
নরম নরম হয় শর কাশ হোগলায়-মাঠের ভিতরে!
অথবা নাইকো ধান ক্ষেতে আর,
ব্যস্ততা নাইকো আর,
হাঁসের নীড়ের থেকে খড়
পাখির নীড়ের থেকে খড়
ছড়াতেছে; মনিয়ার ঘরে রাত,
শীত আর শিশিরের জল!
জীবন গিয়েছে চলে আমাদের
কুড়ি কুড়ি বছরের পার-
তখন হঠাৎ যদি মেঠো পথে পাই
আমি তোমারে আবার!
হয়তো এসেছে চাঁদ মাঝরাতে
একরাশ পাতার পিছনে
সরু সরু কালো কালো
ডালপালা মুখে নিয়ে তার,
শিরীষের অথবা জামের,
ঝাউয়ের-আমের;
কুড়ি বছরের পরে তখন তোমারে নাই মনে!
জীবন গিয়েছে চলে আমাদের
কুড়ি কুড়ি বছরের পার-
তখন আবার যদি দেখা হয় তোমার আমার!
তখন হয়তো মাঠে হামাগুড়ি দিয়ে পেঁচা নামে
বাবলার গলির অন্ধকারে
অশথের জানালার ফাঁকে
কোথায় লুকায় আপনাকে!
চোখের পাতার মতো নেমে চুপি চিলের ডানা থামে-
সোনালি সোনালি চিল-শিশির
শিকার করে নিয়ে গেছে তারে-
কুড়ি বছরের পরে সেই
কুয়াশায় পাই যদি হঠাৎ তোমারে!
একটি নক্ষত্র আসে
একটি নক্ষত্র আসে; তারপর একা পায়ে চ'লে
ঝাউয়ের কিনার ঘেঁষে হেমন্তের তারাভরা রাতে
সে আসবে মনে হয়; - আমার দুয়ার অন্ধকারে
কখন খুলেছে তার সপ্রতিভ হাতে!
হঠাৎ কখন সন্ধ্যা মেয়েটির হাতের আঘাতে
সকল সমুদ্র সূর্য সত্বর তাকে ঘুম পাড়িয়ে রাত্রি হতে পারে
সে এসে এগিয়ে দেয়;
শিয়রে আকাশ দূর দিকে
উজ্জ্বল ও নিরুজ্জ্বল নক্ষত্র গ্রহের আলোড়নে
অঘ্রানের রাত্রি হয়;
এ-রকম হিরন্ময় রাত্রি ইতিহাস ছাড়া আর কিছু রেখেছে কি মনে।
শেষ ট্রাম মুছে গেছে, শেষ শব্দ, কলকাতা এখন
জীবনের জগতের প্রকৃতির অন্তিম নিশীথ;
চারিদিকে ঘর বাড়ি পোড়ো-সাঁকো সমাধির ভিড়;
সে অনেক ক্লান্তি ক্ষয় অবিনশ্বর পথে ফিরে
যেন ঢের মহাসাগরের থেকে এসেছে নারীর
পুরোনো হৃদয় নব নিবিড় শরীরে।
হাজার বর্ষ আগে
সেই মেয়েটি এর থেকে নিকটতর হ’লো না :
কেবল সে দূরের থেকে আমার দিকে একবার তাকালো
আমি বুঝলাম
চকিত হয়ে মাথা নোয়ালো সে
কিন্তু তবুও তার তাকাবার প্রয়োজন – সপ্রতিভ হয়ে
সাত-দিন আট-দিন ন-দিন দশ-দিন
সপ্রতিভ হয়ে — সপ্রতিভ হয়ে
সমস্ত চোখ দিয়ে আমাকে নির্দিষ্ট করে
অপেক্ষা করে — অপেক্ষা ক’রে
সেই মেয়েটি এর চেয়ে নিকটতর হ’লো না
কারণ, আমাদের জীবন পাখিদের মতো নয়
যদি হ’ত
সেই মাঘের নীল আকাশে
(আমি তাকে নিয়ে) একবার ধবলাটের সমুদ্রের দিকে চলতাম
গাঙশালিখের মতো আমরা দু’টিতে
আমি কোন এক পাখির জীবনের জন্য অপেক্ষা করছি
তুমি কোন এক পাখির জীবনের জন্য অপেক্ষা করছো
হয়তো হাজার হাজার বছর পরে
মাঘের নীল আকাশে
সমুদ্রের দিকে যখন উড়ে যাবো
আমাদের মনে হবে
হাজার হাজার বছর আগে আমরা এমন উড়ে যেতে চেয়েছিলাম।
জনান্তিকে
তোমাকে দেখার মতো চোখ নেই- তবু,
গভীর বিস্ময়ে আমি টের পাই- তুমি
আজো এই পৃথিবীতে র'য়ে গেছি।
কোথাও সান্ত্বনা নেই পৃথিবীতে আজ;
বহুদিন থেকে শান্তি নেই।
নীড় নেই
পাখিরো মতন কোনো হৃদয়ের তর।
পাখি নেই।
মানুষের হৃদয়কে না জাগালে তাকে
ভোর, পাখি, অথবা বসন্তকাল ব’লে
আজ তার মানবকে কী ক’রে চানাতে পারে কেউ।
চারিদিকে অগণন মেশিন ও মেশিনের দেবতার কাছে
নিজেকে স্বাধীন ব’লে মনে ক’রে নিতে গিয়ে তবু
মানুষ এখনও বিশৃঙ্খল।
দিনের আলোর দিকে তাকালেয় দেখা যায় লোক
কেবলি আহত হ’য়ে মৃত হ’য়ে স্তব্ধ হয়;
এ ছাড়া নির্মল কোনো জননীতি নেই।
যে-মানুষ- যেই দেশে টিঁকে থাকে সে-ই
ব্যক্তি হয়- রাজ্য গড়ে- সাম্রাজ্যের মতো কোনো ভূমি
চায়। ব্যক্তির দাবিতে তাই সাম্রাজ্য ভেঙে গিয়ে
তারই পিপাসায়
গ’ড়ে ওঠে।
এ ছাড়া অমল কোনো রাজনীতি পেতে হ’লে তবে
উজ্জ্বল সময়স্রোতে চ’লে যেতে হয়।
সেই স্রোত আজো এই শতাব্দীর তরে নয়।
সকলের তরে নয়।
পঙ্গপালের মতো মানুষেরা চরে;
ঝ’রে পড়ে।
এই সব দিনমান মৃত্যু আশা আলো গুনে নিতে
ব্যাপ্ত হ’তে হয়।
নবপ্রস্থানের দিকে হৃদয় চলেছে।
চোখ না এড়ায়ে তবু অকস্মাৎ কখনো ভোরের জনান্তিকে
চোখে থেকে যায়
আরো-এক আভাঃ
আমাদের এই পৃথিবীর এই ধৃষ্ট শতাব্দীর
হৃদয়ের নয়- তবু হৃদয়ের নিজের জিনিস
হ’য়ে তুমি র’য়ে গেছ।
তোমার মাথাত চুলে কেবলই রাত্রের মতো চুল
তারকার অনটনে ব্যাপক বিপুল
রাতের মতন তার একটি নির্জন নক্ষত্রকে
ধ’রে আছে।
তোমার হৃদয়ে গায়ে আমাদের জনমানবিক
রাত্রি নেই। আমাদের প্রাণে এক তিল
বেশি রাত্রির মতো আমাদের মানব্জীবন
প্রাচারিত হ’য়ে গেছে ব’লে-
নারি,
সেই এক তিল কম।
আর্ত রাত্রি তুমি।
শুধু অন্তহীন ঢল, মানব-খচিত সাঁকো, শুধু অমানব নদীদের
অপর নারীর কন্ঠ তোমার নারীর দেহ ঘিরে;
অতএব তার সেই সপ্রতিভ অমেয় শরীরে
আমাদের আজকের পরিভাষা ছাড়া আরো নারী
আছে। আমাদের যুগের অতীত এক কাল
র’য়ে গেছে।
নিজের নুড়ির ’পরে সারাদিন নদী
সূর্যের- সুরের বীথি, তবু
নিমেষে উপল নেই- জলও কোন্ অতীতে মরেছে;
তবু নবীন নুড়ি- নতুন উজ্জ্বল জল নিয়ে আসে নদী;
জানি আমি জানি আদি নারী শরীরিণীকে স্মৃতির
(আজকে হেমন্ত ভোরে) সে কবের আঁধার অবধি;
সৃষ্টির ভীষণ অমা ক্ষমাহীনতায়
মানবের হৃদয়ের ভাঙা নীলিমায়
বকুলের বনে মনে অপার রক্তের ঢলে গ্লেশিয়ারে জলে
অসতী না হয় তবু স্মরণীয় অনন্ত উপলে
প্রিয়াকে পীড়ন ক’রে কোথায় নভের দিকে চলে।
স্বপ্ন
পাণ্ডুলিপি কাছে রেখে ধূসর দীপের কাছে আমি
নিস্তব্ধ ছিলাম ব’সে;
শিশির পড়িতেছিল ধীরে-ধীরে খ’সে;
নিমের শাখার থেকে একাকীতম কে পাখি নামি
উড়ে গেলো কুয়াশায়,- কুয়াশার থেকে দূর-কুয়াশায় আরো।
তাহারি পাখার হাওয়া প্রদীপ নিভায়ে গেলো বুঝি?
অন্ধকার হাতড়ায়ে ধীরে-ধীরে দেশলাই খুঁজি;
যখন জ্বলিবে আলো কার মুখ দেখা যাবে বলতে কি পারো?
কার মুখ?- আমলকী শাখার পিছনে
শিঙের মতন বাঁকা নীল চাঁদ একদিন দেখেছিলো, আহা,
সে-মুখ ধূসরতম আজ এই পৃথিবীর মনে।
তবু এই পৃথিবীর সব আলো একদিন নিভে গেলে পরে,
পৃথিবীর সব গল্প একদিন ফুরাবে যখন,
মানুষ র’বে না আর, র’বে শুধু মানুষের স্বপ্ন তখনঃ
সেই মুখ আর আমি র’বো সেই স্বপ্নের ভিতরে।