#বেগম
রোকেয়া : এক নারীবাদী লেখিকার
গল্প
( পর্ব - ১ )
একজন
স্বপ্ন দেখেছিলেন , স্বপ্ন দেখেছিলেন পুরুষরা নয় মেয়েরাই উদ্ভাবন করেছে সৌরচুল্লি । এই স্বপ্নের
কথা সবিস্তারে বলা হলো একটি বইটিতে , বইটির নাম 'সুলতানার
স্বপ্ন ' । গত শতাব্দীর
সূচনায় অর্থাৎ বিংশ শতাব্দীর শুরুতে মেয়েরা যখন খুব নগন্য সংখ্যায় লেখাপড়া শিখছে , ঘরকন্নার বাইরে গিয়ে খোলা পৃথিবীতে কাজ করছে , সেইরকম সময় ' সুলতানার স্বপ্ন ' বইটিতে বলা হলো এক আজব রাজত্বের
কথা । সেই রাজত্বে
পুরুষরা থাকে ঘরের কাজে আর মেয়েরা করে
অফিসের কাজ , রাজ্য চালানোর কাজ । 'সুলতানার
স্বপ্ন ' বইটিতে এমন উল্টো রাজত্বের স্বপ্ন দেখেছিলেন কে , স্বপ্ন দেখেছিলেন একজন প্রগতিশীল মুসলিম মহিলা , তার নাম বেগম রোকেয়া ।
এখন প্রশ্ন হলো তিনি কেনো এমন উল্টো রাজত্বের স্বপ্ন দেখেছিলেন । আসলে
তিনি দেখেছিলেন সমাজে আদিযুগ থেকে এমন একটা ব্যাবস্থা রাজ করছে যেখানে মেয়েরা থাকে ছেলেদের অধীনে । ছেলেরা যা
বলে মেয়েদের সেইভাবে চলতে হয় , সমাজের যাবতীয় একতরফা নিয়ম তৈরি করে ছেলেরা । ছেলেরা মেয়েদের
বেঁধে রেখেছে , আর সেই বাঁধনের
দাগ যেনো কেটে বসেছে মেয়েদের মনে। বেগম রোকেয়া মেয়েদের মন থেকে সেই
বাঁধনের দাগ মুছে ফেলতে চেয়েছিলেন । সেই ইচ্ছে
থেকেই তাঁর যতো লেখা , তাঁর যতো কিছু কাজ । সুলতানার স্বপ্ন
বইটি তাঁর তেমনই এক প্রয়াস ।
যে প্রয়াসের মধ্য দিয়ে তিনি মেয়েদের জন্য মুক্তির এক আকাশ তৈরী
করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন ।
বেগম রোকেয়ার ডাক নাম ছিল রকু , তিনি ছিলেন পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে চতুর্থ জন । বাবার
নাম আলী হায়দার সাবের , মা ছিলেন রহাতুন্নেসা
চৌধুরী । বাংলাদেশের রংপুর
জেলার পাইরাবন গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত জমিদার
পরিবারে বেগম রোকেয়া ১৮৮০ সালে ৯ই ডিসেম্বর জন্ম
গ্রহণ করেছিলেন । সেসময় খানদানি
মুসলমান বাড়ির মেয়েদের অন্তত একটি ভাষা শিখতেই হতো , সেটি ছিল আরবী ভাষা কারণ কোরান পড়ার জন্য আরবী শেখাটা জরুরী ছিল । তবে আরবীর
পাশাপাশি খানদানি মুসলমানের ভাষা হিসাবে উর্দু ও ফার্সি শেখার
ক্ষেত্রে কোনও বারণ ছিলো না । কিন্তু বাংলা যেহেতু সাধারণ মানুষের ভাষা , সেইজন্য খানদানি মুসলমান বাড়ির মেয়েদের কাছে ছিল সম্পূর্ন নিষিদ্ধ । অন্যদিকে ইংরেজি
ভাষার শেখার তো কোনো প্রশ্নই
ওঠে না , সেতো বিদেশিদের ভাষা ।
বেগম রোকেয়ার দিদি করিমুন্নেসার ছিল ভাষা শেখার প্রবল আগ্রহ । করিমুন্নেসা মাটিতে
দাগ কেটে কেটেই বর্ণমালা শিখে ফেলেছিলেন । লুকিয়ে লুকিয়ে
বটতলার পুঁথিও পড়েছিলেন । এই দিদির
কাছ থেকেই বেগম রোকেয়ার বাংলা ভাষার প্রথম বর্ণপরিচয় ঘটে , অবশ্যই লুকিয়ে লুকিয়ে । একদিকে যেমন
পরিবারের নিষেধ না মেনে রোকেয়াকে
বাংলা শিখিয়েছিলেন দিদি করিমুন্নেসা , তেমনই পরিবারের নিষেধ না মেনে রোকেয়াকে
ইংরেজি শিখিয়েছিলেন বড়ো দাদা ইব্রাহিম সাবের । অনেক যত্নে
অনেক ধৈর্যের সাথে
ছোট বোনটিকে যখন ইংরেজি শেখাতে শুরু করেছিলেন দাদা ইব্রাহিম সাবের , আত্মীয়দের নিন্দা সমালোচনার কোনো সীমা পরিসীমা ছিলো না । কিন্তু
সেই নিন্দা সমালোচনা শুনে দাদা পিছ পা হননি এতটুকু
। বেগম রোকেয়ারও উৎসাহে এতটুকু ভাটা পড়েনি । পরবর্তী কালে
আমরা দেখেছি তাঁর যে উপন্যাস
'পদ্মরাগ ' , পদ্মরাগ উপন্যাসটি তিনি দাদা ইব্রাহিম সাবেরের নামে উৎসর্গ করে লিখেছিলেন - ' আমি আশৈশব তোমার স্নেহ সাগরে ডুবিয়া আছি , আমাকে তুমিই হাতে গড়িয়া তুলেছো , আমি জানি না পিতা মাতা
গুরু শিক্ষক কেমন হয় , আমি কেবল তোমাকেই জানি ' । সত্যি কথা
বলতে বেগম রোকেয়া তাঁর জীবনে এমন এক দাদাকে পেয়েছিলেন
বলেই স্কুল কলেজে না যেতে পারলেও
সত্যিকারের শিক্ষা থেকে কখনও তিনি বঞ্চিত হননি ।
বেগম রোকেয়ার জীবনকে সার্থক হিসাবে গড়ে তুলতে আর একজন পুরুষের
ভূমিকা ছিল ভীষন উল্লেখযোগ্য । তিনি ছিলেন
তাঁর স্বামী সৈয়দ শাখাওয়াত হোসেন । তিনি অবাঙালি
ছিলেন , আগে একবার বিয়ে হয়েছিল তাঁর , মেয়েও আছে একটি প্রথম পক্ষের স্ত্রীর । প্রথম স্ত্রীর
মৃত্যুর পর তিনি বেগম
রোকেয়াকে বিয়ে করেন । বিয়ে যখন
হয় তখন রোকেয়ার বয়স ছিল ১৬ আর বরের
বয়স ছিল ৩৮ । অসম
বয়সের বরকনে হওয়া সত্বেও এই বিয়ে কিন্তু
রোকেয়ার জীবনে আশীর্বাদ হয়ে দেখা দিয়েছিল । সৈয়দ শাখাওয়াত
হোসেন ছিলেন ওড়িশার কণিকা স্টেটের ম্যানেজার । পাশ্চাত্য শিক্ষায়
শিক্ষিত শাখাওয়াত হোসেন , তিনি রোকেয়াকে পেয়েছিলেন এক উৎসুক ও
আগ্রহী শিষ্যা হিসাবে । তাই ইংরেজি
ভাষার চর্চায় স্বামীর সহযোগিতা পেয়ে রোকেয়া এতটাই উন্নতি করতে পেরেছিলেন যে স্বামীর সরকারি
কাজেও সহযোগিতা করতে সক্ষম হয়েছিলেন । স্বামীর যোগ্য
সঙ্গতে ইংরেজি পড়া আর লিখা দুইই
ভীষণ ভালো করে রপ্ত করেছিলেন রোকেয়া । দাদার কাছে
যে শিক্ষা তিনি লাভ করেছিলেন স্বামীর সহযোগিতা পেয়ে সেই শিক্ষার পুর্ন বিকাশ ঘটলো ।
জীবনে দু দু'বার মা হয়েছিলেন বেগম রোকেয়া । কিন্তু প্রথম মেয়েটির মৃত্যু হয় পাঁচ মাস বয়সে , আর দ্বিতীয় মেয়েটিরও মৃত্যু হয় মাত্র চার মাস বয়সে । দুর্ভাগ্যজনক ভাবে সন্তানহীন এই দম্পতি দুজনে দুজনেরই চিন্তাভাবনাকে ভাগ করে জীবন অতিবাহিত করেছিলেন । মাত্র ১৪ বছর দাম্পত্য জীবন ছিল বেগম রোকেয়ার । দীর্ঘ রোগ ভোগের পর ১৯০৯ সালের মার্চ মাসে শাখাওয়াত সাহেবের অকাল মৃত্যু হয় । একথা অনস্বীকার্য যে শাখাওয়াত সাহেবের আনুকূল্য পেয়েছিলেন বলেই বেগম রোকেয়া পরবর্তীকালে নারীমুক্তির আন্দোলনে এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক হয়ে উঠেছিলেন । বেগম রোকেয়ার নামের সাথে তাঁর স্বামীর নামেরও সমান মর্যদায় উচ্চারিত হয় আজও ।
( পর্ব - ২ )
স্বামী
সৈয়দ শাখাওয়াত হোসেন সাহেবের উদ্যোগে এবং উদ্দীপনায় ১৯০৫ সালে ইন্ডিয়ান লেডিজ ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয় বেগম রোকেয়ার প্রথম বই ' SULTANA'S DREAM ' । সেই
একই বছরে প্রকাশিত হয় তাঁর ' মতিচুর
' বইটির প্রথম খন্ড । এই সময়
তিনি তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস ' পদ্মরাগ
' - র প্রাথমিক খসড়া প্রস্তুত করেন । কিন্তু উপন্যাসটি
প্রকাশিত হয়েছিল অনেক পরে , ১৯২৪ সালে । তার কয়েক
বছর আগেই ১৯২১ সালে প্রকাশিত মতিচুর বইটির দ্বিতীয় খণ্ড । ১৯২৮ সালে
প্রকাশিত হলো তাঁর সবচেয়ে বিতর্কিত উপন্যাস ' অবরোধ বাসিনী ' । মাত্র এই
পাঁচটি বই আর তার
বাইরে ছড়ানো ছিটানো ছিল বাংলা ইংরেজি ভাষায় কবিতা , প্রবন্ধ , রচনা ইত্যাদি লেখা । হ্যাঁ , এ
কথা সত্যি যে তাঁর প্রকাশিত
লেখার পরিমাণ ছিল খুবই অল্প , কিন্তু শুধুমাত্র সেইটুকুর জন্যই অর্থাৎ তাঁর সামাজিক কাজের ক্ষেত্রটুকু যদি বাদ দেওয়া যায় , শুধুমাত্র লেখালেখির জন্যই তিনি নারীমুক্তির আন্দোলনের সম্ভবত প্রথম বাঙালি মহিলা হিসাবে স্বীকৃত হবেন ।
তিনি শুধু শিল্পের জন্য শিল্প করেননি , শৌখিনতার জন্য কাব্য করেননি । সবসময় তাঁর
লেখাতে রয়ে গেছে কোনো না কোনো বিষয়ে
তাঁর বলার কথা , তাঁর চিন্তা ভাবনার কথা । তিনি
তাঁর লেখার মাধ্যমে ধর্ম দেশ সমাজ শিক্ষা সব বিষয়ে তুলে
ধরেছিলেন তাঁর জোরালো বক্তব্য । জোরালো বক্তব্য
মানে গলা ফাটানো কোনো বক্তব্য বা স্বর সেখানে
পাওয়া যাবে না , তাঁর লেখনীতে তাঁর স্বরটি ছিল রঙ্গ-রসিকতার ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের । প্রকাশ ভঙ্গিটাও
ছিল অনবদ্য , প্রকাশ ভঙ্গিটা কখনও ছিল গল্পের ভঙ্গিতে , কখনও সংলাপের ভঙ্গি , আবার কখনও মনোগ্রাহী নকশার ভঙ্গিতে তিনি তাঁর লেখনীতে নিজের বক্তব্য ফুটিয়ে তুলেছেন ।
এ প্রসঙ্গে আমি
বলতে চাই বেগম রোকেয়ার অনেক আগেই কৈলাস বাসিনী দেবী কিংবা কৃষ্ণ ভাবিনী দাস প্রমুখ অনেক মহিলাই কিন্তু সমাজে মেয়েদের দুরবস্থা নিয়ে লেখালেখি করেছেন । কিন্তু বেগম
রোকেয়া যখন হাতে কলম তুলে নিলেন , সকলে চমকে গেলেন , সবাই লক্ষ্য করলেন বেগম রোকেয়া সমাজের শরীরে ক্রমাগত যেন চাবুক মেরে চলেছেন । বাঙালিদের প্রতি
, মুসলমানদের প্রতি , মেয়েদের প্রতি , সমাজের প্রতি তাঁর ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের ভাষা প্রয়োগ এতটাই তীক্ষ্ণ , এতটাই তীব্র ছিল যে লেখার মাধ্যমে
তিনি যা বলতে চাইছেন
তা সরাসরি সকলের একেবারে বুকে গেঁথে গেছিল । ফলস্বরূপ
যা হবার তাই হলো , তাঁর বিরুদ্ধে সমাজের নিন্দা-মন্দের ঝড় উঠলো । বিশেষ করে
গোঁড়া মুসলিমরা তাঁর বিরুদ্ধে ক্ষেপে উঠলো । সেই ঝড়
আজও অব্যাহত , বহুলোক আজও তাঁকে যাচ্ছেতাই ভাবে সমানে গালাগালি দিয়ে যাচ্ছেন ।
এবার একনজরে দেখি নিই তিনি তাঁর লেখার মাধ্যমে কি কি কথা
বলতে চেয়েছিলেন । প্রথমেই বলবো
তাঁর লেখায় অধিকাংশ সময় ধর্ম বিষয়টি প্রাসঙ্গিক ভাবে উঠে এসেছে । তাতে পরিষ্কার
দেখা যায় যে ধর্মের আধ্যাত্মিক
দিকটি শ্রদ্ধা করে এসেছেন আমরণ । ধর্ম আচরণগুলোও
কঠোর ভাবে পালন করতেন , পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ , রোজা , বাইরে সাদা শাড়ির উপর বোরখা , সভা সমিতিতে মাথায় ঘোমটা । অভিজাত মুসলমান
ঘরের একজন মেয়ে হিসাবে , অভিজাত মুসলমান ঘরের একজন বধূ হিসাবে তিনি ছিলেন একজন ধর্মনিষ্ঠ মানুষ । ইসলাম ধর্মের
উপর তাঁর ছিল অগাধ বিশ্বাস ও অসীম শ্রদ্ধা
। কিন্তু সে ধর্মের ব্যখ্যা
তিনি করতেন নিজের মনের আলো দিয়ে । তিনি বহুবার
বলেছেন ইসলাম ধর্ম মেয়েদের যত সম্মান দিয়েছে
, তা আর কোনো ধর্ম
দেয়নি ।
কিন্তু ধর্মের নাম দিয়ে সমাজে যেসব কুপ্রথা কিংবা আইনকানুন প্রচলিত আছে যা দিয়ে পুরুষপ্রধান
সমাজ মেয়েদের উপর নিষ্ঠুর অত্যাচার চালিয়ে আসছে সেই প্রাচীনকাল থেকে , তিনি
তার প্রবল সমালোচক ছিলেন । তিনি লিখেছেন
- ' মুনিদের বিধানে যে কথা শুনতে
পান , কোনো স্ত্রী-মুনির বিধানে হয়তো বিপরীত নিয়ম দেখতে পাইতেন ।' অর্থাৎ পুরুষরা
যদি বিধান না দিয়ে সেই
বিষয়ে মহিলারা বিধান দিতেন তাহলে সম্পূর্ন বিপরীত নিয়ম আজ দেখা যেত
। সত্যি কথা বলতে কি , সেযুগে একজন মহিলার কণ্ঠে এরকম সাহসী প্রতিবাদ ছিল অকল্পনীয় । মুসলমান
সমাজের পুরুষ প্রভুরা তাদের মনের মত বিধান দিয়ে
মেয়েদের যেভাবে পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ করে রেখেছে বেগম রোকেয়া তার বিরুদ্ধেই ছিলেন সোচ্চার এক কণ্ঠ ও
প্রতিবাদী চরিত্র ।
তাঁর ' দর্জাল ' প্রবন্ধটি পড়লে অথবা ' রসনা পূজা ' প্রবন্ধটি
পড়লে দেখা যায় বেগম রোকেয়া ধর্মনিষ্ঠ ছিলেন কিন্তু কখনওই ধর্মান্ধ ছিলেন না । বেগম
রোকেয়ার সবচেয়ে বিতর্কিত উপন্যাস হল ' অবরোধ বাসিনী ' । হিন্দু আর
মুসলমান , এই দুই সমাজের
মেয়েদের মধ্যে অবরোধ প্রথা , পর্দা প্রথার হাস্যকর বাড়াবাড়ির ছবি তিনি তাঁর এই বইটিতে তীক্ষ্ণ
বিদ্রুপের সাথে তুলে ধরেছেন । অবরোধ বাসিনী
র পাতায় পাতায় তিনি চুপ করে থাকা মেয়েদের জন্যে করেছেন তীক্ষ্ণ বিদ্রুপ , আর সেই বিদ্রুপের
তলায় তলায় ছড়িয়ে রেখেছেন পুরুষ প্রভুদের প্রতি তাঁর তীক্ষ্ণ শ্লেষ ।
এ প্রসঙ্গে উল্লেখ থাকা দরকার যে অবরোধ বাসিনী তে পর্দা প্রথার বিরুদ্ধে কলম তুলে নিলেও তিনি নিজে কিন্তু কঠোরভাবে পর্দা প্রথা পালন করতেন । অবশ্য বড়ো দুঃখের সাথে তিনি তাঁর লেখায় জানিয়েছেন - ' আমি যে অনিচ্ছাকৃত ভাবে অবরোধ বাসিনী হয়েছি , তার কারণ অনেক , আমার স্কুলটা আমার প্রাণের চেয়েও প্রিয় , একে বাঁচিয়ে রাখার জন্য সমাজের অযৌক্তিক নিয়ম - কানুনগুলো পালন করছি ... '।
( পর্ব - ৩ )
বেগম
রোকেয়ার সমসাময়িক সময়ে আরও অনেক লেখিকা মেয়েদের শিক্ষার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন , তখন মেয়েদের লেখালেখির প্রধান বিষয় ছিল নারীশিক্ষা । বেগম রোকেয়ার
অন্যতম মৌলিকত্ব ছিল এটাই যে তিনি শুধু
লেখালিখি করেই ক্ষান্ত ছিলেন না , মেয়েদের জন্য স্কুল তৈরি করার উদ্দেশ্যে তিনি নিজেই মাঠে নেমে পড়েছিলেন । বিদ্যাসাগর মেয়েদের
জন্য স্কুল তৈরী করলেও অধিকাংশ মুসলমান ঘরের মেয়েরা সেইসব স্কুলে পড়তে পারতো না , শুধুমাত্র পর্দা প্রথার জন্য । আর সেই
কঠিন কর্মযজ্ঞে সর্বস্ব পণ করে কাজে
নেমে পড়েছিলেন বেগম রোকেয়া ।
স্কুল বিষয়ে তাঁর কোনো ধারণায় ছিল না , শৈশবে বা কৈশোরে স্কুলে
পা দেওয়ার সৌভাগ্য তাঁর হয়নি । স্বামীর মৃত্যুর
পর ভাগলপুরে সেই তিনিই তৈরি করলেন মুসলিম মেয়েদের জন্য স্কুল । কিন্তু স্বামীর
প্রথম পক্ষের মেয়ে জামাইয়ের প্রবল বিরোধিতায় সেখানকার সাজানো গোছানো ঘরবাড়ি ছেড়ে ১৯১০ সালে কলকাতায় আশ্রয় নিলেন । পরের বছর
অর্থাৎ ১৯১১ সালের ১৬ই মার্চ ১৩ নম্বর ওয়ালিওয়াল্লাহ
লেনে তিনি শুরু করলেন মুসলিম মেয়েদের জন্য তাঁর স্বপ্নের স্কুল , স্কুলের নাম দিলেন ' শাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল ' । সেই স্কুল
তৈরি করার ইতিহাস পড়ে , সত্যি কথা বলতে কি , আমি স্তম্ভিত হয়ে গেছি । স্কুল তৈরির
ক্ষেত্রে পর্দা প্রথার প্রবল শক্তিশালী প্রতিবন্ধকতার লড়াই করে , আত্মীয় বন্ধুজনদের ষড়যন্ত্রকে মোকাবিলা করে , স্কুলের আর্থিক দুরবস্থাকে সামলাতে গিয়ে নিজের বইপত্র আসবাব বিক্রি করে , সর্বোপরি সমাজের রক্তচক্ষু , সমাজের কঠোর নিন্দাকে উপেক্ষা করে যে অসম্ভব নিরলস
প্রচেষ্টার মধ্যেদিয়ে তিনি মুসলিম মেয়েদের জন্য ' শাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল ' তৈরি করেছিলেন , সেই ইতিহাস এককথায় অবিশ্বাস্য ।
১৯১৬ সালের ১৬ই সেপ্টেম্বরে বেগম রোকেয়াকে লেখা একটি চিঠিতে সরোজিনী নাইডু বলেছেন - ' মুসলমান বালিকাদের শিক্ষা দেওয়ার জন্য প্রতিষ্ঠান করে এবং তাকে সুস্থভাবে পরিচালনা করে চলার কাজে আপনার নিষ্ঠা আপনার আত্মদানকে আমি কি গভীরভাবেই না
শ্রদ্ধা করি ... আহা ... দেশের কেন্দ্রে কেন্দ্রে আপনার স্কুলের মত এরকম স্কুলের
আমাদের কি দারুন প্রয়োজন
... ' । মেয়েদের
মঙ্গল কামনা যা কিনা সমাজের
মঙ্গল কামনারই আর এক নাম
, তারজন্য তিল তিল করে নিজেকে ক্ষয় করেছিলেন বেগম রোকেয়া । শেষপর্যন্ত তাঁর
সেই লড়াই ব্যর্থ হয়নি , তাঁর প্রতিষ্ঠিত সেই স্কুল আজ একটি আদর্শ
স্কুল হিসাবে দেশের বুকে সুপ্রতিষ্ঠিত ।
' শাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল ' বেগম রোকেয়ার আবেগ বা তাঁর স্বপ্নের
নাম হলেও , সমাজের দেশের বহু কাজের ক্ষেত্রে অসম্ভব ব্যস্ততার মাঝেও নিজেকে বেগম রোকেয়া প্রসারিত করেছিলেন । মেয়েদের মনকে
জাগ্রত করার উদ্দেশ্যে , মেয়েদেরকে সমাজ সময় সম্পর্কে সচেতন করে তোলার জন্য ১৯১৬ সালে মুসলিম মেয়েদের নিয়ে তিনি একটি সমিতি প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন । বাংলায় সেই
সমিতির নাম দিয়েছিলেন ' নিখিল বঙ্গ মুসলিম মহিলা সমিতি ' ।
১৯১৭ সালে কংগ্রেসের যে অধিবেশন হয়েছিল
, সেই অধিবেশনে সেচ্ছাসেবী মুসলিম মেয়েদের একটি দল নিয়ে বেগম
রোকেয়া সেখানে যোগদানও করেছিলেন । ১৯২২ সালে
লুৎফর রহমান 'নারীতীর্থ
' নামে একটি আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন , সেই আশ্রমের কার্যনির্বাহী সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছিলেন বেগম রোকেয়া । ১৯২৫ সালে
আলীগড় শিক্ষা কনফারেন্সে তাঁকে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল এবং তিনি সেখানে গিয়ে অসাধারণ এক বক্তৃতা দিয়েছিলেন
। ১৯২৬ সালে বেঙ্গল ওমেন কনফারেন্সে সভানেত্রী হিসাবে অনবদ্য ভাষণ উপস্থাপন করেন ।
দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে প্রত্যক্ষভাবে যোগদান না করলেও তিনি
তাঁর সাহিত্য সৃষ্টির মাধ্যমে দেশপ্রেম ও স্বদেশী চিন্তার
প্রসার ঘটিয়েছিলেন । তাঁর সময়ে
গান্ধীজির অসহযোগ আন্দোলন , গান্ধীজির চরকা আন্দোলন যখন একের পর এক ঢেউ
তুলছে , বেগম রোকেয়ার মত সজাগ মানুষ
তখন কিন্তু চুপ করে বসে থাকেননি । ইংরেজ
শাসকদের বিদ্রুপ করে তিনি লিখেছেন ' জ্ঞানফল ' নামে এক অসাধারণ রূপকধর্মী
রচনা । গান্ধীজির
স্বদেশী আন্দোলনে প্রভাবিত হয়ে তিনি লিখেছেন ' বলিতত্ব ' , ' সৃষ্টিতত্ব ' প্রভৃতি রচনা । বিপ্লবী কানাইলাল
দত্তের ফাঁসির আদেশ শোনার পর বেগম রোকেয়া
লিখেছিলেন - ' রাখিতে পরের পরান যে জন দেয়
নিজ বলিদান , সে কি বিচলিত
ফাঁসির আদেশে , মৃত্যু তুচ্ছজ্ঞান ... ' ।
রোকেয়া অলঙ্কারকে দাসত্বের প্রতীক বিবেচনা করেছেন এবং নারীদের অলঙ্কার ত্যাগ করে আত্মসম্মানবোধে উজ্জীবিত হয়ে আর্থরাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনে সচেষ্ট হতে আহ্বান জানিয়েছেন:-
'আমরা
বহুকাল হইতে দাসীপনা করিতে করিতে দাসীত্বে অভ্যস্ত হইয়া পড়িয়াছি। ক্রমে পুরুষরা আমাদের মনকে পর্য্যন্ত দাস করিয়া ফেলিয়াছে।... তাহারা ভূস্বামী গৃহস্বামী প্রভৃতি হইতে হইতে আমাদের "স্বামী" হইয়া উঠিয়াছেন।... আর এই যে
আমাদের অলঙ্কারগুলি– এগুলি দাসত্বের নিদর্শন। ... কারাগারে বন্দিগণ লৌহনির্ম্মিত বেড়ী পরে, আমরা স্বর্ণ রৌপ্যের বেড়ী পরিয়া বলি "মল পরিয়াছি। উহাদের
হাতকড়ী লৌহনির্ম্মিত, আমাদের হাতকড়ী স্বর্ণ বা রৌপ্যনির্ম্মিত "চুড়ি!"... অশ্ব হস্তী
প্রভৃতি পশু লৌহশৃঙ্খলে আবদ্ধ থাকে, সেইরূপ আমরা স্বর্ণশৃঙ্খলে কণ্ঠ শোভিত করিয়া বলি "হার পরিয়াছি!" গো-স্বামী বলদের
নাসিকা বিদ্ধ করিয়া "নাকা দড়ী" পরায়, আমাদের স্বামী আমাদের নাকে "নোলক" পরাইয়াছেন। অতএব দেখিলে ভগিনি, আমাদের ঐ বহুমূল্য অলঙ্কারগুলি
দাসত্বের নিদর্শন ব্যতীত আর কিছুই নহে!
... অভ্যাসের কি অপার মহিমা!
দাসত্বে অভ্যাস হইয়াছে বলিয়া দাসত্বসূচক গহনাও ভালো লাগে। অহিফেন তিক্ত হইলেও আফিংচির অতি প্রিয় সামগ্রী। মাদক দ্রব্যে যতই সর্বনাশ হউক না কেন, মাতাল
তাহা ছাড়িতে চাহে না। সেইরূপ আমরা অঙ্গে দাসত্বের নিদর্শন ধারণ করিয়াও আপনাকে গৌরবান্বিতা মনে করি। ... হিন্দুমতে সধবা স্ত্রীলোকের কেশকর্ত্তন নিষিদ্ধ কেন? সধবানারীর স্বামী ক্রুদ্ধ হইলে স্ত্রীর সুদীর্ঘ কুম্ভলদাম হস্তে জড়াইয়া ধরিয়া উত্তম মধ্যম দিতে পারিবে। ... ধিক আমাদিগকে!আমরা আশৈশব এই চুলের কত
যত্ন করি! কি চমৎকার সৌন্দর্য্যজ্ঞান
... !'
আসলে বেগম রোকেয়া ছিলেন তাঁর সময়ের থেকে অনেক বেশি এগিয়ে । সমসাময়িক অনেকের
চাইতে অনেকটা আলাদা । হৃদয়ের সবটুকু
ভালোবাসা দিয়ে তিনি মেয়েদের ভেতরের শক্তিতে বলীয়ান হয়ে এক
আহ্বান জানিয়েছিলেন । জীবনের শেষদিন
পর্যন্ত কর্মযজ্ঞের সমুদ্রে আপাদমস্তক নিমজ্জিত ছিলেন বেগম রোকেয়া । জীবনের শেষরাতে
বহুক্ষণ পর্যন্ত স্কুলের ফাইল দেখেছেন তিনি , টেবিলে পড়েছিল তালাক নিয়ে অসমাপ্ত তাঁর বিতর্কিত লেখা । ১৯৩২ সালের
৯ই ডিসেম্বর বেগম রোকেয়ার জন্মদিন , সেইদিনই ভোরে অল্পসময়ে অসুস্থতার পরেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন নারীস্বাধীনতার লক্ষ্যে নিরলস এক কর্মী বেগম
রোকেয়া । মৃত্যুর সময়
তাঁর বয়স ছিল মাত্র ৫২ বছর ।
একজন ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীকে ধর্মবিরোধী হতে হবে এর কোনো মানে
নেই , অর্থাৎ মনেপ্রাণে ধর্মিক হয়েও বেগম রোকেয়া এক ধর্মনিরপক্ষ ব্যক্তিত্ব
। তাঁর সংগ্রাম ছিল ধর্মের গোঁড়ামির বিরুদ্ধে , ধর্মের বিরুদ্ধে কখনওই নয় । লেখিকা হিসাবে
বেগম রোকেয়াকে বাঙালি যতটা না মনে রাখবে
, তারচেয়ে অনেক বেশি মনে রাখবে তাঁর কাজকে । তিনি মনে
করতেন শিক্ষা ছাড়া নারীর কোনো মুক্তি নেই , তাই তিনি নারীর শিক্ষার উপর বেশি জোর দিয়েছিলেন , বোরখা পরে আসুক , ঘোমটা পরে আসুক তবুও আসুক তারা স্কুলে , এটাই ছিল তাঁর ব্রত । এককথায় বলা
যেতে পারে বেগম রোকেয়া বাংলার মাদার টেরিজা । নারী স্বাধীনতার
মুখ , নারী আন্দোলনের অগ্রদূত , নারী শিক্ষার
কান্ডারী , একজন সমাজসংস্কারক , নারীবাদী লেখিকা বেগম রোকেয়াকে বাঙালি কোনদিনই ভুলবে না , ভুলতে পারে না ।
( সমাপ্ত )
#সৈয়দ
সওকাত হোসেন