চিরসেবক নেতাজী
সুভাষচন্দ্র
বসু
"আজ বাংলার অনেক কর্মীর মধ্যে ব্যবসাদারী মনোভাব ও ব্যবসায়ী বুদ্ধি বেশ জাগিয়ে উঠেছে। তারা এখন বলতে আরম্ভ করেছে - আমাকে ক্ষমতা দাও - পদ দাও - কিছু না হলে কার্য্যকরী সমিতির সভ্য করে দাও - কিছু না দিলে আমি কোনও কাজ করব না। আমি জিজ্ঞাসা করি নরনারায়ণের সেবা ব্যবসাদারীতে, কন্ট্রাক্টে কবে পরিণত হল! আমি জানি সেবা'র আদর্শ এই - "দাও দাও ফিরে নাহি চাও থাকে যদি হৃদয়ে সম্বল" যে বাঙালি এত তাড়াতাড়ি দেশবন্ধুর ত্যাগের কথা ভুলে গেছে - সে যে কিছুদিন আগের স্বামী বিবেকানন্দের 'বীরবাণী' ভুলে যাবে - এ আর বিচিত্র কী! দুঃখের কথা, কলঙ্কের কথা, ভাবতে গেলে বুক ফেটে যায়।প্রতিকারের উপায় নেই - তা জগতের সাথে সব সম্পর্ক শেষ করে দিই। পারলে দেশবাসীর পক্ষ হতে আমরা তিলে তিলে জীবন দিয়ে প্রায়শ্চিত্ত করে যাব। তারপর মাথার উপরে যদি ভগবান থাকেন, পৃথিবীতে যদি সত্যের প্রতিষ্ঠা হয়, তবে আমাদের হৃদয়ের কথা দেশবাসী একদিন না একদিন ঠিক বুঝবেই বুঝবে। .. অনেক কথা বলে ফেললাম - হৃদয়ের আবেগ চেপে রাখতে পারলাম না। আপনাদের নিতান্ত আপনার বলে মনে করি, তাই এত কথা বলতে পারলাম। আপনারা গঠনমূলক কাজ করেন - আশাকরি আপনারা দলাদলির এই পাঁকে আকৃষ্ট হবেননা। ...." দক্ষিণ কলকাতা জাতীয় বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ভুপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়'কে লেখা সুভাষচন্দ্র বসুর চিঠির কিছু অংশ। এমন এক সময়ে যখন দেশবন্ধু আর হচ্ছেন।
অন্যদিকে বাংলায় দেখা দিয়েছে নেতৃত্বের অভাব। শুরু হয়েছে প্রাদেশিক-প্রধানের চেয়ার লাভের জন্য ভয়ঙ্কর দলাদলি, যার প্রভাব গিয়ে পড়ছে সরাসরি কর্মীদের উপর, তৈরি হচ্ছে গোষ্ঠী, বাড়ছে দ্বন্দ্ব। দেশের রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে মতবিরোধ - কর্মীদের মধ্যে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব - সুভাষচন্দ্র বসুকে বড় বেশি আঘাত দিত। তাঁর কাছে দেশসেবা, দেশের জনগণের সেবাই ছিল একমাত্র চিন্তা ও পথ। কটকে ১৯১৩ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় এক-নম্বর কম পেয়ে দ্বিতীয় স্থান পেয়েছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু। চলে এলেন কলকাতায়, ভর্তি হলেন প্রেসিডেন্সী কলেজে।
ইংরেজ বিরোধী
মনোভাব:
কটকের কিশোর জীবনে একদিকে স্বামী বিবেকানন্দের কর্মবাণী, ধর্ম ও যোগ সাধনার আধিপত্য ছিল তাঁর মনে, আবার মনের মধ্যে আদিগুরু শংকরাচার্যের 'মায়াবাদের' একটা রীতিমতো প্রভাব গড়ে উঠেছিল। কিন্তু কলকাতায় পড়তে এসে তাতে ধাক্কা খেল - নিজের চোখে দেখলেন, ইংরেজরা ভারতীয়দের নেটিভ বলে নানা অজুহাতে প্রকাশ্যে মারধোর করছে, অপমান করছে। কত ক্ষুধার্ত কত অসহায় পথেই জীবন কাটাচ্ছে - তখন একে শুধুই 'মায়া' বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
বাড়ি থেকে কলেজ যাবার সময় রোজ নিজের হাত-খরচ থেকে অসহায়দের সাহায্য করতেন, এজন্য বাড়ি থেকে প্রসিডেন্সী পেতেন। তবু তাঁর মনে শাস্তি নেই, পথে-ঘাটে কোনও সাধু সন্ন্যাসী দেখলেই ছুটে যেতেন তাঁদের কাছে। এমনকি এক উদাসী পাঞ্জাবী
সাধুর কাছে দিক্ষা পর্যন্ত নিয়েছিলেন। কিন্তু কোন কিছুতেই মন ভরল না
তাঁর। জনসেবা ও আধ্যাত্মিক প্রভাবে
অস্থির মন তাঁর। সেইসময়
৩নং মির্জাপুর স্ট্রীটের এক মেডিক্যাল-মেসে
ডাক্তারি পড়া ছাত্র ডা: সুরেশচন্দ্র ব্যানার্জী একটি 'দল' তৈরি করেছিলেন - কৌমার্যব্রত অবলম্বন করে দেশের সেবা ও ধার্মিক জীবন-যাপন করাই ছিল এই 'দলে'র উদ্দেশ্য। বহু
মেধাবী ছাত্র এই 'দলে' যোগ দিয়েছিলেন, বন্ধু হেমন্তকুমার সরকারের মাধ্যমে যোগ দিয়েছিলেন সুভাষচন্দ্র বসুও। এইখানেই ডা: প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষ ও নৃপেন্দ্রনাথ বসুর
সাথে সুভাষচন্দ্রে বসুর ঘনিষ্ঠতা হয়। এইসময় ধর্ম-ভাবই কিশোর থেকে তরুণের দিকে এগিয়ে যাওয়া সুভাষচন্দ্রের মনে প্রবলভাবে ছিল। ধর্ম-জীবন-যাপনের বাসনা তাঁকে এমনভাবে অভিভূত করে দেয় যে, সন্ন্যাস গ্রহণের তীব্র ইচ্ছে তাঁর মনকে সম্পূর্ণ আচ্ছন্ন করে তোলে - যার ফলস্বরূপ বাড়ির কাউকে না জানিয়ে হঠাৎ
একদিন কিশোর বয়সে সুভাষচন্দ্র বসু গৃহত্যাগ করে ভারত-দর্শনে পথে বেড়িয়ে পড়েন। কি
অদ্ভুত! পরবর্তীকালে যে তিনজনকে
ঘিরে ভারতবর্ষের 'স্বাধীনতার রাজনীতি ঘুরপাক খাবে, তাঁদের একজন তখনও দেহে কৌপিন - অবলম্বন করেননি, দক্ষিণ আফ্রিকায়
'সাফল্য' তাঁকে নিজের দেশে একটু একটু পরিচিতি দিচ্ছে, তখনও তাঁর চিন্তায় ভারতে ওকালতির পসার জমিয়ে অর্থ উপারজ্জর্ন করা; অন্যজন এক যুবক তখন
ব্যারিস্টারি পড়তে গিয়ে ক্যান্ত্রিজে টেনিস খেলায় মত্ত, নিজের দেশে 'পণ্ডিত' বলে তখনও কেউ সম্মোধন করেনি; আর বাংলার ছেলে
সুভাষচন্দ্র বসু ঠিক এমন সময়ে সন্ন্যাসীর বেশে স্বামী বিবেকানন্দ'কে প্রেরণা করে
নিরুদ্দেশের পথে ঘুরে বেড়াচ্ছেন! ভারতবর্ষ চিনছেন! অখণ্ড ভারতবর্ষের অশেষ সৌভাগ্য যে ব্যক্তিগত মুক্তির
এই সন্ধান সুভাষচন্দ্র বসু'কে শেষ পর্যন্ত
সন্ন্যাস-জীবনে নিয়ে যায়নি, তিনি বাড়িতে ফিরে এসেছিলেন।
সেবাদল গঠন:
কলেজ
জীবন শুরু করার আগেই কিশোর সুভাষচন্দ্র ও তাঁর একদল-বন্ধু ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ও স্বামী বিবেকানন্দের
উপদেশ ভবধারা অনুযায়ী নিজেদের জীবন-গঠন করার সঙ্কল্প গ্রহণ করেন। কটকে থাকাকালীন ছাত্রবস্থাতেই স্বামী বিবেকানন্দের আদর্শে একটি 'সেবাদল' তৈরি করেছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু। ১৯১১ দেখা দিল কটক শহরে। সব দেখে চিন্তিত
সুভাষচন্দ্র তাঁর গড়ে তুললেন সমাজসেবী দল।৷নাওয়া-খাওয়া বাদ দিয়ে টা সদ্য পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে ঘুরে কলেরা রোগীদের সেবা করে যেতে লাগলেন। সেই বয়সে তখনও রাজনীতি তাঁর মাধায় আসেনি, দেশজ্রীতি তখনও কোনও নির্দিষ্ট রূপতৈরি করেনি তাঁর মনে, কিন্তু কি আশ্চর্য .. নিজের
এই 'দেশ' যে তাঁর আরেক
'মা' - এই বোধটা তৈরি
হয়ে গেছে শিক্ষক বেণীমাধব দাসের শিক্ষায়। খবরের কাগজে বিভিন্ন সময়ে বিপ্লবীদের ছবি ছাপা হলে তা কেটে পড়ার
ঘরের দেওয়ালে টাঙিয়ে রাখতেন বালক সুভাষ। ১৯১১, সালের ১১ আগস্ট শহীদ
১ ক্ষুদিরাম বসুর ফাঁসি হবার দিনে গণ-অনশনে নেতৃত্ব
দিয়েছিলেন বালক সুভাষ । ঈশ্বর প্রেম,
দেশ প্রেম ও স্বদেশ- -বাসীর
প্রতি প্রেম - সব এক হয়ে
যাচ্ছিল সুভাষচন্দ্রের মনের ভেতরে, সেই বালক বয়স থেকেই। বাড়ি থেকে স্কুল - যাতায়াতের পথে রোজ দেখতেন এক বৃদ্ধা রাস্তার
এক পাসে বসে থাকে, সেই ছোট্ট বয়সেই কাউকে না জানিয়ে নিজের
টিফিন থেকে দু'খানি রুটি
তিনি সেই বৃদ্ধার হাতে তুলে দিতেন। একথা কেউ তাঁকে বলে দেননি, এই কাজ তিনি
নিজের হৃদয়ের ডাক শুনে করেছেন। যারা আর্ত, যারা দুঃস্থ, তাদের জন্য কিছু করতে হবে - এই গঠনমূলক প্রবৃত্তি
তাঁর উদাস মনের উদার দিগন্তটাকে ছুঁয়ে ফেলেছে। একজন তেরো-চোদ্দ
বছর বয়সী কিশোর ছেলে তার খেলা-পড়ার সঙ্গীদের নিয়ে - নিরন্ন, দরিদ্র, ব্রাত্য জনগণকে
শিবজ্ঞানে সেবা-শুশ্রষা করার জন্য - একটা 'সেবাদল' তেরি করে সেবা করছেন - এটা এই বর্তমান
সময়ে দাঁড়িয়ে আমরা আমাদের ছেলে-মেয়ে বা চেনা-জানা কোনও ছোট ছেলে-মেয়েদের সম্বন্ধে
চিন্তাও করতে পারবো না।
সুভাষচন্দ্র বহিস্কৃত
সুতরাং গৃহত্যাগ
কোনও হঠাৎ আবেগের বশে সিদ্ধান্ত নয়। তাঁর মন প্রস্তুত হচ্ছিল অনেক আগে থেকে। স্বামী
বিবেকানন্দ'ও প্রথমে ব্যক্তিগত মুক্তি সাধনায় এগিয়েছিলেন, তা হতে দেননি ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ
- তিনি স্বামীজীর মধ্যে দেশের সাধারণ দশ-জনের ভালো-মন্দের চিন্তা, সেবার চিন্তা এনে
দিয়েছিলেন - তাই শোনা গেল মেঘমন্দ্রের মতো - "ওঠো জাগো, ধরো পেশীতে লৌহ, স্নায়ুতে
বজ্র .. নিজেকে বিসর্জন করো মূর্খ, দরিদ্র, ভারতবাসীর সেবায়, পূজা করো সেই জীবনরূপী
শিব'কে .।" আর গৃহত্যাগী কিশোর সুভাষচন্দ্র
বসুর ক্ষেত্রে সেই কাজটি করেছিলেন সেইসময়ে বারানসীর রামকৃষ্ণ মিশনের অধ্যক্ষ ব্রম্মানন্দস্বামী
ওরফে রাখাল মহারাজ, যিনি সুভাষচন্দ্র বসুকে বাড়ি ফিরে যেতে বলেছিলেন। স্বামী বিবেকানন্দ'কে
মাথায় রেখে পথচলা শুরু করলেন কিশোর থেকে তরুণের দিকে এগিয়ে যাওয়া সুভাষচন্দ্র বসু।
১৯১৪ সালের গ্রীম্মের ছুটিতে বন্ধু হেমন্ত সরকার'কে সাথে নিয়ে 'গুরুর খোঁজে' সুভাষচন্দ্র
বসু গৃহত্যাগ করেছিলেন এবং সেই ভারত-দর্শনে এক অভুতপূর্ব অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে ফিরে
এসেছিলেন। বাড়ি ফিরে এসে জ্বর, জ্বর থেকে টাইফয়েড। অসুস্থ শরীরে শুয়ে শুয়ে শুনলেন
"প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। ১৯১৪ থেকে ১৯১৬ - ছাত্র সুভাষচন্দ্র বসুর কলকাতার
ছাত্র জীবনে বহু ঘটনা ঘটেছে, যার কমবেশি যারমধ্যে গৃহত্যাগ এবং অধ্যাপক ওটেন-পর্ব উল্লেখযোগ্য।
ওটেন-ঘটনায়
কোনওরকম
জড়িত না থাকলেও শাস্তিস্বরূপ
কলেজ থেকে বহিস্কৃত করা হয় সুভাষচন্দ্র বসুকে। এখানে আমাদের আলোচনার বিষয় যেহেতু 'সেবক নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু, তাই এই সমস্ত ঘটনার
বিস্তারিত সম্পূর্ণ আলোচনার প্রয়োজন নেই। কলেজ স্ট্রিটের এক মেসে তিনি,
সুভাষ এবং অন্য বন্ধুরা প্রায়ই যেতেন। সেখানেই তাঁরা বিপ্লবী বাঘাযতীন যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের সংস্পর্শে আসার সুযোগ পেয়েছিলেন। ১৯১৫ সাল, সেসময় সুভাষচন্দ্র কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে আই.এ পাস
করেছেন। সেইবছর সেপ্টেম্বরে যখন বাঘাযতীন তাঁর চার সঙ্গীকে নিয়ে ওড়িষ্যার বালেশ্বরের বুড়িবালাম নদীর তীরে ইংরেজ সৈন্যদের হেমন্তের সাথে কৃষ্ণনগরে ছিলেন। কারণ ১৯১৪ সালের পরে হেমন্ত সরকার কৃষ্ণনগরে শ্রমিকদের নল পড়াশোনা করাবার
জন্য অবৈতনিক 'নৈশ বিদ্যালয়' স্থাপন
করেছিলেন। মূলত বন্ধুকে সেই কাজে সাহায্য করতেই চিরসেবক সুভাষচন্দ্র বসু আসতেন নৈশ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতে। ১৯১৬ সালের মার্চ মাসে কলকাতা থেকে কটক ফিরে ॥ গেলেন বহিষ্কৃত
ছাত্র নির্দোষ সুভাষচন্দ্র বসু। শিক্ষক বেণীমাধব দাস এরফলে একদিকে তাঁর পড়াশোনার বিশেষ ক্ষতি হ'ল, অন্যদিকে
অন্যায়ের বিরুদ্ধে আপোষহীন সংগ্রামের জন্য আত্মবিশ্বাস ও আত্মশক্তি খুঁজে
পেলেন মনের মধ্যে, আত্মত্যাগের স্বাদ পেলেন জীবনে প্রথম। কটকে গিয়ে প্রথমেই তিনি ধর্ম ও সাধনার ভাব
সরিয়ে রাখলেন মন থেকে। মন
দিলেন সমাজসেবায়। মানুষের সেবায় অদ্ভুত আনন্দ পেতে লাগলেন মনের মধ্যে। কটকে তৈরি করা কলেরা বিভাগে ডিউটি দিতে শুরু করলেন। নিঃস্বার্থ | জনসেবাই ভগবানের সেবা - স্বামীজীর এই বাণীর মর্মার্থ
নতুন করে উপলব্দি করলেন হৃদয়ে। ১৯১৭ চার্চ কলেজে আবার শুরু হয় শিক্ষাজীবন এইসময়তেই সামরিক শিক্ষাও নিয়েছিলেন তিনি, আগ গন দা
ভাত্র দিসাবে সামরিক শিবিরে তিলেন চারমাস।
১৯১৯
সালে বিএ পাস করলেন; অনার্সে প্রথম বিভাগ ও দ্বিতীয়স্থান অধিকার
করলেন। সেইবছর সেপ্টেম্বরে বাবা ও পরিবারের ইচ্ছায়
সিভিল সার্ভিস পড়তে নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে রওনা হলেন ইংল্যান্ড, ঠিক তার পাঁচ-মাস আগে ঘটে গেছে ভয়াবহ নৃশংস জালিয়ানওয়ালা বাগ গণহত্যাকাণ্ড। ১৯২১ সালে ইংল্যান্ডে আইসিএস পরীক্ষায় চতুর্থ হয়েও লোভনীয় চাকরি ছেড়ে দিয়ে সুভাষচন্দ্র বসু ফিরে এলেন নিজের স্বদেশ ভারতবর্ষে, বিবাহ না করার অটল
সংকল্প গ্রহণ করলেন, যোগ দিলেন রাজনীতিতে, যে ঘটনা ভারতবর্ষ
ও ইংল্যান্ড - দুই জায়গাতেই আলোড়ন ও বিস্ময় তৈরি
হয়েছিল৷ দেশের জনগণের জন্য সর্বস্ব বিলিয়ে দেওয়া দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ'কে নিজের রাজনৈতিক-গুরু পদে বরণ করলেন সুভাষচন্দ্র বসু। ভারতবর্ষে শুরু হ'ল 'সুভাষ-যুগ'। কিন্তু শুধু
রাজনীতি নয়, তিনি কাজ শুরু করলেন একটি নির্দিষ্ট গঠনমূলক কাজকে লক্ষ্য রেখে। নে ১৯২২, সেপ্টেম্বর
মাসের শেষদিকে ৮৮ উত্তরবঙ্গে ভয়াবহ
বন্যা হয়। আচার্য ৮৬০ প্রফুল্চচন্দ্র রায় 'আত্মচরিতে' রে লিখেছেন, "২২
সেপ্টেম্বর তারিখ "**** হইতে আরম্ভ করিয়া যে প্রবল বৃষ্টির
রগ ফলে আদ্রাই নদীর গর্ভ প্লাবিত হয়, মম তাহাই বন্যার
কারণ।...সংবাদ প্রযুরচন্দ্ররায় _. পাইয়া শ্রীযুক্ত সুভাষচন্দ্র বসু চিত্তরঞ্জন ট্লাশ ঘটনাস্থলে অবস্থা পরিদর্শন করিতে গমন করেন।" 'ভারতের মুক্তি সংগ্রামে' সুভাষচন্দ্র বসু লিখেছেন, "১৯২২-এর বন্যা ছিল
ভয়ঙ্কর ভয়াবহ। বাংলার চারটি জেলা বড় ক্ষতিগ্রস্থ হয়, ঘরবাড়ি, শস্য, গবাদি পশু সব ভেসে যায়।
সমগ্র গ্রামাঞ্চল এক বিশাল জলাশয়ে
পরিণত হয়।" বন্যার খবরে প্রথম সুভাষচন্দ্র বসু নিজ উদ্যোগে ত্রাণ নিয়ে উত্তরবঙ্গের বন্যার জায়গায়ে চলে গেছিলেন। সান্তাহার নামে এক জায়গায়ে দিনের
পর দিন বন্যার জলের মধ্যে থেকে সেবাকাজের মূল ঘাঁটি তৈরি করে কাজ করতে থাকেন। এই ভয়াবহ বন্যার
সময় ত্রাণকার্যে সুভাষচন্দ্র বসুর অবদান এক কথায় গঁতিহাসিক,
অবিস্মরণীয় ১১ মার্চ, ১৯২৪,
সুভাষচন্দ্র বসু একটি অনাথ আশ্রম প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ভবানীপুরের মিত্র ইনস্টিটিউশনে কলকাতার নাগরিকদের একটি সভা আহ্বান করেছিলেন। উদ্দেশ্য-দুঃস্থ, অভিভাবকহীন এবং সমাজে ন্যুনতম পরিষেবা থেকে বঞ্চিত শিশু ও বালকদের (৬
থেকে ১৮ বছর) প্রতিপালনের
ইচ্ছা। এই সভায় সভাপতিত্ব
করেন
দেশবন্ধু
চিত্তরঞ্জন দাশ। সভায় উপস্থিত সকলের মতামতে আশ্রমের নাম রাখা হয় "দক্ষিণ কলিকাতা সেবাশ্রম।" সর্বসম্মতিক্রমে আশ্রম পরিচালনার সভাপতি নির্বাচিত হন দেশবন্ধু। সুভাষচন্দ্র
বসু হলেন সাধারণ সম্পাদক। আশ্রম পরিচালনায় চাই প্রচুর আর্থিক সাহায্য, প্রথম দিনই এক বিরাট-অনুদান
দিয়েছিলেন সভায় উপস্থিত আচার্য প্রফুল্পচন্দ্র রায়। শৃঙ্খলার জন্য সেবাশ্রমের একটি নিজস্ব সংবিধান আছে,
১৯২৮ সালে এটি তৈরি করেন রমাপ্রসাদ মুখার্জি। । 'দক্ষিণ কালিকাতা
সেবাশ্রম' - সুভাষচন্দ্র বসুর এক অতি দুর্বলতম
জায়গা। আশ্রম নিয়ে খুব আবেগপ্রবণ সু ছিলেন তিনি।
আশ্রম প্রতিষ্ঠার এক-মাসের মধ্যেই
সুভাষচন্দ্র বসুর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বহুগুণে বেড়ে ॥ যায়। ১৯২৪,
১৬ এপ্রিল, কলকাতা কর্পোরেশনের ৫ নির্বাচনে স্বরাজ্য
দল বিপুল জয়লাভ করে। ২৪ ! এপ্রিল, কলকাতা কর্পোরেশনের প্রথম মেয়র হন ্্. দেশবন্ধু
চিত্তরঞ্জন দাশ, প্রথম চিফ একজিকিউটিভ পঠঁব অফিসার সুভাষচন্দ্র বসু, ডেপুটি মেয়র হোসেন ই চূর্ণ সোহরাওয়ার্দী,
শরৎচন্দ্র বসু হলেন অন্ডারম্যান। সুভাষচন্দ্র বসুর অক্লান্ত কাজকর্ম আজও স্মরণীয়। কি কি করলে
নাগরিক পরিসেবা আরো উন্নত করা যায়, সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি ছিল তাঁর। বর্ষা কাল, শুনলেন কলকাতার বহু জায়গায়ে জল জমেছে, তাই
গামরুট পরে প্রথমে অফিস তারপর কলকাতার বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে ঘুরে দেখতেন। একদিন পার্ক স্ট্রিটে এক নিরীহ ঝাড়ুদারকে
গুলি করার অভিযোগ ওঠে ব্রিটিশ পুলিশের বিরুদ্ধে৷ প্রথম প্রতিবাদে গর্জে ওঠেন পুরসভার সিইও সুভাষচন্দ্র বসু। গরিব দুস্থ নাগরিকদের জন্য 'দাতব্য চিকিৎসালয়' ব্যবস্থা ও 'বিনামূল্যের দুধ
সরবরাহ কেন্দ্র তৈরি করেছিলেন তিনি। দেশের জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিদের নাম অনুসারে কলকাতার রাস্তা ও পার্কের নামকরণ
করা হলো তাঁর নির্দেশে। কর্পোরেশনের বিপুল কাজের চাপ সত্ত্বেও সুভাষচন্দ্র বসু আলাদাভাবে সময় দিতেন 'দক্ষিণ কলিকাতা সেবাধ্রমে'। আশ্রম নিয়ে
তাঁর নিষ্ঠা এতটাই ছিল যে তিনি বলেছিলেন
- প্রয়োজনে এই দলাদলির রাজনীতি
ছেড়ে দেব, কিন্তু সেবাশ্রম ছাড়ব না। দ্বিতীয়বার গ্রেপ্তার হবার পরে বাংলা ১৩৩১ সন ৯ই কার্তিক
(ইং ২৬/১০/১৯২৪)
আনন্দবাজার পত্রিকায় সুভাষচন্দ্র বসু লিখলেন - "আমি আজ ১৮১৮/৩
আইনে গ্রেপ্তার হইয়া চলিলাম। .... দক্ষিণ কলকাতা সেবাশ্রম প্রভৃতি কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের সহিত আমি
সাক্ষাৎভাবে
সংশ্লিষ্ট। আমার অনুপস্থিতিতে এই প্রতিষ্ঠান সমুহের
বিশেষ ক্ষতির সম্ভাবনা। অন্তত আমি ফিরে না আসা পর্যন্ত
ইহাদের সাহায্য করিবার জন্য সহৃদয় দেশবাসীদিগকে অনুরোধ জানাইতেছি।" সেবাশ্রমে সুভাষচন্দ্র বসুর গোপন সেবা-দান ব্যর্থ হয়নি, 'দক্ষিণ কলিকাতা সেবাশ্রম' আজও বিনা প্রচারে স্বমহিমায় কাজ করে চলেছে। ১৯২৮
থেকে ১৯৩১ - এই সময়ে সুভাষচন্দ্র
বসু ভারতের / শ্রমিকদের
দুঃখ-কষ্ট দূর করতে, তাঁদের হকের পাওনা পাইয়ে
দিতে শ্রমিক-আন্দোলনে যথাসম্ভব অংশ নিয়েছেন,
কৃষক আন্দোলনকে পথ দেখিয়েছেন। শুধু রাজনীতি
নয়.. এখানেও বড় হয়েছে তাঁর কোমল হৃদয় -মানবতাবাদ।
সুভাষচন্দ্র বসুর এই ভূমিকাকে অনেকেই শ্রমিক
আন্দোলনকে নিজেদের একচেটিয়া অধিকারের স্ব । ] বিষয় মনে করেন এবং অবশ্যই আরেকপক্ষ যাঁদের * ৭ সাথে
সুভাষচন্দ্র বসুর রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য 1 মই আছে। যে
সময়ের কথা, সে সময় সুভাষচন্দ্র
বসু ্ ভারতের স্বাধীনতার
রাজনীতিতে একজন উদীয়মান অত্যন্ত
জনপ্রিয় নেতা। এতটাই তাঁর জনপ্রিয়তা বা ্্ত এতটাই
তাঁর নির্দেশ দেওয়ার ক্ষমতা যে, সারা ভারতবর্ষ 4 জুড়ে
সমস্ত বিপ্লবী গুপ্তদল তাঁর অনুগামী। আবার সেই | সময়ে
নানা বিরুদ্ধ ক্ষেত্রে তাঁকে লড়াইও করতে হচ্ছে। জাতীয়
সংগ্রামের ক্ষেত্রে প্রধান ও প্রথম বিরুদ্ধ
ক্ষেত্র ৬৮ অবশ্যই ব্রিটিশ
পক্ষ, যাদের দ্বারা এরমধ্যেই উর একাধিকবার সুভাষচন্দ্র
বসু গ্রেপ্তার হয়েছেন, দীর্ঘ সময় বছর
ধরে কারাগারে থেকেছেন। দ্বিতীয় বিরুদ্ধ ক্ষেত্র - গান্ধী
ও তাঁর অনুগামীদের অকারণ বিরোধীতা ও অসভ্যতা। এবং
তৃতীয় বিরুদ্ধ ক্ষেত্র - বাংলা প্রদেশ জুড়ে, যেখানে দেশবন্ধুর পরবর্তীকালে যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্তের চূড়ান্ত দলাদলি। বাংলায় দলাদলি থামাতে সুভাষচন্দ্র বসুকে একটু বেশি সময় দিতে হয়েছিল, তারপর বঙ্গীয় কংগ্রেসের সভাপতি হিসাবে তাঁকে জাতীয় আন্দোলনের বহু অংশে সক্রিয় থাকতে হয়। এই সমস্তের মধ্যেও
সুভাষচন্দ্র বসু ভারতের শ্রমিক আন্দোলনে যে পরিমাণ শ্রম
ও সময় দিয়েছেন, তা সত্যি অতি
বিস্ময়ের। কারণ সুভাষচন্দ্র বসু চেয়েছিলেন দেশের মুক্তি সংগ্রামে দেশের সমস্ত ক্ষেত্র থেকে সর্বাধিক সংখ্যক মানুষের সমর্থন।
জেলে
বন্দি থাকা অবস্থায় মেয়র পদে প্রার্থী হয়েছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু, জিতলেনও। সুভাষচন্দ্র বসু কলকাতা মেয়র পদে ছিলেন ২২/০৮/১৯৩০
থেকে ১৫/০৪/১৯৩১
পর্যন্ত, এরপর তিনি ব্রিটিশ সরকার দ্বারা আবার গ্রেপ্তার হন। সময় পেয়েছিলেন মাস-আটেকেরও কম। কিন্তু এটুকু সময়ের মধ্যেই নাগরিক ও পুরকর্মীদের স্বার্থে
যা পরিকল্পনা করেছিলেন তিনি, সেই পরিকল্পনাই পরবর্তীকালে বাস্তবে রূপ পায়। অভাবি পরিবারের ছেলে-মেয়েরা যাতে ঠিকমতো শিক্ষালাভ প্রথম ভেবেছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু, তাঁর ভাবনাতেই ট্যাংরা অঞ্চলে তৈরি হয় কলকাতার প্রথম পুরসভা স্কুল। তাঁরই উদ্যোগে পুরসভার প্রথম চালু হয় ভর্তুকিয়ুক্ত সস্তার ক্যান্টিন। দূরদর্শী সুভাষচন্দ্র বসু প্রথম অনুধাবন করতে পেরেছিলেন যে শহরের জঞ্জাল
ফেলার একটি বিকল্প জায়গার প্রয়োজন। তাঁর আমলেই ধাপার মাঠটি জঞ্জাল অপসারণের জায়গা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। বহু বছর ধরে পরিশ্রুত জলের অভাবে কলকাতায় ডায়েরিয়ার প্রকোপ চিরস্থায়ী ছিল। রোগের হাত থেকে মুক্তি পেতে সুভাষচন্দ্র বসু পরিকল্পনা করলেন কলকাতার অদূরে পলতা থেকে শহরে পানীয় জল সরবরাহের ।
ইতিহাসবিদ রজতকান্ত রায় বলছেন, "মেয়র হিসেবে হিন্দু-মুসলিম এক্য রক্ষা ও দারিদ্র্য নিবারণের
জন্যও সুভাষচন্দ্র বসু কাজ করেছিলেন। পুরসভার সিইও থাকাকালীন অবশ্য তিনি ওই কাজের উপরে
গুরুত্ব দিয়েছিলেন। কিন্তু মেয়র হিসেবে তা আরও জোরদার
ভাবে করতে থাকেন। যদিও পর্যাপ্ত সময় তিনি হাতে পাননি। তাড়াহুড়োর মধ্যেই তাঁকে কাজ করতে হয়েছিল।” 'গোড়ার কথা' নিবন্ধে সুভাষচন্দ্র বসু তাঁর অসাধারণ ত্যাগন্ত্রত খুঁজে পেয়েছিলেন সর্বত্যাগী শংকর শিবের আদর্শের মধ্যে - "নীলকণ্ঠকে আদর্শ করে যে ব্যক্তি বলতে
পারে - আমার মধ্যে আনন্দের উৎস খুলে গেছে, তাই আমি সংসারের সকল দুঃখ কষ্ট নিজের বুকের মধ্যে টেনে নিতে পারি; যে ব্যক্তি বলতে
পারে - আমি সব যন্ত্রণা ক্লেশ
মাথায় তুলে নিচ্ছি কারণ এর ভেতর দিয়ে
আমি সত্যের সন্ধান পেয়েছি - সেই ব্যক্তিই সাধনায় সিদ্ধ হয়েছেন। আমাদের আজ এই সাধনায়
সিদ্ধ হতে হবে। নূতন ভারত যারা সৃষ্টি করতে চায়, দিয়ে যেতে হবে - নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে কাঙাল হয়ে যেতে হবে - প্রতিদানে কিছু না চেয়ে। নিঃশেষে
্ঠ জীবনদান করেই জীবনের প্রতিষ্ঠা করতে হবে।" ') ১৯১১সালে কলকাতা থেকে দিল্লীতে রাজধানী
স্থানান্তরিত
হবার কথা ঘোষণা হয়, সেই উপলক্ষ্যে ১৯১২ সালের ডিসেম্বরে দিল্লীতে হয় অনুষ্ঠান। ডিসেম্বরের ২৩ তারিখ, বালক
থেকে কিশোর বয়সে এগিয়ে যাওয়া সুভাষচন্দ্র বসু শুনতে পেলেন দিল্লীতে স্বাগত অনুষ্ঠানে হাতির পিঠে চেপে ঘুরতে থাকা ভাইসরয় হার্ডিঞ্জ-এর উপর বোমা
ফেলা হয়েছে .. শুনতে পেলেন রহস্যেমোড়া বিপ্লবী রাসবিহারী বসুর নাম। ইতিহাসের পথে সময় তার আপন আহ্বানেই জার্মানি থেকে জাপানে চলে এলেন নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু .. দীর্ঘ তিনমাসের সমুদ্রের জলের তলা দিয়ে দুঃসাহসী সাবমেরিন অভিযান.. মাঝসমুদ্রে আবার সাবমেরিন বদলও করেছিলেন। কিসের জন্য তাঁর এই কষ্টভোগ! উত্তর
একটাই - দেশ.. নিজের স্বদেশবাসীকে বিদেশির শোষণ-শাষন হতে মুক্ত করা। দায়িত্ব নিলেন আজাদ হিন্দ ফৌজ - ভারতীয় জাতীয় বাহিনীর। সিঙ্গাপুরে ২১ অক্টোবর ১৯৪৩,
গঠিত হয় আজাদ হিন্দ সরকার - আর্জি হুকুমত-এ-আজাদ হিন্দ
অর্থাৎ স্বশাসিত মুক্ত ভারত। শ্লরীরামকৃষ্ণ-স্বামী বিবেকানন্দ ভাবে বিশ্বাসী নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়ঙ্কর সেই সময়েও সকলের অগোচরে সিঙ্গাপুরের রামকৃষ্ণ মিশনে যেতেন। সেখানে মা ভবতারিণী, শ্রীরামকৃষ্ণ,
মা সারদার ছবির সামনে একান্তে ধ্যানমগ্ন হয়ে থাকতেন। মা সারদার জন্মদিনে
তিনি মিশন থেকে একটি 'শ্রীশ্রীচণ্ডী' বই উপহার পেয়েছিলেন,
যা পেয়ে তিনি অত্যন্ত খুশি হয়েছিলেন। আশ্রমের অনাথ বালক বালিকাদের থাকার ঘর ও সঠিক
রেশনের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন তিনি। এছাড়াও আশ্রমের সার্বিক উন্নতির জন্য ১০৭৫ হাজার ডলার আর্থিক সাহায্য করেছিলেন নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু। শিক্ষক বেণীমাধব দাস ছাত্রদের বলেছিলেন - "পড়াশোনা কর, খেলাধুলা কর বা সমাজসেবা,
আগে চাই শৃঙ্খলা . শৃঙ্খলাবোধ না আনলে কোনও
কাজেই সফলতা আসবে না।" শিক্ষকগুরুর এই কথাটা খুব
মনে ধরেছিল সুভাষের। কটকে স্কুল
ছুটির
পরে বিকেলে মাঝেমধ্যে শহরের উত্তরদিকে থাকা মহানদীর ধার বরাবর চলে যেতেন বালক ছাত্র সুভাষ। সঙ্গে থাকত নির্দিষ্ট কিছু বন্ধু। ফাঁকা জায়গা। একটা নির্দিষ্ট জায়গায়ে এসে সকল বন্ধু সারিবদ্ধভাবে দাঁড়াত, সবার সামনে থাকত সুভাষ। তারপর সকলে সৈন্যদের মতো 'মার্চ' করতে করতে যেত। কিছুদূরে আর একটা নির্দিষ্ট
জায়গায়ে পৌঁছে তারপর অন্য খেলা শুরু করত বালক সুভাষের 'শিশু-ফৌজ'। সেই ছোট্ট
বয়সেই সুভাষচন্দ্রের চিন্তাভাবনা ছিল আর পাঁচজন সমবয়সীদের
থেকে একদম আলাদা। ভাবলে অবাক লাগে, কিশোর অবস্থা থেকেই সুভাষচন্দ্র কখন কখন একা একাই পৌঁছে যেতেন শ্মশানে, সেখানে অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে থাকতেন, সেসময় জীবনটাকে খুব ছোট বলে মনে হতো তাঁর .. মনে হতো একটা দুঃসহ যন্ত্রণা বুকের ভেতরে দলা পাকাচ্ছে . শতচেষ্টাতেও কোনও পথ খুঁজে পাচ্ছেন
না। বহু প্রশ্ন জাগছে মনে .. মানুষ কি শুধু নিজের
জন্যই বাঁচবে! .. পৃথিবীতে জন্ম নেওয়া মানব জীবনের চূড়ান্ত সার্থকতা কিসে ? একদিন উত্তর খুঁজতে সুভাষ চিঠি লিখলেন কটক থেকে কৃষ্ণনগরে বদলি হয়ে যাওয়া তাঁর শিক্ষক বেণীমাধব দাস'কে। শিক্ষক লিখে পাঠালেন - "প্রকৃতির কাছে যাও। একমাত্র প্রকৃতিই তোমাকে আত্মিক শাস্তি দিতে পারে। নিজেকে বিলিয়ে দাও প্রকৃতির কাছে। নির্জন পাহাড় প্রান্তর বা নদীতীর বেছে
নাও, তারপর সেখানে ধ্যানে বসে
যাও। দেখবে প্রকৃতি তোমার সব প্রশ্নের উত্তর
দিচ্ছে।” 'ধ্যানে' বসলেন কিশোর সুভাষচন্দ্র বসু .. একা নির্জন কোনও জায়গায়ে। ফলে রোজ সন্ধ্যের পরে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে মাঝেমধ্যেই বাড়িতে ফিরতে দেরি হয়। এজন্য বাবা-মা'য়ের অভিযোগ
শুনতে হয় তাঁকে। অনেক সময়ে বাবা ও মা'য়ের
অমতে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে যেতেও পারেননা। আবার বাড়িতে লোকজনের ভিড়। সেখানে ধ্যান বা যোগ অভ্যাসের
সুযোগ নেই, আর এই কথা
কাউকে জানানও যাবে না। তবু তারই মধ্যে সুযোগ করে নিতেন তিনি। বন্ধ করে অন্ধকারে ধ্যান করতেন। এমনি একদিন দরজা চে বন্ধ করতে
ভুলে গেছেন, অন্ধকার ঘরে খাটের উপর রব ।( বসে
ধ্যান করছেন সুভাষচন্দ্র, অন্যদিকে বিছানা পাততে ড্র এসে অন্ধকারে সুভাষকে ওইভাবে বসে থাকতে দেখে ভয়ে চিৎকার করে ওঠে বাড়ির কাজের লোক। চিৎকার শুনে বাড়ির সকলে দৌড়ে এলেন, সবকিছু জানতে পারলেন, অনেকে হাসাহাসি করলেন। সব শুনে বাবা
জানকীনাথ বসু কিছু বললেন না, কিন্তু মা প্রভাবতীদেবী
সিঁদুরে
মেঘ দেখলেন। তবে এতে পুত্র সুভাষেরই কি যতো দোষ!
মা প্রভাবতীদেবী কি পথ দেখাননি
! কারণ একবার যখন ছাত্র সুভাষ র্যাভেনশ স্কুলে পড়ছেন, বালক ছাত্র সুভাষের তখনও সেবাদল তৈরি হয়নি, সেসময় স্কুল-মেসে মঙ্গল মাঝি নামে এক ছাত্র নিওমোনিয়ায়
আক্রান্ত হয়। কেউ দেখার নেই, অবহেলা অযন্তে ছেলেটির প্রাণ যায় যায় অবস্থা। কথাটা যেভাবে হোক সুভাষের মা'য়ের কানে
যায়, আর সাথে সাথে
তিনি পৌঁছে যান অসুস্থ ছেলেটির কাছে। মা নিজের কোলে
বাইরে অন্য ছাত্রদের ভিড়, ব্যাপারটা দেখে মেসের অন্য সকল ছাত্র অনুশোচনায় লজ্জিত হতে থাকে। অসুস্থকে সেবার মাধ্যমে চরম শিক্ষা দিলেন প্রভাবতীদেবী। বাড়ি থেকে পুত্র সুভাষ'ও চলে এলেন
ছাত্র-মেসে, বললেন, "তুমি যাও মা, এরকম ভুল আমাদের আর কখনও হবে
না।" তাহলে মা নিজে প্রেরণাদাত্রী
হয়ে এখন চিন্তা করলে চলবে কি করে! আসলে
পুত্র সুভাষের ধীরে ধীরে মনোভাবের পরিবর্তন, ধর্ম বিষয়ে পুত্রের অত্যধিক আগ্রহ .. এই বয়সেই সুভাষের
উদাস হাবভাব তাঁর মনে ভয় ধরায় ..তার উপর আবার এই 'ধ্যান' অভ্যাস.. ফলে মা পরিস্কার বলে
দিলেন - ধ্যান বন্ধ। কিন্তু সেই সাথে মা এও জানতেন,
তাঁর ছেলে সুভাষ বড় একরোখা.. মনে জেদ খুব.. একবার কোন কিছু করবে বলে চিন্তা করলে হাজার বারন সত্ত্বেও সে সেই কাজটাই
করবে। কাজেই সুভাষের ধ্যান বন্ধ হ'ল না,
দিনের মধ্যে একবার সময় ঠিক হতে লাগল.. যে অভ্যাস আজীবন
রয়ে গেল.. সুভাষচন্দ্র বসু থেকে 'নেতাজী' হয়েও। প্রখ্যাত সাহিত্যিক শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় বলেছেন, "শ্রীরামকৃষ্ণ প্রতিফলিত বিবেকানন্দে, আর বিবেকানন্দ প্রতিফলিত
সুভাষচন্দ্রে।" ছাত্র অবস্থায় শিক্ষক বেণীমাধব দাসের শিক্ষা এবং ক্ষুদিরাম বসুর ফাঁসি - যে প্রচণ্ড নাড়া
দিয়েছিল তাঁর বালক-মন'কে, সেই
সূত্র ধরেই পরবর্তীকালে সুভাষচন্দ্র বসুর জীবনে প্রেরণা
হয়ে
উঠলেন তাঁর ভাবগুরু স্বামী বিবেকানন্দ, আর স্বামীজীর পথ
ধরে তাঁর জীবনে পথপ্রদর্শক হয়ে বৃ এলেন আরো
ছয়-জন - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ভগিনী নিবেদিতা, অরবিন্দ ঘোষ, বাঘাযতীন যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, রাসবিহারী বসু এবং চিত্তরঞ্জন দাশ। আবার ১৯২১ সালের জুন মাসের পরে ভারতবর্ষের সকল মুক্তিকামী বিপ্লবীর 'প্রেরণা' হয়ে উঠলেন তিনি নিজে - সুভাষচন্দ্র বসু। ১৯৪১-এর পরে সুভাষচন্দ্র
বসু হয়ে উঠলেন সকলের আশা ভারতবর্ষের ছাত্র-যুব-শ্রমিক-কৃষক সংগঠন আন্দোলনের পথিকৃৎ, প্রথম জাতীয় পরিকল্পনার পথপ্রদর্শক, অখণ্ড ভারতবর্ষের ভারতীয় জাতীয় বাহিনীর সর্বাধিনায়ক, অখণ্ড ভারতবর্ষের প্রথম সশস্ত্র নারী সৈন্য বাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা, ভারতবর্ষের ধর্ম নিরপেক্ষতার প্রতীক, অখণ্ড ভারতবর্ষের প্রথম প্রধানমন্ত্রী - আমাদের দেশনায়ক নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু।
তথ্যসূত্র :
বিবিধ প্রবন্ধ - নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু;
বিপ্লবী সুভাষচন্দ্র - শ্যামদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রফুল্লরঞ্জন বসু রায়;
সবার প্রিয় সুভাষ - সুধাংশুরঞ্জন ঘোষ;
জয়তু নেতাজী - মতিলাল মজুমদার; নেতাজী - গোপাল ভৌমিক;
আত্মচরিত - আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়; নেতাজির মা - ড. জয়ন্ত চৌধুরী; ক্ষমা করো সুভাষ - ড. জয়ন্ত চৌধুরী; নেতাজী সুভাষচন্দ্র - বিশ্ব বিশ্বাস
সুভাষ দর্পণে বিশ্বরূপ - দেবেশচন্দ্র রায়; সুভাষ মনন সন্ধানে - ক্ষণেশ্বর ঘোষাল; সুভাষচন্দ্র ও নেতাজী সুভাষচন্দ্র - সাবিত্রীপ্রসন্ন চট্টোপাধ্যায়; সুভাষের সঙ্গে বারো বছর - হেমন্তকুমার সরকার; সপ্ন ও সাধনা - সমর গুহ।
"এই দুঃখসঙ্কুল
বেদনাপূর্ণ নরলোকে আমরা আনন্দ-সাগরের বান ডাকিয়া আনিব। আশা, উৎসাহ, ত্যাগ ও বীর্য
লইয়া আমরা আসিয়াছি। আমরা আসিয়াছি সৃষ্টি করিতে, কারণ: সৃষ্টির মধ্যেই আনন্দ। তনু,
মন-প্রাণ, বুদ্ধি ঢালিয়া দিয়া আমরা সৃষ্টি করিব। নিজের মধ্যে যাহা কিছু সত্য, যাহা
কিছু সুন্দর, যাহা কিছু শিব আছে - তাহা আমরা সৃষ্ট পদার্থের মধ্যে ফুটাইয়া তুলিব।
আত্মদানের মধ্যে যে আনন্দ, সে আনন্দে আমরা বিভোর হইব, সেই আনন্দের আস্বাদ পাইয়া পৃথিবীও
ধন্য হইবে। কিন্তু আমাদের দেওয়ার শেষ নাই, কর্মেরও শেষ নাই, কারণ –
যত দেব প্রাণ
বহে যাবে
প্রাণ ফুরাবে
না আর প্রাণ
এত কথা আছে
এত গান আছে
এত প্রাণ
আছে মোর
এত সুখ আছে, এত সাধ আছে
প্রাণ হয়ে
আছে ভোর।
" -
নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু জয় হিন্দ্ জয়তু নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু
নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর চরণে আমাদের কোটি কোটি প্রণাম,
শ্রদ্ধা ও হৃদয়ের অকৃত্রিম ভালোবাসার পুম্পাঞ্জলি
জয় হিন্দ্
সোমনাথ_সিংহ
(রাজ্য সরকার সেচ্ দপ্তর কর্মী)
(কালিকাপুর ১নং, সোনারপুর, দক্ষিণ ২৪ পরগণা)