বীর সন্ন্যাসী স্বামী
বিবেকানন্দ
সৌমিত্র মুখার্জী
একটি
যুগ আসে আবার একটি যুগ পাশ দিয়ে যায় চলে। এই যুগ পরিমন্ডলে
কিছু মানব- মহামানবের রূপ ধরে আমাদের দ্বারে এসে হাজির হন। যাদের ঋণ চোকাণো এই
সমাজের তথা এই মানবের কারও
পক্ষে তা আর সম্ভব
হয়ে ওঠে না। অসহায় মানব সম্পদ কে এক উচ্চস্তরে
উন্নীত করার ক্ষেত্রে তেমনই একজন বীরের জন্ম হয় উনিশ শতকের ছয়ের দশকের দৌড়গড়ায়। যাকে ছোটো বেলায় নরেন্দ্রনাথ দত্ত নামে সকলেই জানি।
এরপর যুগাবতার শ্রী শ্রী ঠাকুর রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের সান্নিধ্যে আসেন নরেন্দ্রনাথ দত্ত। এই বোধিবৃক্ষসমের দুয়ারে
এসেই নরেন্দ্রনাথ দত্ত নিজেরে এক অনিবচনীয় পরব্রহ্মের
সাথে মুখোমুখি হওয়ার স্বাদ আস্বাদন করেন। যে নরেন্দ্রনাথ দত্ত
জন্ম অবধি কোনো কিছুকে চোখে না দেখে কোনোভাবেই
বিশ্বাস করতেন না, সেও কিন্তু সময়ের মানদন্ডে সবকিছুই মেনে নিতে বাধ্য হয়ে পড়েন। পরে পরে নরেন্দ্রনাথ দত্ত হয়ে ওঠেন আমাদের ভারতবর্ষের হৃদয়,বীর সন্ন্যাসী স্বামী বিবেকানন্দ।এখানে থেমে থাকেনি তার জীবন, এগিয়ে যেতে থাকে এক এক করে
নির্দিষ্ট লক্ষ্যে। প্রথমে তিনি সমাজের ভন্ডামির বিরুদ্ধে লড়াই করে যান। পরবর্তীতে মানুষের আলসেমি,মানুষের চেতনা,মানুষের বোধকে জাগ্রত করতে ব্রতী হয়ে ওঠেন। তিনি নিজেকে কখনও দুর্বল ভাবতেন না,তাই তিনিও
দুর্বলদের সবল হবার কথা বলে গেছেন। তার আত্মবিশ্বাস ছিল শিকারী বাঘের মতো যাকে তিনি কোনো ভাবেই হারাতে দিতেন না। আত্মবিশ্বাস হীন মানব জাতিকে দিয়ে গেছেন বিশ্বাসের আগুন। যা আজও আমরা
পরখে পরখে অনুভব করে চলি। ভারতের মর্যাদা কে বিশ্ব স্তরে
পৌঁছে দেওয়ার একমাত্র কারিগর যদি কেউ হন তিনি হলেন
বীর সন্ন্যাসী স্বামী বিবেকানন্দ। যার উদাহরণ আমরা তার জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রদর্শন করে থাকি।তিনি পদব্রজে সমগ্ৰ ভারতবর্ষ ঘুরে বেড়ান, শুধু তাই নয় এবার তিনি ঝাপিয়ে পড়েন আমেরিকার বিশ্ব ধর্ম সন্মেলনে। যেখানে তাকে অবজ্ঞার দৃষ্টি দিয়ে দেখা হয়, তার কারণ ভারতের বুকে কেউ ওখানে গিয়ে বক্তব্য রাখতে পারে । যা নিয়ে
সবাই একটা দ্বিধা- দ্বন্দ্বের মধ্যে পড়ে যান, তবে শেষ মেষ সবাই কে মেনে নিতে
হয় ভারতের এই মহামানবের মুখ
নিসৃত বাণীকে। তারা বুঝতে পারে হিন্দু ধর্ম কি? ভারতের মাহাত্ম্যের গভীরতা কতোখানি।
পরে পরে স্বামী বিবেকানন্দ গঙ্গার তীরে বেলুড়ে একটি
ঠাকুর রামকৃষ্ণের মঠ স্থাপন করার কাজে
ব্রতী হয়ে যান। তবে তিনি এই মঠ নিজের
চোখে দেখে যেতে পারেননি। তার অকাল প্রয়াণ সেই স্বপ্নকে অধরা করে দেয়। তবুও বলতেই হয় স্বামী বিবেকানন্দ যা কিছু দিয়ে
গেছেন । তাকে যুগ
হতে যুগান্তরে বহন করে নিয়ে যাওয়া মানে তাকে ভালোবেসে তার সবকিছুই কাছে টেনে নেওয়া। আর আমাদের বেঁচে
থাকতে গেলে তাকে বুকের কাছে না নিলে পুরোপুরি
আমাদের বাঁচাও সম্ভব নয়।

স্বামী বিবেকানন্দ
স্বামী বিবেকানন্দ ভারতের একজন গৌরবময় সন্ত এবং সমাজ সংস্কারক। তাঁর জীবন ও আদর্শ সারা বিশ্বের মানুষের কাছে এক বিশাল অনুপ্রেরণার উৎস। ধর্ম, শিক্ষা, জাতি ও মানবতার সেবায় তিনি অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।
সূচনা
ভারতবর্ষ একটি মহৎ সংস্কৃতির দেশ, যেখানে যুগে যুগে জন্ম নিয়েছেন জগৎ বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব। তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন স্বামী বিবেকানন্দ। তাঁর জীবন ও দর্শন শুধু ভারত নয়, সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে রয়েছে। জাতি, ধর্ম এবং মানবিক উন্নতির জন্য তাঁর অবদান অনবদ্য।
জন্ম ও শৈশব
স্বামী বিবেকানন্দের জন্ম হয়েছিল ১৮৬৩ সালের ১২ জানুয়ারি কলকাতার সিমলায়। তাঁর বাল্য নাম ছিল নরেন্দ্রনাথ দত্ত। পিতা বিশ্বনাথ দত্ত ছিলেন এক প্রতিভাবান আইনজীবী এবং মা ভুবনেশ্বরী দেবী ছিলেন একজন ধর্মপ্রাণ নারী। ছোটবেলা থেকেই নরেন্দ্র ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী ও চঞ্চল। তাঁর মধ্যে কৌতূহল এবং ঈশ্বর চিন্তার প্রতি গভীর আকর্ষণ ছিল।
শিক্ষা জীবন
নরেন্দ্রনাথের শিক্ষা জীবনের সূচনা হয় তাঁর পরিবারের কাছেই। পরে তিনি মেট্রোপলিটন স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং স্কটিশচার্চ কলেজ থেকে বি.এ. পাশ করেন। শিক্ষাজীবনের শুরু থেকেই তাঁর মধ্যে দর্শন ও আধ্যাত্মিক চিন্তার প্রতি আকর্ষণ দেখা যায়। তাঁর ঈশ্বর বিষয়ক প্রশ্নের সমাধান হয় রামকৃষ্ণ পরমহংসের সংস্পর্শে আসার পর। রামকৃষ্ণের শিষ্য হয়ে তিনি আধ্যাত্মিক জীবনের পথে পা বাড়ান।
কর্মজীবন ও সমাজসেবা
সন্ন্যাস ধর্ম গ্রহণের পর নরেন্দ্রনাথ হন স্বামী বিবেকানন্দ। সন্ন্যাস গ্রহণের পর তিনি সারা ভারত ভ্রমণ করেন এবং দেশের মানুষের দুঃখ-কষ্ট কাছ থেকে অনুভব করেন। ১৮৯৩ সালে আমেরিকার শিকাগো শহরে বিশ্বধর্ম মহাসভায় তিনি হিন্দু ধর্মের প্রতিনিধিত্ব করেন। তাঁর বিখ্যাত বক্তৃতা “আমার প্রিয় ভাই ও বোনেরা” দিয়ে শুরু হয়, যা সারা বিশ্বের মানুষের মন ছুঁয়ে যায়। তাঁর বক্তৃতায় তিনি হিন্দুধর্মের সহিষ্ণুতা এবং সার্বজনীনতার বাণী তুলে ধরেন।
রামকৃষ্ণ মিশনের প্রতিষ্ঠা
দেশের মানুষের সেবা এবং আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য স্বামীজি “রামকৃষ্ণ মিশন” প্রতিষ্ঠা করেন। বেলুড় মঠের প্রতিষ্ঠা তাঁর অন্যতম বড় অবদান, যা আজও ধর্মীয় ও মানবিক শিক্ষার কেন্দ্র হিসেবে কাজ করে।
সাহিত্যকর্ম
স্বামী বিবেকানন্দের রচনা মানবতার মঙ্গল কামনায় ভরপুর। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলোর মধ্যে “প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য”, “বর্তমান ভারত”, “পরিব্রাজক” ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। তাঁর লেখায় যুবসমাজের প্রতি আহ্বান, জাতীয় চেতনার উন্মেষ এবং মানুষের নৈতিক উন্নতির বাণী প্রচারিত হয়েছে।
উপসংহার
স্বামী বিবেকানন্দ মাত্র ৩৯ বছর বয়সে, ১৯০২ সালের ৪ঠা জুলাই বেলুড় মঠে ধ্যানরত অবস্থায় ইহলোক ত্যাগ করেন। তবে তাঁর জীবন ও দর্শন আজও মানুষের মধ্যে নতুন উদ্দীপনা জাগায়। তিনি আমাদের দেখিয়েছেন মানব সেবার মধ্যেই ঈশ্বরের সেবা নিহিত।
স্বামী বিবেকানন্দ শুধু একজন সন্ন্যাসী ছিলেন না; তিনি ছিলেন এক আদর্শ সমাজ সংস্কারক, দার্শনিক এবং যুবসমাজের পথপ্রদর্শক। তাঁর জীবনকে অনুসরণ করলে আমাদের জীবনে পরিবর্তন আনতে পারি।