দারিদ্র
ও স্বাধীনতা
মন্মথ হালদার
দারিদ্র
স্বাধীনতার প্রথম ও প্রধান শত্রু।বিত্তবানের
স্বাধীনতা বিত্তহীনের স্বাধীনতাকে অনিবার্যভাবে হরণ করে।যে প্রাকৃতিক নিয়মে শক্তিহীন মেষশাবক শক্তিমান সিংহের শিকার হয় ,সেই বাঁধাবন্ধহীন প্রকৃতির নিয়ম মনুষ্য সমাজে চলতে
দিলে বিত্তহীনেরা ও বিত্তবানদের শিকার
হয়ে পড়ে।
সিংহ
মেষশাবকের স্বাধীনতা অরণ্যের প্রাকৃতিক অবস্থায় যে রকম,বিত্তবান
ও বিত্তহীনদের অনিয়ন্ত্রিত
সমান স্বাধীনতা ও মনুষ্য
সমাজে ঠিক সেই রকম।
যে
বুভূক্ষু মানুষ দুইবেলা অন্ন সংস্থানের চেষ্টায় জীবন অতিবাহিত করতে বাধ্য হয়,নিজের
এবং নিজের সন্তান সন্ততির জন্য ন্যুনতম বাসস্থান,পরিচ্ছদ ,চিকিৎসা ও শিক্ষা ব্যবস্থা যার নাগালের বাইরে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা
তত্ত্বের মূল্য তার কাছে
কতটুকু?দারিদ্র এবং শোষণের পটভূমিতে স্বাধীনতার উন্মেষ কদাপি সম্ভব নয়।শোষক বিত্তবান মহাজনের কাছে প্রার্থী হিসিবে তাকে দাঁড়াতে হয় ।আর সে
ক্ষেত্রে বিত্তবান মহাজন পাইথনের মতই শোষণের বেষ্টনীর সংখ্যা এবং চাপের তীব্রতা বৃদ্ধি করতে করতে এক সময় দরিদ্রের
শেষ নিঃশ্বাসটুকু ও কেড়ে নেয়।
মনুবাদী
দার্শনিক এবং অন্যান্য
ধর্মের ধর্মবেত্তারা অন্তরের স্বাধীনতার তত্ত্ব প্রচার করে থাকেন,তাঁদের মতে ঐশ্বরিক প্রেরণার উদ্বুদ্ধ মানুষের ব্যবহারিক জীবনের
চাহিদা নিবৃত্ত হয় এবং অথবা
অন্তরের ইচ্ছাশক্তিতে বলীয়ান হয়ে যিনি পৃথিবীকে অগ্ৰাহ্য করতে শিখেছেন
তিনি সতত এবং সর্বত্র স্বাধীন ।তিনি সাম্রাজ্যবাদী শাষনে,স্বৈরাচারী রাষ্ট্রব্যবস্থায় ,অসম ও দুর্নীতিগ্ৰস্থ সমাজে
,দারিদ্রে,কারাগারে এমনকি মৃত্যুর মুখে ও স্বাধীন।সুতরাং অন্তরের
স্বাধীনতা মনুষ্য সমাজের আদর্শ
হওয়া উচিত।
অন্তরের
স্বাধীনতার তত্ত্ব বড়জোর আংশিক নিবৃত্তি মাত্র,কারণ পৃথিবীতে জীবন ধারণের জন্য অন্নজল
,বস্ত্র,বাসস্থান প্রভৃতি জৈবিক চাহিদাগুলি পূরণের জন্য কর্মরত
মানুষের দয়ার দানের উপর তাদের বিশ্বাস করা ছাড়া উপায় থাকে না।তখন পৃথিবীর সবকিছু মায়া,সবকিছু মিথ্যা এই চিরাচরিত প্রবচন
ত্যাগ করে পৃথিবীর অন্নজল গ্ৰহন করতে বাধ্য হতে হয়
এবং সে জন্য
সদুদ্দেশে দানের মাধ্যমে অর্থ সদ্ব্যবহার তত্ত্ব অনুগামীদের কাছে আবেগে প্রচার করতে হয়,সুতরাং বিত্তহীন
অনুগামীদের অবহেলা এবং বিত্তবান অনুগামীদের প্রতি বিশেষ মর্যাদা দিতে বাধ্য হন।ইদানীংকালের রামরহিম
বাবা,আশারাম বাবা,নিত্যানন্দ বাবা প্রভৃতি যৌন বাবাদের কাছে বর্তমান সরকারের কর্ণধরগন যে ভক্তির পরাকাষ্টা
দেখিয়েছেন তা কারো অবিদিত
নয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে বর্তমান ভারতে
ধর্মনিরপেক্ষতা সংবিধানের লিপিবদ্ধ একটি শব্দ মাত্র।আসলে ভারত শাসিত হচ্ছে একটি উগ্ৰ হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের অংগুলি হেলনে।এই সংগঠনগুলি আধাত্মমার্গের দোহাই দিয়ে নিবৃত্তিমার্গের তত্ত্বে মানুষকে সমাজের প্রতি তার নৈতিক দায়িত্ব অস্বীকার করতে প্ররোচিত করে।প্রকৃতপক্ষে অন্তরের স্বাধীনতার অর্থ সমস্ত দায়দায়িত্ব থেকে পলায়নপরতার নামমাত্র।ইহা মনুষ্য সমাজ থেকে
পলাতক এক নৈতিক আসামী
এবং আক্ষরিক অর্থেই এক অসামাজিক জীব।
একটি
মাত্র ক্ষেত্রে বিত্তহীনদের কিছুটা স্বাধীনতা ঐতিহাসিক কাল থেকে বিদ্যমান,তা হল ধর্মীয়
স্বাধীনতা।নিম্নবর্গের
মানুষের অনেক মন্দিরে প্রবেশাধিকার নেই।হিন্দুদের মনুস্মৃতি মতে নারীরা পাপশীল,অপবিত্র,সংসারের অবৈতনিক দাসী এবং সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র মাত্র,তাদের ও অনেক মন্দিরে
প্রবেশাধিকার নেই।মুসলিম,খৃষ্টান,বৌদ্ধ,ইহুদী প্রভৃতি ধর্মে নারীদের সমাজে হীন স্থানংক নির্ধারিত হয়েছে। ইরাক,ইরাণ সিরিয়া এবং অধুনা আফগানিস্তানের নারীদের আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক,সাংস্কৃতিক অবস্থান তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। বিস্তৃত বিবরণের মধ্যে যাচ্ছি
না।বিত্তহীন মানুষদের ধর্মে কিছুটা স্বাধীনতা দেওয়ার উদ্দেশ্য হল যাতে
তারা স্বীয় নিঃস্বতা এবং দাসত্ব ঈশ্বরের বিধান বলে মেনে নিতে বাধ্য হয়।এভাবেই সমাজে
শোষণভিত্তিক আর্থিক ও সামাজিক কাঠামোকে
চিরায়ত করা যায়।
কার্ল মার্কসের একটা উক্তি দিয়ে এ নিবন্ধ শেষ করব।"উৎপাদনের উপকরণের উপর এবং উৎপাদন ব্যবস্থার উপর সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠিত নাহলে রাজনৈতিক তথা সামাজিক ক্ষেত্রে স্বাধীনতা ও সাম্যের প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়।শান্তিপূর্ণ উপায়ে এ পরিবর্তন সম্ভব নয় বলে ,তিনি সশস্ত্র শ্রেনী সংগ্ৰামের মাধ্যমে পূঁজিবাদী ব্যবস্থার বিলোপ এবং সর্বহারার একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠার তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করেন।