বাংলা সাহিত্যে নারী চরিত্রের অবস্থান এবং ভূমিকা
মোহাম্মদ
জাহিদ হোসেন
ফ্রিল্যান্স
সাংবাদিক ও কলাম লেখক।
লেখার
ধরণঃ-বিশ্লেষণধর্মী
‘বিশ্বে
যা কিছু মহান সৃষ্টি
চির
কল্যাণকর
অর্ধেক
তার করিয়াছে
নারী,
অর্ধেক তার নর।’
নজরুলের
নারীর জাগরণ ও অধিকার প্রতিষ্ঠায়
তাদের অগ্রগামী হওয়ার আহ্বানের সাথে সাড়া দিয়ে আমি ৮ই মার্চ আন্তর্জাতিক
নারী দিবসের জন্য কিছু লেখার জন্য কলম ধরলাম।
প্রতি
বছরই এই দিনে নারীদের
এগিয়ে নিতে বাংলাদেশেও পালিত হয় আন্তর্জাতিক নারী
দিবস।
এ
বছর এ দিবসের
প্রতিপাদ্য,
"নারীর সম-অধিকার, সমসুযোগ
এগিয়ে নিতে হোক বিনিয়োগ।"
অন্যান্য
বছরের মতন এ দিনও শীতাতপ
নিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসে ধোয়া উঠা কাপের কফিতে চুমুক দিতে দিতে সমাজের সর্ব সুবিধা ভোগী নারী ব্যক্তিত্বরা ডিজিটাল প্রেজেন্টেশনের আলোর ঝলকানির মাঝে হাজারো উপাত্ত নিয়ে সমাধান করতে বসবেন, করিমন, রহিমন, সালেহা,রমিসা সহ লাখ নারীদের
ভাগ্য উন্নয়নের নির্দেশনা।
মজার
বিষয় হলো, যে সব দরিদ্র
ও সুবিধা বঞ্চিত নারীদের ভাগ্য তারা বদলাতে চান তাদের কেউ এ অনুষ্ঠানের ধারের
কাছে ভিড়তে পারে না। তাহলে কি ভাবে হবে
তাদের ভাগ্যের উন্নয়ন?
কি
ভাবে পাবে তারা সম-অধিকার?
যাক
আমার আজকের মূল আলোচনা সেদিকে নয় বরং আজ
আলোচনা করবো নারীরা সমাজের অর্ধেক হলেও প্রাচীন ইতিহাসে তাদের ঠাঁই মিলেছে অল্পই। তেরো শতকের গোড়ায় ইন্দো মুসলিম শাসন পত্তনের সময় পর্যন্তও এই অবস্থার উল্লেখযোগ্য
পরিবর্তন দেখা যায়নি। শুধু পুরুষের অনুপ্রেরণাদাত্রী হিসেবে নয়, বাঙালি নারী অন্তরালে না থেকে সরাসরিভাবে
সম্পৃক্ত হয়ে অবদান রেখেছে বহুক্ষেত্রে।
বাংলা
সাহিত্যের লেখকদের এ সমস্ত নারী
চরিত্রকে বিভিন্ন আঙ্গিকে তুলে আনা এক ধরনের দায়বদ্ধতাই
ছিল বটে।
তাদের
বলিষ্ঠ লেখনী আজও নারীর অধিকার আদায়ের জন্য সমাজে চলমান আছে, আসুন আমরা দেখে নেই কিছু কবি/সাহিত্যিকের লেখনিতে কি ভাবে নারীকে
ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
পর্যায়ক্রমে
সংক্ষিপ্ত আলোচনা করছি।
রবীন্দ্রনাথ
ঠাকুরঃ
'নারীকে আপন ভাগ্য জয় করিবার/কেহ
নাহি দিবে অধিকার/হে বিধাতা?' শুধু
কাব্য বা কবিতায় নয়,
রবীন্দ্রনাথের একাধিক ছোটগল্প ও উপন্যাসে নারীর
স্থান হয়েছে উচ্চ আসনে।
ধ্বনিত
হয়েছে নারীশক্তির জয়গান।
তাঁর
রচনা শেষের কবিতা, গোরা, পয়লা নম্বর, স্ত্রীর পত্র ইত্যাদি বিষয়ে নারীদের মধ্যে একটা স্নিগ্ধ বুদ্ধিদীপ্ত আচরণ লক্ষ্য করা যায়।
তাঁরা
পুরুষের করুণার সামগ্রী নয়, তাঁরা স্বাধীনচেতা মানুষ। প্রয়োজনে তাঁরা পুরুষকে প্রত্যাখানও করতে পারে। যেমন স্ত্রীর পত্রে অসাধারণ চরিত্র মৃণাল বলিষ্ঠভাবে উক্তি করেছে 'ওরে মেজ বৌ ভয় নেই
তোর। তোর মেজ বৌয়ের খোলস ছিন্ন হতে এক নিমেষও লাগে
না। তোমাদের গালিকে আর আমি ভয়
পাইনে। আমার সম্মুখে নীল সমুদ্র, মাথার উপর আষাঢ়ের মেঘপুঞ্জ। আমি বাঁচবো...আমি বাঁচলুম।'
কাজী
নজরুল ইসলামঃ
নজরুল
কাব্য সাহিত্যে নানা ধর্মের, বর্ণের নারীদের আগমন। মোগল সম্রাজ্ঞী নূরজাহান, মমতাজ, চাঁদ সুলতানা, শিরি–ফরহাদ কাহিনীর শিরি, ইরানি বালিকা পল্লি বালিকা, দারু দ্বীপের নারী, পুতুল, বেদেনি থেকে শুরু করে কৃষ্ণের আরাধ্য রাধা পর্যন্ত মমতাজ মহল বা চাঁদবিবিকে যেমন
সুন্দর করে তুলেছেন, তেমনি সমান মর্যাদায় রাজদাসী আনারকলিকেও সমান মূল্য দান করেছেন।
শরৎচন্দ্রঃ-
শরৎচন্দ্রের
উপন্যাসে নারী চরিত্রের মধ্যে দেখতে পাই অন্য রূপ। এক অদ্ভুত আবেগময়
উপস্থিতি। রমা, সাবিত্রী, রাজলক্ষ্মী, কমললতা এসব চরিত্র আপন শুচিতায় ভাস্বর। এঁরা অতৃপ্ত হৃদয়বাসনাকে বহন করে দগ্ধ ধূপের মতো নিজেকে নিঃশেষে বিলিয়ে দেয়। আবার অভয়া, অচলা, কমললতার চরিত্রের মধ্যে বিদ্রোহিণী রূপ ফুটে ওঠে। প্রয়োজনে পুরুষের অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়। 'শ্রীকান্ত' উপন্যাসে অভয়া রোহিণীর ভালোবাসার মর্যাদা দিতে তাঁর সঙ্গে স্বামী-স্ত্রীর মতো বসবাস করেন। স্বামী নামক আদর্শের পিছনে সে আর ধাওয়া
করে না। শ্রীকান্তকে উপলক্ষ্য করে সে সমাজের কাছে
প্রশ্ন করে- 'আমাকে যিনি বিয়ে করেছিলেন, তাঁর কাছে না এসে উপায়
ছিল না। আবার এসেও উপায় হল না। তাঁর
স্ত্রী ছেলেপুলে, তাঁর ভালবাসা কিছুই আমার নিজের নয়, তবু তাঁরই কাছে তাঁর গণিকার মতো পড়ে থাকা থাকাতেই কী আমার জীবন
ফলে ফুলে ভরে উঠে সার্থক হতো শ্রীকান্তবাবু?
বঙ্কিমচন্দ্রঃ-
বঙ্কিমচন্দ্রের
উপন্যাসের মধ্যে অন্যতম নারী চরিত্রগুলো হল আয়েশা, শৈবালিনী,
কপালকুন্ডলা, কুন্দনন্দিনী, রোহিণী প্রভৃতি। প্রতিটি নারী চরিত্র পৃথক ব্যক্তিত্বের অধিকারিণী। বঙ্কিমচন্দ্রের দৃষ্টি ছিল নীতিশাসিত। তিনি সমসাময়িক কালে নারীদের সমস্যাগুলো অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। উদাহরণস্বরূপ 'কৃষ্ণকান্তের উইল'উপন্যাসের ভ্রমরের চরিত্র। ভ্রমরের যেমন স্বামীপ্রেম, স্বামী নির্ভরতা যেমন অতীব সুন্দর। তেমনই স্বামীর বিশ্বাসহীনতা তাঁকে অভিমানের কঠোর আচ্ছাদনে বেষ্টন করে। ভ্রমর তীব্র প্রতিবাদ জানায় স্বামীকে লেখা এক পত্রে। 'তোমার
প্রতি বিশ্বাস আমার অনন্ত। আমিও জানিতাম। কিন্তু এখন বুঝিলাম তাহা নহে। যতদিন তুমি ভক্তির যোগ্য ততদিন আমারও ভক্তি। যতদিন তুমি বিশ্বাসী, ততদিন আমারও বিশ্বাস। এখন তোমার উপর আমার ভক্তি নাই, বিশ্বাসও নাই। এখন তোমার দর্শনে আমার কোনও সুখ নাই।'
সুচিত্রা
ভট্টাচার্য্যঃ
কোনো
এক ঝড়বৃষ্টির সন্ধ্যের টালিগঞ্জ মেট্রো স্টেশনে চার যুবক শ্লীলতাহানির চেষ্টা করে এক গৃহবধূর। সেখানে
আশেপাশের মানুষ যখন নীরব দর্শক, তখন সেই গৃহবধূকে বাঁচাতে এগিয়ে আসে আরেক নারী, শ্রবণা। পরবর্তীতে নির্যাতিতার পক্ষে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে শামিল হয় শ্রবণা। সামাজিক আর মানসিক চাপকে
তুড়ি মেরে উড়িয়ে সে নামে প্রতিবাদে।
সুচিত্রা ভট্টাচার্যের কলমের আঁচড়ে ‘দহন‘ উপন্যাসের শ্রবণা হয়ে
ওঠে এমন এক নারীচরিত্র যে
যে কোনো কিছুর বিনিময়ে চায় সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করতে, চায় স্বাধীনতা আর ন্যায়বিচার।
মানিক
বন্দ্যোপাধ্যায়ঃ-
পরবর্তীকালে
বাংলা সাহিত্যে নারী চরিত্র স্বার্থকভাবে ফুটিয়ে তুলতে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম অগ্রগণ্য। তাঁর রচিত পুতুল নাচের 'ইতিকথা'র কুসুম চরিত্র
এবং পদ্মা নদীর মাঝি উপন্যাসের কপিলার মতো জটিল নারী চরিত্র বাংলা সাহিত্যে বোধ হয় সৃষ্টি হয়নি।
কপিলা স্বামীর ঘর সহজে পায়নি।
কিন্তু যখন সে পেলো, তখন
পূর্বতন প্রেম তাঁকে গভীরভাবে নাড়া দেয়। অবশেষে কুবেরের সঙ্গে কপিলা দু'জনে এক
অজানা দ্বীপের উদ্দেশে রওয়ানা দেয়।
সৈয়দ
ওয়ালীউল্লাহঃ
জমিলা
চরিত্রটি লেখক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর সৃষ্টি এক যথার্থ আদর্শবাদী
চরিত্র, যাকে দিয়ে ঘুণেধরা কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজের মুখে থুতু দিয়েছিলেন তিনি। নারীর মুখ বুজে সয়ে যাওয়ার ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত জমিলা। ধর্ম ব্যবসায়ী স্বামী মজিদের ভণ্ডামি আর অন্যায়-অত্যাচারের
সামনে বার বার বঙ্কিম প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায় জমিলা, ঝড় তোলে কথার। রহিমার মতো চুপ থাকতে শেখেনি সে। জমিলা চরিত্রের তেজ আর রুখে দাঁড়াবার
এই মনোভাব অনন্য মাত্রায় পৌঁছে দেয় ‘লালসালু’
উপন্যাসকে।
সমরেশ
মজুমদারঃ
সামাজিক
ও ধর্মীয় কুসংস্কার, তথাকথিত নিয়মকানুন আর বদ্ধমূল চিন্তাধারার
বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো আপোষহীন অনন্য নারীচরিত্র দীপাবলি। দীপাবলি নিজের কর্মের মাধ্যমে নামকে করতে পেরেছিল সার্থক, অন্তরকে জ্ঞানের আলোয় করে তুলেছিল আলোকিত। বিংশ শতকের মধ্যবর্তী সময়ে পুরুষশাসিত সমাজে দীপাবলি ছিল এক ধরনের বৈপ্লবিক
চরিত্র যে হারতে শেখেনি,
থামতে শেখেনি। সমরেশ মজুমদারের লেখায় দীপাবলি জ্বলে উঠেছিল আত্ম মহিমায়, হয়ে উঠেছিল হাজারো পাঠকের অনুপ্রেরণা। বাল্যকালের বৈধব্য, দারিদ্র্য কিংবা পালিত বাবার মৃত্যুতেও যে থমকে দাঁড়ায়নি।
শুধু ইচ্ছেশক্তি আর আত্মসম্মানবোধ পুঁজি
করে জয়ী হতে পেরেছিল জীবনযুদ্ধে।
আধুনিক
প্রজন্মের লেখকরা নারীর সুখ দুঃখ চাওয়া পাওয়াকে সমর্থন করে নারীকে উচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত করেছে। এতে নারী জয়গান ঘোষিত হচ্ছে। আগামী দিনের সাহিত্যে এর নিট ফল
সুন্দর ভাবে পাওয়া যাবে।
শিল্প-সাহিত্যে বলুন কিংবা হেঁশেলে, ধর্ম, দর্শন কিংবা রাজনীতিতে নারীদের বিকল্প হিসেবে একমাত্র নারীরাই দাঁড়াতে পেরেছে। কখনো হাজার চুরাশির মা আদর্শিক সুজাতা
হিসেবে, কখনো বা হাসিমুখে অনুপ্রেরণাদাত্রী
স্ত্রী মাধবীলতা হিসেবে, আবার কখনো সংশপ্তকের বেপরোয়া ও হার না
মানা হুরমতি হিসেবে। বাংলা সাহিত্যের এ সমস্ত বলিষ্ঠ
নারী চরিত্র আসমান থেকে পড়েনি, চরিত্রগুলো যে বাস্তবে আমাদেরই
মা-বোন-নানী,দাদি তা বুঝতে কারোরই
নিশ্চয়ই দুবার ভাবতে হয় না।