সাতই মার্চের ভাষণের তাৎপর্য।৭ই মার্চের ভাষণের গুরুত্ব সংক্ষেপে।৭ই মার্চের ভাষণের পটভূমি

৭ই মার্চের ভাষণের তাৎপর্য

ঐতিহাসিক মার্চ। আজ থেকে ৫৪ বছর আগে ১৯৭১ সালের এই তারিখে বাংলার মানুষ একটি ভাষণ শুনেছিল। যে মানুষটি ১৯৪৮ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত ইতিহাসের সমান্তরালে ধাপে ধাপে মহান জাগরণের ডাক দিতে নিজেকে প্রস্তুত করেছেন এবং সেই আহ্বানে সাড়া দিয়ে দেশবাসীকে প্রস্তুত করেছেন, ঝাঁপিয়ে পড়ার মহা জাগরনে সামিল হয়েছেন। বাঙালির স্বাধীনতা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সেরা সময়ে; তিনি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

 

স্বাধীনতার মহান স্থপতি, বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তৎকালীন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে অসীম সাহসিকতার সঙ্গে লাখো মুক্তিকামী জনতার উত্তেজিত জনসমাবেশে বলিষ্ঠ কণ্ঠে স্বাধীনতার ডাক দেন। ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী পার্ক) মানুষজন বাঙালি জাতির ইতিহাসে চিরস্মরণীয়।

 বঙ্গবন্ধুর সেই তেজোদীপ্ত উচ্চারণ-‘এবারের সংগ্রাম আমদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রামশুধু স্বাধীনতা যুদ্ধে নয়, সেই ভাষণ আজও বাঙালি জাতিকে উদ্দীপ্ত করে, অনুপ্রাণিত করে।

 

বঙ্গবন্ধুর মার্চের ভাষণ ছিল একটি স্ফুলিঙ্গ যা মুক্তিযুদ্ধের অগ্নিশিখা জ্বালিয়েছিল, যা পরাক্রমশালী পাকিস্তানি বাহিনী তাদের স্থানীয় মিত্ররা প্রতিরোধ করতে পারেনি। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত ১৮দিনে এই ভাষণ বাংলাদেশের সাত কোটি মানুষকে স্বাধীনতার সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে প্রস্তুত করেছিল।

 

জন রীডের লেখা বিশ্ববিখ্যাত 'Days that shake the world'-এর চেয়ে বাঙালির কাছে সেই ১৮ টি দিন কম গুরুত্বপূর্ণ ছিল না - যে দিনগুলিতে অক্টোবর বিপ্লবের মাধ্যমে মহামতি লেলিনের নেতৃত্বে রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।

 

২৬শে মার্চ ভোরবেলা বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসে।

বঙ্গবন্ধু বাংলার স্বপ্ন দেখেছিলেন। তাঁর চির লালিত স্বপ্ন ছিল বাঙালি জাতির জন্য একটি স্বাধীন ভূমি এবং ক্ষুধামুক্ত, অসাম্প্রদায়িক চেতনার সোনার বাংলা গড়ে তোলা।

 


তিনি একটি সুখী সমৃদ্ধ সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখেছিলেন, যেখানে তিনি দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি করবেন এবং যারা নৈতিকভাবে শক্তিশালী, সুশিক্ষিত নাগরিক হবেন। তিনি একটি সামাজিক পরিবর্তন আনতে চেয়েছিলেন। ১৯৭১ সালের এপ্রিলে নিউজউইক ম্যাগাজিন তাদের একটি কভার স্টোরিতে বঙ্গবন্ধুকে রাজনীতির কবি বলে অভিহিত করে।

বঙ্গবন্ধু আগেই রেসকোর্সে মার্চ ভাষণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। মার্চ রেসকোর্স ময়দানে লক্ষাধিক লোকের সমাগম ঘটে। সবাই বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনার অপেক্ষায়। সেদিন বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠে স্বাধীন বাংলা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে জেগে উঠেছিল গোটা জাতি। স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য মাঠ প্রস্তুত করা হয়েছিল, যেদিন তিনি তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন। এতে সশস্ত্র সংগ্রামের নির্দেশ প্রস্তুতি ছিল।

এটি একটি মহাকাব্যিক ভাষণ ছিল; এই ভাষণের মাধ্যমে তিনি একটি মহাকাব্য রচনা করেন। মার্চ বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়ে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে উদ্বুদ্ধ করেন। তাই বাংলার দামাল ছেলেরা মাস লড়াই করার সাহস পেল। বঙ্গবন্ধুর মুক্তির প্রদীপ্ত বাণী শোনার জন্য সেদিন সকাল থেকেই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দলে দলে, বাস-ট্রাক-লঞ্চ-ট্রেনে মানুষ জড়ো হয় রেসকোর্স ময়দানে। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে নারী-পুরুষের স্রোতে ভরে উঠেছিল ঘোড়দৌড়ের এই বিশাল মাঠ।

আমার মতে, বঙ্গবন্ধু শুধু একজন বিজ্ঞ রাজনীতিবিদ ছিলেন না; তিনি ছিলেন বিশ্বমানের কূটনীতিক। ৭ই মার্চের ভাষণে তিনি একজন কূটনীতিকের মতো সবকিছু প্রকাশ করেছিলেন। তিনি বলেন, গত ২৩ বছর বঞ্চনার ইতিহাস। তিনি '৫২-এর ভাষা আন্দোলন, '৫৪-এর নির্বাচন, '৫৮-এর সামরিক শাসন, '৬৬-এর ছয় দফা, '৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, '৬৯-এর নির্বাচনসহ তৎকালীন পাকিস্তানে বাঙালিদের বঞ্চনার কথা বলেছেন।৭০ অন্যদিকে কৌশলও জানিয়েছেন তিনি।

তিনি বলতে চান, যুদ্ধ হলে বাঙালির উচিত যুদ্ধের জন্য বর্ষাকালকেই বেছে নেওয়া। কিন্তু পাকিস্তানিরা এই ভাষণের মর্মার্থ বুঝতে পারেনি; বরং পাকিস্তানের তৎকালীন চিফ মার্শাল অ্যাডমিনিস্ট্রেটর বলেছিলেন, 'পরিস্থিতিতে এটাই সেরা ভাষণ।

 

আমার সীমিত জ্ঞানে আমি এই ভাষণটিকে রোমান সম্রাট সিসেরোর সাথে তুলনা করি। এই ভাষণটিকে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী লর্ড পিটস, মার্টিন লুথার কিং এর ভাষণের সাথে তুলনা করা হয়েছে। এবং আব্রাহাম লিংকনের বিখ্যাত গেটিসবার্গ ঠিকানার সাথে তুলনা করা যেতে পারে।

 

আমেরিকান গৃহযুদ্ধের সমাপ্তির চার মাস পরে, যখন জেনারেল লি আত্মসমর্পণ করেন এবং ইউনিয়ন সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল গ্রান্ট বিজয়ী এবং বিজিত উভয় বাহিনীর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করেন, আব্রাহাম লিঙ্কন সমগ্র আমেরিকান জনসাধারণের কাছে একটি মানবিক আবেদন চালিয়ে যান। গেটিসবার্গে বর্ণবাদের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন, এবং তিনি যখন এই বক্তৃতা দিয়েছিলেন তখন গেটিসবার্গ এবং আশেপাশের পরিবেশ বিপজ্জনক ছিল না;

কিন্তু বঙ্গবন্ধুর মার্চের রেসকোর্সের ভাষণ ছিল খুবই ঝুঁকিপূর্ণ।

 

তিনি যেমন বলছিলেন, শত্রুর ঘাঁটির মাঝখানে বসে তিনি জনগণকে শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার ঘোষণা দেন। কারণ, রেসকোর্স ময়দান থেকে সেনানিবাসটি ছিল পাথর নিক্ষেপের দূরত্বে। বেখাপ্পা কিছু বললে পাকিস্তানিরা লক্ষ লক্ষ বাঙালিকে তৎক্ষণাৎ নির্মূল করে দিতে পারে। তিনি জনগণকে নিপুণ কৌশলে শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন এবং বাঙালিদের তা বুঝতে ভুল হয়নি।

 

কৃষ্ণাঙ্গ নেতা মার্টিন লুথার কিং যেমন বর্ণবাদ বৈষম্যমুক্ত একটি জাতির স্বপ্ন দেখেছিলেন, তিনি জাতিকে বর্ণবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে জেগে উঠতে বলেছিলেন; বঙ্গবন্ধু তার মার্চের ভাষণেও জাতিকে বৈষম্যের বিরুদ্ধে জেগে উঠতে এবং সংগ্রাম করতে বলেছিলেন।

নেলসন ম্যান্ডেলা যেমন তার বক্তৃতা দিয়ে জাতিকে বিদ্যুতায়িত করেছিলেন; ৭ই মার্চের সেই অলিখিত স্বতঃস্ফূর্ত ভাষণ দিয়েও বঙ্গবন্ধু জাতিকে অনুপ্রাণিত করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু মার্টিন লুথার কিং-এর স্বপ্ন একই সূত্রে প্রতিষ্ঠিত।

বঙ্গবন্ধুর ভাষণকে সাহিত্য-সমালোচনার দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে এর মহাকাব্যিক দিকটি আমরা সহজেই বুঝতে পারব। মহাকবিরা সাধারণত একটি জাতির ইতিহাস, ঐতিহ্য সংস্কৃতিকে তার লেখার বিষয়বস্তু হিসেবে নির্ধারণ করেন, যার মাধ্যমে তিনি সংশ্লিষ্ট জাতির ইতিহাস উপস্থাপন করেন, যা পড়ে মানুষ উদ্বুদ্ধ হয়, অনুপ্রাণিত হয় এবং কিছু মহৎ কর্মে দীক্ষিত হয়। আধুনিক বিশ্বের ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুর কয়েক মিনিটের একটি অলিখিত ভাষণ তারই নিদর্শন।

 

প্রতীকের ৭ই মার্চের ভাষণ যুগ যুগের মহাকাব্যিক আবেদনের বিচার করবে। দীর্ঘ ভিড়ের ঘটনাগুলি একটি অতুলনীয় কবিতার মতো, একটি স্ফুলিঙ্গের মতো এবং সমুদ্রের উত্তর জলের মতো সত্য সুন্দর শব্দগুলি উচ্চারণ করে।

সেদিন যারা বসে বসে শুনবেন তারাই বুঝবেন এই ভাষণের অর্থ, তাৎপর্য গুরুত্ব। সমগ্র বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে ভাষণের কোনো বিকল্প ছিল না। তিনি যথার্থই সর্বকালের সেরা বাঙালি। ১৯৭১ সালের মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধুর দৃঢ় ঘোষণা- 'সাত কোটি মানুষকে আমরা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারব না' ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের বিজয়ের মধ্য দিয়ে সত্যি হয়েছিল।

এই ভাষণের সুর অনুসরণ করে নতুন নবজাগরণের প্রেক্ষাপট তৈরি হয়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণকারীদের প্রতি বিনীত অনুরোধ, বঙ্গবন্ধুর মার্চের ভাষণে বারবার ফিরে আসুন।

 

আরেকটি কথা আমি বলতে চাই, রাজনীতিবিদদের কাছে জনগণের কাছ থেকে প্রত্যাশিত নেতৃত্ব, সততা, সাহস জবাবদিহিতা না থাকলে তারা নেতৃত্বের পদে থাকবে না। নেতৃত্ব কারো জন্য বসে থাকবে না। ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে নতুন নেতৃত্ব তার জায়গা নেবে। এটাই ইতিহাসের নিয়ম।

বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ঘোষণা স্বাধীনতাকামী মানুষের কাছে লাল-সবুজের পতাকাকে প্রতীকী করে তুলেছিল। আর এর মধ্য দিয়ে শুরু হলো বাঙালির ইতিহাসে এক গৌরবময় অধ্যায়। সাংবাদিক শেরিল ডান বলেন, 'বাংলাদেশের হাজার বছরের ইতিহাসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবই একমাত্র নেতা; যিনি রক্তে, বর্ণে, ভাষাতে, সংস্কৃতিতে জন্মে সম্পূর্ণ বাঙালি। তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা অসীম। তার কণ্ঠ বজ্রধ্বনি।

তার মোহনীয় ব্যক্তিত্বে সাধারণ মানুষ সহজেই বিমোহিত হয়। তার সাহস এবং অনুপ্রেরণা তাকে সময়ের অনন্য সেরা মানুষে পরিণত করেছে।'


Post a Comment