ভূমিকা
: স্বদেশ যেকোনো মানুষের শেষ স্থান স্বদেশ ছাড়া কোন গতি নাই।
কথায় বলে- ‘মা আর মাতৃভূমি
উভয়ের ভালোবাসার মতো এমন পরশ যা মমানুষের কোন ভালবাসায় থাকে না।
সেক্ষেত্রে স্বদেশকে
ভালোবাসা প্রতিটি মানুষের হৃদয়জাত প্রবৃত্ত উন্মোচন করতে হবে।
পৃথিবীতে এমন ব্যক্তি নেই যে তার দেশকে
ভালোবাসে না। যে স্বদেশকে ভালোবাসে
না সে আর যাই
হোক ভালো মানুষ হতে পারে না সে কুকরের থেকে অধম। একটু লক্ষ্য করলে আমরা দেখি, মুরগী ভালোবাসে তার আপন বাচ্চাকে, বনের ভয়ানক পশু তার গহীন বনকে ভালোবাসার টানে ভালোস্থানে রাখলেও সে বনে পালিয়ে
যায় বন কে সে আপন মনে করে।
নিজের গৃহের প্রতি অবাধ টান প্রতিটি প্রাণীর ভেতর রয়েছে যা স্বভাবজাত, রয়েছে ভালোবাসার মতো তীব্র আগ্রহ। মানুষও তার দেশকে ভালোবাসে কারণ প্রতিটি মানুষ যেখানে মানুষ হয়ে ওঠে সে স্থানকে মায়ের
পরেই ভালোবাসা তার কর্তব্য হয়ে ওঠে। মা, মাতৃভাষা আর মাতৃভূমি প্রতিটি
মানুষের দেহে, মনে, প্রাণের সাথে মিশে থাকে দেশের মাটি মায়ের মতো খাটি।
মা আর মাতৃভাষার সাথে
মাতৃভূমি মানুষের কাছে সর্বাপেক্ষা গ্রহণীয় ও মূল্যবান সম্পদ।
তাই কবি দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ভাষায় বলা যায়-
”মিছা
মণি মুক্তা হেম
স্বদেশের
প্রিয় প্রেম
তার
চেয়ে রত্ন নেই আর”
স্বদেশপ্রেম কী ও কেন :
স্বদেশপ্রেমের স্বকীয় সৃষ্টি :
মানুষ হিসেবে যে কেউ তার
স্বদেশ ও স্বজাতিকে অন্য
কিছুর চেয়ে সব থেকে বেশি ভালোবসে দেশ কে নিজের মাঝে ধারণ করে।
মানুষ প্রেম নির্ভর জাতি তাই স্বদেশের
প্রতি তার ভালোবাসা গভীরতর কারণ ।বনের পশুকে স্থানচ্যূত করলে তার অবস্থা সম্পর্কে আমরা অবশ্যই অবগত হই সে প্রকৃতি ভালবাসে বন্দি জীবন সে
চায় না। পশুপাখির
এইধর্মী আচরণকে সংসর্গজাত বলা হয়ে থাকে। কিন্তু মানুষের স্বদেশপ্রীতি কেবল সংসর্গজাত নয়।
স্বদেশপ্রেমের স্বরূপ ও তার চেতনা :
স্বদেশের স্বরূপ স্বদেশকে প্রাণের মতো ভালোবাসা। দেশের সবকিছুতে নিজেকে উৎসর্গ করার নাম স্বদেশপ্রেমের চেতনা। মা, মাটি আর মানুষকে ভালোবাসার
মধ্যে স্বদেশপ্রেমের মূল সত্য নিহিত। ফলে সে দেশের ভাষা,
সাহিত্য, ইতিহাস, ঐতিহ্য, সমাজ-সংস্কৃতিজীবন ও পরিবেশের সঙ্গে
যেমন গড়ে ওঠে তার শেকড়ের বন্ধন, তেমনি মা, মাতৃভাষা ও মাতৃভূমির প্রতি
সৃষ্টি হয় চিরায়ত গভীর
ভালোবাসা। ভালোবাসার এই আবেগময় প্রকাশ
মানুষকে স্বজাতি ও স্বদেশের প্রেমে
উদ্বুদ্ধ করে তোলে। চিন্তায়, কথায়, কাজে স্বদেশের জন্য যে ভালোবাসা প্রকাশ
পায় তাইই প্রকৃত স্বদেশপ্রেম। বিশেষভাবে বলতে গেলে বলতে গেলে বলতে হয়, স্বদেশপ্রেম যেসব বৈশিষ্ট্য দ্বারা উজ্জ্বল সেগুলো হলো- আত্মত্যাগ, বীরত্ব, সরলতা, শর্তহীনতা, কৃতজ্ঞতা, দায়িত্ব, কর্তব্য ও একাত্মবোধ। কবির
ভাষায় বলা যায়-
‘কিন্তু যে সাধেনি কভু জন্মভূমি হিত
স্বজাতির সেবা যেবা করেনি কিঞ্চিৎ
জানাও সে নরাধমে জানাও সত্বর
অতীব
ঘৃণিত সেই পাষণ্ড বর্বর।’
স্বদেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হওয়া :
স্বদেশপ্রেমের প্রতি ভালোবাসা ও হৃদয়ের টান
মানুষের সবচেয়ে আপন প্রবৃত্তি ও মৌলিক অনুভূতি।
এ ভালোবাসা কখনো কখনো সুপ্ত থাকে, কখনো কখনো তা প্রকাশ পায়
মহা ধুমধামে। দেশ যত ক্ষুদ্র বা
পরিসরে ক্ষুদ্র হোক না কেন প্রতিটি
দেশপ্রেমিক মানুষের কাছে তার জন্মভূমি, তার দেশ সবার সেরা। দেশকে যে ভালোবসে সে
তার স্বদেশের জন্য তার ধন-মান এমনকী
জীবন পর্যন্ত উৎসর্গ করতে পারে। ঐক্যবদ্ধভাবে মানুষ যখন একই জীবন ধারায়, একই ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ধারায়
পুষ্ট হয়ে একই আদর্শের অনুপ্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ওঠে তখন মৃন্ময়ী দেশ চিন্ময়ী হয়ে ওঠে। স্বদেশ হয়ে ওঠে অতি আনন্দের পীঠস্থান। সুখের দিনে স্বদেশের প্রতি মানুষের ভালোবাসার চেয়ে দেশের দুর্দিনে স্বদেশের প্রতি মানুষের ভালোবাসার তীব্রতা লক্ষ করা যায়। দেশের সংকটে দেশ যখন নিজের অস্তিত্ব হারাতে বসে তখন একজন স্বদেশপ্রেমিকের মূল কর্তব্য পালনের সুবর্ণ সুযোগ আসে। যখন রক্ত চক্ষু বিদেশি শাসকের, যখন পরাধীনতার বিষ জ্বালায় জর্জরিত মানুষ মুক্তি কামনায় উদ্বেল অস্থির, যখন দেশের মানুষের মধ্যে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার প্রয়োজন হয়, তখনই আসে মানুষের স্বদেশপ্রেমের অগ্নিমন্ত্রের দীক্ষালগ্ন। জীবন অপেক্ষা স্বদেশ তখন হয়ে ওঠে আরো অতি প্রিয়তর। তখন মনে হবে, দেশের জন্য নিঃশেষে প্রাণ কে করিবে দান
মন্ত্রণার মতো। বিদেশ গেলে বা ফেরত এলে
এই দেশের মর্মগত অর্থ বোঝা যায়। তাই কবি দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের কণ্ঠে ভেসে আসে,
‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি
সকল
দেশের রাণী সে যে আমার
জন্মভূমি।’
স্বদেশপ্রেম শিক্ষা :
দেশকে ভালোবাসতে শিখলেই দেশের কল্যাণে জীবন উৎসর্গ করার মনোবৃত্তি গড়ে উঠবে। যদিও স্বদেশপ্রেম মানুষের একটি সহজাত প্রবৃত্তি তবু এ গুণটি অর্জন
করতে হয়। আর এ গুণ
অর্জনের জন্য দেশের সুদিনে বা দেশের উন্নয়নে
তৎপর থাকতে হবে। আর দেশের দুর্দিনে
স্বাধীনতা রক্ষার জন্য জীবন উৎসর্গ করার মনোবৃত্তি গড়ে তুলতে হবে। দেশ সমন্ধে জানতে হবে, দেশের মাটি ও মানুষকে ভালোবাসতে
হবে আর তাহলেই দেশপ্রেমের
মহৎ শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়া যাবে। মনীষীদের মতে- ‘দেশপ্রেম ঈমানের অঙ্গ।’
স্বদেশপ্রেম সুন্দর ও মহত্তে¡র উৎস :
যে কারো কাছে
তার স্বদেশ তার চোখে পৃথিবীর সেরা, এবং তার রূপের কাছে অন্য
কারো দেশ সুন্দর হতে পারে না। এভাবেই দেশের প্রতি মানুষের ভালোবাসা সুন্দর ও মহত্ত্বে ভরে
ওঠে। স্বদেশপ্রেম মনুষ্যবোধকে জাগ্রত করে। স্বদেশের ভালোবাসা শুধু মানুষের মোহমুক্তি ঘটায় না, সঙ্গে সঙ্গে তাকে স্বীয়স্বার্থ ঊর্ধ্বে তুলে ধরে। স্বদেশপ্রেম মানুষের ভেতরকার সব সংকীর্ণতা দূর
করে তাকে মহৎ হওয়ার দীক্ষা দেয়। স্বদেশপ্রেমের স্পর্শে মানুষের ভেতরের সব পশুত্ববোধ দূর
হয় এবং মানব কল্যাণে মানুষ নিজেকে উৎসর্গ করার মন্ত্রণা অর্জন করে। যাবতীয় সুন্দর ভাবনা ও মহৎ উদ্দেশ্য
স্বদেশপ্রেমে অধিভূক্ত। তাই মধ্যযুগের কবি আবদুল হাকিমের ভাষায় বলা যায়-
‘স্বদেশের উপকারে নাই যার মন
কে
বলে মানুষ তার পশু সেই জন।’
স্বদেশপ্রেমের উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত :
যুগে যুগে স্বদেশের জন্য মানুষ বহু দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন; যাঁরা আজও দেশের মানুষের কাছে অনুপ্রেরণার অন্যতম উৎস হয়ে আছেন। উদাহরণস্বরূপ উপমহাদেশের বঙ্গবন্ধু, শেরে-ই-বাংলা, ভাসানি,
সূর্যসেন, ক্ষুদিরাম, মহাত্মা গান্ধি, নেতাজি সুভাষ বসু, কাজী নজরুল ইসলাম, রবীন্দ্রনাথসহ আরো হাজার হাজার মানুষ এবং বাইরের দুনিয়ার বাস্তব উদাহরণ রয়েছে ইতালির গ্যারিবাল্ডি, রাশিয়ার লেলিন ও স্ট্যালিন,
চীনের মাও সেতুং, আমেরিকার জর্জ ওয়াশিংটন, ভিয়েতনামের হো-চি-মিন,
তুরস্কের আতাতুর্ক মোস্তফা কামাল, আর্জেন্টিনার চে গুয়েভারা, জার্মানির
এ্যাডলফ হিটলারসহ আরো অনেকেই নিজ দেশের জন্য আত্মবিসর্জন করেছেন। বাংলাদেশের ইতিহাসে ১৯৫২ ও ১৯৭১ সালে
দেশের জন্য জীবন দেয়া লক্ষ লক্ষ শহিদ ও জীবিত মুক্তিযোদ্ধা,
বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক, ছাত্রসহ শ্রমজীবী মানুষের উৎসর্গীত আত্মদান এক চরম দেশপ্রেমের
উদাহরণ। তাই বলা যায়-
‘দেশের জন্য যারা অকাতরে দিয়ে গেলো প্রাণ
হবে
না হবে শোধ তাদের বিস্মৃত অবদান।’
স্বদেশপ্রেম ও বিশ্বপ্রেম :
স্বদেশপ্রেম বিশ্বপ্রেমেরই একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আমাদের বর্তমান জীবনে জাতীয়তা যখন সংকীর্ণতার অন্ধকূপে বন্দি হয়ে উগ্র রূপ ধারণ করে, তখন বিশ্বপ্রেম পদদলিত হয়। উগ্র জাতীয়তাবোধে কোনো স্বার্থকতা নেই। দেশ জননী, বিশ্বজননী এক ও অভিন্ন।
কারণ দেশ জননীর বুকের ওপর বিশ্বজননীরও আঁচল পাতা। স্বদেশ ও বিশ্বপ্রেম তাই
আমাদের জাতীয় জীবনের এপিঠ-ওপিঠ। তাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানের সুরে বলা যায়-
‘ও আমার দেশের মাটি, তোমার পরে ঠেকাই মাথা
তোমাতে বিশ্বময়ী-তোমাতে বিশ্বমায়ের আঁচল পাতা।’
ইংরেজি
শিক্ষায় শিক্ষিত কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত স্বদেশভূমির প্রতি ভালোবাসায় উদ্বেলিত হয়ে বলেছিলেন-
‘হে বঙ্গ, ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন;
তা সবে, (অবোধ আমি!) অবহেলা করি,
পর-ধন-লোভে মত্ত, করিনু ভ্রমণ
পরদেশে, ভিক্ষাবৃত্তি কুক্ষণে আচরি।
কাটাইনু
বহু দিন সুখ পরিহরি!’
সবাইকে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে স্বদেশকে সবার উপরে স্থান দিতে হবে। স্বদেশ মানুষের নিকট পরম সাধনার ধন; কামনার স্বর্গ। যে দেশ বাঁচার অনুপ্রেরণায় আলো, বাতাস, অন্ন, জল, বস্ত্রসহ সন্তান সুলভ জীবনের সবুজাভ আনন্দ দিলো সেই মমতামণ্ডিত আনুগত্যের দেশকে ভালোবাসা আমাদের শ্রেষ্ঠ কাজ। যেহেতু দেশপ্রেমিক ব্যক্তিই বিশ্ববরেণ্য খ্যাতি লাভ করে। স্বদেশপ্রেমের মাধ্যমে আমরা বিশ্ব ভ্রাতৃত্বের সেতু বানাতে পারি। তাই, যত বড় ঝড়-ঝঞ্ঝা, বিপদ আসুক না কেন আমরা আমাদের জীবন দিয়ে দেশকে রক্ষা করবো, দেশের সেবা করবো আর এতেই স্পষ্ট হবে আমাদের স্বদেশপ্রেমের অনন্যতা।