দেব উত্থান। দেব- দেবীদের ইতিহাস।দেব উত্থান একাদশী

(দেব উত্থান একাদশী উপলক্ষে আপনাদের সবাইকে জানাই আমার আন্তরিক অভিনন্দন।)

প্রবন্ধ :- "তুলসী দেবৈ নমঃ নমঃ"

 ডঃ .গোপাল চন্দ্র মুখার্জী

             

  " যত্র নার্য্যস্তু পূজ্যন্তে রমন্তে তত্ৰ দেবতাঃ"

                      (মনুসংহিতা)

                           *****

            আদি শক্তিই নারী। আধার স্বরূপা মহাশক্তি , মহালক্ষী ,মহাসরস্বতী। সৃস্টি স্থিতি বিনাশানাম শক্তিভুতে সনাতনী ! সুধামৃত সিঞ্চিত করে সন্তান তথা সৃষ্টির পালনকর্তী। নারীই জগৎপ্রসূতা জননী।

আদি অন্তকাল থেকে সংসারকে তথা ত্রিভুবনকে সমস্ত আপদ বিপদ থেকে সর্বদা রক্ষাকর্তী একমাত্র আদিশক্তি মহামায়া , তিনিও "নারী"

      আশ্চর্যের বিষয় এটা যে পুরুষ প্রধান বা পুরুষ শাসিত বিশ্ব সংসারকে সমস্ত সন্তানগণকে লালন পালন করে প্রাণপ্রবাহকে অক্ষুন্ন রেখে চলে অতি সংকটকালে যিনি রক্ষা করেন , তিনি "নারী "

 সৃষ্টিকে ধ্বংস থেকে রক্ষাকর্তী মহাশক্তি মহামায়া চন্ডী ,দুর্গা ,কালী ,ধনধান্য প্রদায়িনী লক্ষ্মী , জ্ঞান বিদ্যা প্রদায়িনী সরস্বতী এবং প্রানের জন্মদাত্রী - ধাত্রী সকলেই তদর্থে স্ত্রী বা নারী। এইজন্যই বিশ্বে সকল ধর্মে নারীর এক মহত্বপূর্ণ এবং সুউচ্চস্থান নির্ধারিত হয়েছে। সর্বজন পূজ্যা।সর্ব ধর্মগ্রন্থে এটাও মান্য যে -

" যেখানে নারীর সম্মান আছে , সেখানে সকল দেবতা নিবাস করেন "! শৌর্য - বীর্য , ধন - ধান্য , সুখ - সমৃদ্ধি ,যশ - কীর্তি সব সেখানে বিরাজিত থাকে। সব কিছুর মূলে কিন্তু "নারী"

   শুধু এটাই নয় , নারীর গুণের সৌজন্যে যেমন সৃষ্টির প্রগতির সর্বাঙ্গীন বিকাশ হয় সেরকম বিশ্বে বিধ্বংসী যুদ্ধের কারণ কিন্তু নারীই !

        আজ দেবউত্থান একাদশী এবং তুলসী পূজার বিশেষ তিথি। তুলসী একটি গাছ মাত্র কিন্তু মাতৃরূপে সর্বত্র পূজ্যা। তুলসী বিনা সর্বপূজা বিফল বা নিষ্ফল হয়। ঈশ্বরের ভোগ নিবেদন হয় না। এই তুলসীও নারী !

   পুরানোক্ত কাহিনী অনুসারে এটা সর্বজ্ঞাত  - যেমন তুলসী কে ? কি মাহত্বের জন্য ইনি পূজ্যা ? ইত্যাদি ইত্যাদি।

      তাই আমি তুলসী মাতাকে প্রণাম নিবেদন করে অতি সংক্ষেপে এই কিছু তথ্য নিবেদন করতে চাই।

 অসুরকুলে জন্ম হওয়া সত্যেও আপনার পবিত্রতা এবং পরম নিষ্ঠার জন্য হে মাতা তুলসী দেবী আপনি সর্বত্র পূজ্যা। আপনাকে দর্শনমাত্রই সর্বত্র পবিত্র- শুভ হয়ে সর্ব পাপের বিনাশ হয়। হে , সর্বগুনসম্পন্নন্না পরমা সুন্দরী মহাবলী অসুররাজ জলন্ধরের স্ত্রী , আপনারই পবিত্রতা এবং সতীত্বের কারণে অসুররাজা জলন্ধর দীর্ঘায়ুপ্রাপ্ত করে মহাবলী হয়ে রাজত্ব করেছিল। অহংকারে অন্ধ হয়ে পরাক্রমী অসুররাজা জলন্ধরের ত্রিভুনে রাজত্ব করার বাসনা জাগে , শুরু হয় দেবাসুরে প্রলঙ্কর যুদ্ধ। বীর বিক্রমে অসুর রাজ দেবতাদের থেকেও পরাক্রমশালী হওয়ায় দেবতাদের অবশ্যম্ভাবী পরাজয় নিশ্চিত জেনে দেবতাগণ দেবতাদের অন্তিম আশ্রয় তারণহার সৃষ্টির রচয়িতা শ্রী বিষ্ণুর সর্ব শক্তিমান নারায়ণের কাছে উপস্থিত হয়ে অসুর রাজার পরাক্রম এবং যুদ্ধের বিবরণ নিবেদন করলেন। সঙ্গে সঙ্গে এও জানালেন যে অসুররাজা জলন্ধরের স্ত্রী পরমসতী তুলসী দেবীর পতিব্রতা এবং পতির সুরক্ষিত দীর্ঘায়ু কামনায় ব্রতের কথা। সেই কারণেই অসুররাজা মহাবলী এবং সুরক্ষিত অবিনাশী। সবকথা শোনার পর পরমেশ্বর নারায়ণ শ্রী বিষ্ণু চিন্তা করলেন যে যতক্ষণ পর্যন্ত সতী তুলসী দেবীর পবিত্রতা বা সতীত্ব হানি না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত জলন্ধরের বিনাশ অসম্ভব। অতএব নারায়ণ শ্রী বিষ্ণু যুদ্ধরত অসুররাজা জলন্ধরের ছদ্মবেশ ধারণ করে পরম সতী স্বামীর দীর্ঘায়ু এবং সুরক্ষার্থে ব্রতরতা তুলসীদেবীর সম্মুখে উপস্থিত হলেন। সতী তুলসী দেবী যুদ্ধরত অসুররাজার ভ্রমে ব্রতভঙ্গ করে জলন্ধরের ছদ্মবেশে উপস্থিত শ্রী বিষ্ণুর চরণ স্পর্শ করে প্রণাম করলেন। পরপুরুষ স্পর্শ এবং ব্রত অপূর্ণ হওয়ায় তুলসী দেবীর পবিত্রতার স্খলিত হল এবং অখন্ড সতীত্ব খন্ডিত হলো। সেই মুহূর্তেই দেবতাগণ যুদ্ধরত অসুররাজা জলন্ধরের মস্তক ছিন্ন করলেন এবং তুলসীদেবীর সম্মুখে নিক্ষেপ করলেন। তৎক্ষণাৎ দেবী তুলসী জলন্ধরের ছদ্মবেশধারী শ্রী বিষ্ণু নারায়ণকে চিনতে পেরে শিলা হবার অভিশাপ দিলেন। এই কারণেই শ্রী বিষ্ণু নারায়ণকে শালগ্রাম শিলায় পরিবর্তিত হতে হল। তুলসীদেবী অসুররাজা জলন্ধরের ছিন্নমস্তক নিজের কোলে নিয়ে স্বামীর জ্বলন্ত চিতায় প্রবেশ করে পুনঃ সতীত্ব লাভ করলেন। চিতাভস্মে এক গাছের আবির্ভাব হলো এবং সেই গাছই পরে তুলসীগাছ হিসেবে পরিচিত হলো বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডে। শ্রী বিষ্ণু নারায়ণ তুলসীদেবীকে বরদান দিলেন যে নারায়ণ পূজা এবং ভোগ নিবেদনে তুলসী অনিবার্য হবে নচেৎ উক্ত পূজার্চনা অশুদ্ধ হয়ে সর্বপ্রকারে ফলহীন হবে।

          তুলসী শাপিত শালগ্রাম শিলারূপী নারায়ণ শ্রী বিষ্ণু কার্তিক একাদশীর পুণ্যলগ্নে তুলসীদেবীকে প্রিয়পত্নীর সম্মান দিয়ে স্বীকার করে তুলসীদেবীর মান রাখলেন।

 হে দেবী ,আপনি সর্ব ঊষধিসম্পন্না সর্বসুখপ্রদায়নি , চিরযৌবনবতী দিব্যপ্রভাসম্পন্না সর্বদেবতা এবং জগতপূজ্যা নারায়ণপ্রিয়ে সুশ্রী মহারাণী।

   হে বৃন্দে ,পরম নিষ্ঠাবতী সতী আপনার গুনগান করে দেবতা এবং ঋষিগণ স্তবগান করেন :-

 " ধ্যায়েৎ দেবীম নবশশীমুখীম পক্কবিম্বাধরোষ্ঠিম।

   বিদ্যোৎ অন্তিম কুচযুগভরানম্রকল্পনাঙ্গ ষষ্টিম।।

   ঈষদধ্যাসোল্লসিতবদনাম চন্দ্রসূর্যাগ্নিনেত্রাম।

   শ্বেতাঙ্গিম তামময় বরদাম শ্বেতপদ্মাসনস্থাম।।"

      ওঁ নমঃ ভগবতী তুলসী দেবৈ নমঃ নমঃ।।


Post a Comment