রামায়ণের পূর্বকথা
পৃথিবীতে
কয়েকটি মহাকাব্য আছে। রামায়ণ, মহাভারত, ইলিয়ড ও ওডিসি। তন্মধ্যে
ইলিয়ড ও ওডিসি গ্রিক
কবি হোমারের লেখা। বৃহৎ মহাকাব্য মহাভারত কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসের সংস্কৃত ভাষাতে লেখা। রামায়ণ মহাকাব্য সংস্কৃত ভাষাতে মহাকবি বাল্মিকী রচনা করেছিলেন। বাঙালি জনগণের সুবিধার্থে আজ থেকে প্রায়
৬৫০ বৎসর পূর্বে নবদ্বীপের নিকটস্থ ফুলিয়াতে জন্মগ্রহণ করে কৃত্তিবাস ওঝা বাংলা ভাষায় রামায়ণ রচনা করে আপামর বাঙালির কাছে সুখপাঠ্য হিসাবে উপস্থাপন করেছিলেন। আমরা সেই কৃত্তিবাস ওঝার লেখা রামায়ণের গল্প কথা পূর্ব পুরুষদের কাছ থেকে শুনেছি।
রামায়ণ
মহাকাব্যের ঘটনা আজ থেকে হাজার
হাজার বৎসর পূর্বের ঘটনা। যদিও সঠিক সময় নিরূপণ করা দুরূহ, কিন্তু রামায়ণ মহাকাব্যে সরস্বতী নদীর উল্লেখ আছে যে সরস্বতী নদী
আজ থেকে নয় হাজার বৎসর পূর্বে প্রবাহিত ছিল বলে গবেষকেরা উল্লেখ করেছেন। তাহলে দেখা যাচ্ছে গবেষকদের মতে রামায়ণের ঘটনাবলী আজ থেকে নয়
হাজার বৎসরেরও পূর্বে ঘটেছিল। পৌরাণিক ইতিবৃত্ত অনুযায়ী বেদে উল্লেখ আছে চার যুগের কথা - সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর ও কলিযুগ। শ্রীমদ্ভাগবতে
উল্লেখ আছে বৈদিক শাস্ত্র অনুসারে বর্তমানে কলিযুগে চলছে। এই কলিযুগের মাত্র
৫০০০ বৎসর অতিক্রান্ত হয়েছে। তার পূর্বে ছিল দ্বাপর যুগ। দ্বাপর যুগের শেষ লগ্নে মহাভারতের যুদ্ধ হয়েছিল যা গবেষকদের মতে
সঠিক। এই দ্বাপর যুগের
স্থায়িত্ব ছিল আট লক্ষ চৌষট্টি
হাজার বৎসর। তার পূর্বে ত্রেতা যুগের স্থায়িত্ব ছিল ১২ লক্ষ ৯৬
হাজার বৎসর। যদি তর্কের খাতিরে ধরে নিয়ে ত্রেতা যুগের মধ্যবর্তী সময়ে রামায়ণের ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল তাহলে আজ থেকে ১৭
লক্ষ ৩৩ হাজার বৎসর
পূর্বে রামায়ণের কাল। তারও পূর্বে মহাকবি বাল্মিকী রামায়ণ মহাকাব্য রচনা করেছিলেন। সেই হিসেবে বলা যায় পৃথিবীর সর্ব প্রাচীন মহাকাব্য রামায়ণ। রামায়ণ শব্দটি দু'ভাগে বিভক্ত
রাম এবং আয়ন। রাম শব্দের অর্থ শুদ্ধ,সত্ত্ব স্বরূপ নয়ন মনোহর ব্যক্তি এবং আয়ন শব্দটির অর্থ গমনপথ। অর্থাৎ এক কথায় শুদ্ধ,সত্ত্বস্বরূপ নয়ন মনোহর ব্যাক্তির ভ্রমণপথ। এই ব্যাখ্যা দেওয়া
হয়েছে মহাভারতে, আবার অথর্ববেদে রাম শব্দটির অর্থ বলা হয়েছে অন্ধকার বা রাত্রি। উপরের
ঘটনাটি মুখবন্ধ বা উপক্রমণিকা। আমাদের
আলোচনার বিষয় মহাকাব্য রামায়ণ রচনার পশ্চাদপট।
একদা
গোলোকে নারায়ন লক্ষ্মী দেবীর সাথে লীলা করবার ইচ্ছায় চারি অংশে নিজের রূপকে বিভাজিত করে মর্ত্যভূমিতে অবতীর্ণ হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করে চারি রূপ ধারণ করে অধিষ্ঠিত হলেন - শ্রী রাম, লক্ষণ, ভরত ও শত্রুঘ্ন এবং
লক্ষীদেবী সীতাদেবী রূপে প্রকটিত হলেন। শ্রীরাম সিংহাসনে আসীন, বামপার্শ্বে সীতাদেবী, মস্তকে ছত্র ধারণ করে লক্ষণ এবং ভরত শত্রুঘ্ন চামর ব্যাজন করতে লাগলেন। এই সময়ে দেবর্ষি
নারদ সেখানে উপস্থিত হয়ে ভগবান নারায়নের এই রূপ দেখে
ভাবে বিভোর হয়ে নারায়ণের লীলা রহস্য উদ্ঘাটনের চেষ্টা করলেন। নারায়ণের এই রূপ লীলার
রহস্য উপলব্ধি করতে না পেরে তিনি
সৃষ্টির রূপকার ব্রম্ভার নিকটে যেয়ে ভগবান বিষ্ণুর এইরূপ লীলার কথা ব্যক্ত করে তার রহস্য জানতে চাইলেন। ব্রম্ভাও এই লীলার রহস্য
ভেদ করতে না পেরে উভয়ে
কৈলাস শিখরে যেখানে মহাদেব ও পার্বতী আসীন
সেখানে যেয়ে নারায়ণের এই রূপ লীলার
কথা ব্যক্ত করে জানতে চাইলেন - কেন নারায়ণ এইরূপে লীলা প্রকাশ করেছেন। তাদের প্রশ্নের উত্তরে মহাদেব বললেন "ষাট হাজার বৎসর পরে ভগবান বিষ্ণু এইরূপে ধরাধামে অবতীর্ণ হয়ে ধরিত্রীকে পাপী, তাপী, অসুরের হাত থেকে মুক্ত করবেন। ষাট হাজার বৎসর পরে বিশ্বশ্রবা মুনির পুত্র রাক্ষসরাজ রাবনের অত্যাচারে যখন স্বর্গমর্ত্য প্রকম্পিত হবে তখন নারায়ন ও লক্ষীদেবী এইরূপে
অবতীর্ণ হয়ে রাবণকে বিনাশ করবেন। কোন মহাপাপী রাম নাম উচ্চারণ করলে পাপমুক্ত হয়ে স্বর্গে গমন করবে"। মহাদেব আরো
বললেন "চ্যবন মুণির পুত্র দস্যু রত্নাকরে পরিনত হয়ে এক গভীর জঙ্গলে
বিচরণ করছে"।
মহাদেবের
কাছে এই কথা শুনে
ব্রহ্মা ও নারদ উভয়ে
পৃথিবীতে এসে এইরূপ মহাপাপীর সন্ধান করতে যেয়ে ঘন দুর্ভেদ্য এক
জঙ্গলের মধ্যে তারা প্রবেশ করলেন। সেই গভীর জঙ্গলের এক সুউচ্চ বৃক্ষ
শাখাতে বসে দস্যু রত্নাকর চারিদিকে নিরীক্ষণ করত। কোন পথিক সেই জঙ্গলে প্রবেশ করলে তার সর্বস্ব লুট করে সে তার জীবিকা
নির্বাহ করতো। ব্রম্ভা ও নারদকে দূর
থেকে দেখতে পেয়ে রত্নাকরের মনে খুব আনন্দ হল কারণ সেদিন
তখনও পর্যন্ত সে কোন পথিককে
দেখতে পায়নি। ব্রহ্মা ও নারদ যে
মুহূর্তে সেই বৃক্ষের কাছে এলেন দস্যু রত্নাকর গাছের উপর থেকে নেমে এসে তাদের পথরোধ করে তাদের কাছে যা আছে সব
দিতে বললো। ব্রহ্মা ও নারদ বললেন
তাদের কাছে পরিধেয় বস্ত্র ও কমন্ডলু ছাড়া
আর কিছু নাই। রত্নাকর তাদের বিশ্বাস না করে ব্রহ্মাকে
হত্যা করার উদ্দেশ্যে যে মুহুর্তে তার
হাতের মুদ্গর তুলতে গেল সেই মুহূর্তে তার হাত অবশ হয়ে গেল এবং মুদ্গর তুলতে পারল না। ব্রম্ভা ও নারদ তখন
তাকে জিজ্ঞেস করলেন তার পরিচয় এবং কেন সে দস্যুবৃত্তি অবলম্বন
করেছে? তার উত্তরে রত্নাকর তার নাম বলার পরে বলল "বাড়িতে তার বৃদ্ধ বাবা ও মা আছে,
এছাড়াও তার স্ত্রী পুত্র আছে। তাদের ভরণপোষণের জন্য সে দস্যুবৃত্তি অবলম্বন
করেছে।" তখন তাঁরা তাকে প্রশ্ন করলেন "তুমি যে এই পাপ
কাজ করছো এর ভাগ বা
দায়িত্ব কি তোমার বাবা-মা বা স্ত্রী-পুত্র নেবে?" রত্নাকর তার উত্তরে বলল "অবশ্যই তারা আমার পাপের ভাগ নেবে, কারণ তাদের ভরণপোষণের জন্যই তো আমাকে দস্যুবৃত্তি
অবলম্বন করতে হয়েছে।"ব্রম্ভা তখন বললেন "বেশ তুমি বাড়িতে যেয়ে প্রত্যেককে জিজ্ঞেস করে এসে বল কে তোমার
পাপের ভাগ নেবে"। রত্নাকর তার
উত্তরে বলল "যে মুহূর্তে আমি
জিজ্ঞেস করতে যাব তোমরা তখনই পালিয়ে যাবে। অতএব তোমাদের কথায় ভুল করে আমি বাড়ি যাব না। তোমাদের পরিধেয় বস্ত্র ও কমন্ডলু আমাকে
দাও"। ব্রহ্মা বললেন
"আমরা এই বৃক্ষ তলে
উপবেশন করছি, তুমি নিশ্চিন্ত মনে বাড়ী গিয়ে জিজ্ঞেস করে এসো"। রত্নাকর তখন
তাদেরকে সেই গাছের সাথে বনের লতা দিয়ে শক্ত করে বেঁধে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলো। বাড়িতে যেয়ে প্রথমে সে তার বৃদ্ধ
বাবা ও মাকে জিজ্ঞেস
করল "তোমাদের ভরণপোষণের জন্য প্রত্যহ আমি যে পাপ করছি
তোমরা তার ভাগ নেবে তো?" উত্তর তার বাবা-মা বললেন "জন্ম
থেকে তোমাকে আমরা লালন পালন করেছি আজ আমরা বয়সের
ভারে অশক্ত, এখন তোমার দায়িত্ব আমাদের ভরণপোষণ করানোর। তোমার পাপের ভাগ আমরা নেব না।" এরপর সে তার স্ত্রী
ও পুত্রের কাছে যেতে তার স্ত্রী বলল "স্বামীর কর্তব্য স্ত্রীর ভরণ পোষণের দায়িত্ব নেওয়া, তুমি তোমার কর্তব্য পালন করছো, এর জন্য তোমার
পাপের ভাগ আমি কেন নেব?" পুত্র বলল "যতদিন না পুত্র সাবালক
হচ্ছে ততদিন পর্যন্ত পিতার কর্তব্য সন্তানের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব নেওয়া। আমি তোমার পাপের ভাগ কেন নেব?" সকলের কাছে প্রত্যাখ্যাত হয়ে দস্যু রত্নাকর জঙ্গলে এসে ক্ষোভে, দুঃখে সেই মুণিদের চরণে প্রণাম জানিয়ে বললো "কেহই আমার পাপের ভাগ নিতে রাজি নয়। প্রভু, আপনারা বলুন আমি পাপ থেকে কিভাবে মুক্ত হব?" ব্রম্ভা তখন তাকে একটি পুষ্করিণী দেখিয়ে বললেন "তুমি ওই পুষ্করিনী থেকে
স্নান করে এখানে এসে বস। কিন্তু রত্নাকর এ পর্যন্ত জীবনে
যে পরিমাণ পাপ করেছিল তার ফলে যখন সে পুষ্করিণীর তীরে
গেল স্নান করার উদ্দেশ্যে তাকে দেখে সেই মুহূর্তে পুষ্করিণীর জল বাষ্প হয়ে
উড়ে গেল। জল না পেয়ে
রত্নাকর ব্রহ্মাকে এসে বলার পরে ব্রম্ভা তাঁর কমন্ডলুর জল ছিটিয়ে রত্নাকরকে
শুদ্ধ করে তাকে সেই বৃক্ষতলে উপবেশন করিয়ে 'রাম' 'রাম' নাম উচ্চারণ করতে বললেন। রত্নাকর ঘোরতর পাপী হওয়াতে কোনভাবেই 'রাম' 'রাম' শব্দগুলি উচ্চারণ করতে পারলেন না। ব্রম্ভা তখন নিকটস্থ একটি বৃক্ষকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলেন গাছটিতে কেন সবুজ পাতার সঞ্চার হয় নি। তার উত্তরে রত্নাকর বললেন "গাছটি মরা"। এই কথা
শুনে ব্রহ্মা বললেন "তুমি 'মরা' 'মরা' শব্দগুলি উচ্চারণ করো। 'মরা' 'মরা' বলতে বলতে রত্নাকরের রামরাম উচ্চারণ হতে থাকলো। তখন ব্রম্ভা রত্নাকরকে আদেশ দিলেন পুনরায় তাঁরা এইস্থানে ততদিন পর্যন্ত না আসছেন ততদিন
পর্যন্ত সে যেন এই
আসনে বসে এইভাবে 'রাম' নাম জপ করতে থাকে।
এই কথা বলে ব্রহ্মা ও নারদ স্বর্গ
অভিমুখে গমন করলেন।
দিনের
পর দিন, রাতের পর রাত, মাসের
পর মাস, বৎসরের পর বৎসর অতিক্রম
করে প্রায় ষাট হাজার বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেল। স্বর্গে একদিন ব্রম্ভার মনে পড়ে গেল দস্যু রত্নাকরকে একদা রাম নাম জপ করতে বলে
চলে এসেছিলেন। মর্ত্যধামে দস্যু রত্নাকরকে দেখে আসার ইচ্ছা প্রকাশ করে তিনি নারদকে নিয়ে সেই গভীর জঙ্গলে এসে চারিদিকে খুঁজতে লাগলেন। কিন্তু কোথাও রত্নাকরকে দেখতে না পেয়ে যখন
তাঁরা হতাশ হয়ে গেলেন সেই সময় তাঁরা এক বৃক্ষের তলদেশ
থেকে ক্ষীণস্বরে রামনাম শব্দ শুনতে পেয়ে গিয়ে দেখলেন সেখানে এক বল্মীক ঢিবির
ভেতর থেকে এই আওয়াজ বের
হচ্ছে। মনে হল এই আওয়াজ
নিশ্চয়ই সেই রত্নাকরের গলার স্বর। ব্রম্ভা তখন দেবরাজ ইন্দ্রকে আদেশ দিলেন সেই স্থানে সাতদিন ক্রমাগত বারিধারা বর্ষনের জন্য। সাত দিনের পরে উইয়ের ঢিবি থেকে সমস্ত উইপোকা বেরিয়ে যাবার পরে দেখা গেল অস্থিচর্মসার একটি কঙ্কালের থেকে ক্ষীণস্বরে 'রাম' নাম আওয়াজ বের হচ্ছে। ব্রম্মা রত্নাকরের নাম ধরে ডাকতে রত্নাকর সাড়া দিলেন। রত্নাকরের পাপ থেকে মুক্ত হওয়ার একনিষ্ঠতা দেখে ব্রহ্মা তাকে আশীর্বাদ করে বললেন "বল্মীক ঢিবি থেকে তোমার পুনর্জন্ম হলো বলে আজ থেকে তোমার
নাম হলো বাল্মিকী। তুমি 'রাম' নাম উচ্চারণ করে পাপ থেকে উদ্ধার পেলে। এরপরে ভগবান শ্রীরামচন্দ্র পৃথিবীতে জন্ম গ্রহণ করবেন এবং তুমিই তাঁর জীবন কাহিনী রচনা করবে যা রামায়ণ নামে
পরিচিত হবে। এই কথা শুনে
বাল্মিকী বললেন "প্রভু, সংস্কৃত শ্লোক কিভাবে রচনা করতে হয় জানিনা"। ব্রহ্মা বললেন
"স্বযং বিদ্যার অধিষ্ঠাত্রী দেবী সরস্বতী তোমার জিহ্বায় বসতি করে তোমাকে শ্লোক রচনা করতে সাহায্য করবেন"। এই কথা
বলে ব্রম্মা অন্তর্হিত হলেন।
এর
কিছুদিন পরে বাল্মিকী তমসা নদীর তীরে তপস্যারত ছিলেন। একদিন তিনি দেখলেন নিকটস্থ এক বৃক্ষশাখায় একজোড়া
ক্রৌঞ্চ পক্ষী সুখে আলাপনে রত, এমন সময় এক ব্যাধ শর
নিক্ষেপ করে পুরুষ ক্রৌঞ্চটিকে মেরে ফেলার পরে সেই ক্রৌঞ্চটি বাল্মীকির কোলের উপর এসে পড়ল। ক্রৌঞ্চের মৃত্যুতে স্ত্রী ক্রৌঞ্চটিকে সমবেদনা জানাতে বাল্মীকির মুখ থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে দুটি বাক্য উৎসারিত হলো। " মা নিষাদ প্রতিষ্ঠাং
ত্বমগমঃ শাশ্বতী সমাঃ। যৎ ক্রৌঞ্চমিথুনাদেকমবধীঃ কামমোহিতম্।।" অর্থাৎ রে
ব্যাধ, ভবিষ্যৎ জীবনের তুই শান্তি পাবি না, কারণ মিথুন রত অবস্থায় আজ
তুই ক্রৌঞ্চকে হত্যা করলি। শ্লোকটি বাল্মীকির মুখ দিয়ে উচ্চারিত হলেও তার অর্থ বুঝতে না পেরে তিনি
ভরদ্বাজ মুনির আশ্রমে গেলেন। এই সময় দেবর্ষি
নারদ সেখানে উপস্থিত হয়ে সেই শ্লোকের অর্থ বাল্মীকিকে বুঝিয়ে দিয়ে বললেন "তুমি এই ভাবে শ্লোক
রচনা করে রামায়ণ মহাকাব্য লেখা সমাপ্ত করবে। ভবিষ্যতে শ্রী রামচন্দ্রের জন্ম বৃত্তান্ত থেকে সীতা উদ্ধার করে অযোধ্যার রাজা হয়ে তাঁর স্বর্গে গমন পর্যন্ত সংক্ষেপে সমস্ত ঘটনা ব্যক্ত করলেন । নারদ এই
কথাগুলি বলে স্বর্গে চলে গেলেন। এরপরে বাল্মিকী মুনি ২৪হাজার সংস্কৃত শ্লোক সম্বলিত রামায়ণ মহাকাব্য রচনা করেছিলেন।
রামায়ণের
ঘটনাবলী ত্রেতা যুগে ঘটেছিল। এরপরে সমগ্র দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব
এশিয়াতে রামায়ণের ঘটনাবলী বহুল প্রচলিত। সমগ্র ভারত বর্ষ, নেপাল, বাংলাদেশ, কম্বোডিয়া, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইনস প্রভৃতি রাষ্ট্রে রামায়ণ মহাকাব্য ব্যাপকভাবে প্রচলিত হয়েছে এবং সেখানকার জনগণের জীবনে বিভিন্নভাবে পরিস্ফুট। ভারতবর্ষে বাল্মিকী রচিত রামায়ণ যেহেতু সংস্কৃত ভাষাতে লেখা সেইজন্য আপামর জনগণের কাছে তার বোধগম্য হয়নি। পরবর্তীকালে সেই জন্য প্রতিটি আঞ্চলিক ভাষায় রামায়ণ রচনা হয়েছে। তারমধ্যে মহাকবি তুলসীদাস রচিত 'রামচরিত মানস' উল্লেখযোগ্য। সমগ্র হিন্দিভাষী অঞ্চলে এই রামচরিত মানস
ব্যাপকভাবে প্রচারিত। এছাড়াও তামিল ভাষাতে রাম্বানের লেখা 'রামাবতারম্', তেলেগু ভাষাতে গোনা বুড্ডা রেড্ডির 'রঙ্গনাথ রামায়ণ', অসমীয়া ভাষাতে মাধব কান্ডালীর 'সপ্তকাণ্ড রামায়ণ', ওড়িয়া ভাষাতে সারলা দাসের লেখা 'বিলঙ্ক রামায়ণ' এবং বলরাম দাসের 'জগমোহন রামায়ণ', মারাঠি ভাষাতে সন্ত একনাথের লেখা 'ভাবার্থ রামায়ণ' এবং মালয়ালাম ভাষাতে থুনচাত্থু এঝুথাচানের লেখা 'আধ্যাত্ম রামায়ণ' উল্লেখযোগ্য। বাংলা ভাষাতে কৃত্তিবাস ওঝার লেখা 'কৃত্তিবাসী রামায়ণে'র কথা পূর্বেই
উল্লেখ করেছি।