ময়নামতির ইতিকথা। ময়নামতির ইতিহাস।ময়নামতির নিদর্শন সমূহ

ময়নামতির ইতিকথা

সুজলা সুফলা  শস্য  শ্যামল আমাদের বাংলাদেশ। এদেশের পূর্ব প্রান্তে তিতাস, ডাকাতিয়া, গোমতী বিধৌত কুমিল্লা জেলা প্রাচীন ঐতিহাসিক তথ্যে ভরপুর। ষষ্ঠ শতাব্দী থেকে দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত মানুষের অক্লান্ত সাধনা চিন্তার ফলশ্রুতিতে গড়ে উঠেছে বহু প্রাচীন শিল্প ভাষ্কর্য সাহিত্যের উজ্জ্বল নিদর্শন।

শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বহু রাজবংশের উত্থান পতন ঘটেছে কুমিল্লার পাহাড়িয়া অঞ্চলে। এর একমাত্র সাক্ষ্য বহন করছে কুমিল্লা জেলার বহু প্রাচীন দালানকোঠা, শিলালিপি, লোকগাঁথা, রুপকথা ছড়ার ঐতিহাসিক পুস্তকাবলি। এসব প্রাচীন নির্দেশাবলীর প্রায় সবই ময়নামতি পাহাড়ে লুকিয়ে আছে যা কুমিল্লার ইতিহাসকে উজ্জ্বল করে সমগ্র বিশ্বে এক গৌরবোজ্জ্বল আসন দান করেছে। কুমিল্লা শহর থেকে প্রায় সাড়ে নয় কিলোমিটার পশ্চিমে, উত্তর দক্ষিণে প্রায় আঠারো কিলোমিটার দীর্ঘ লালমাটিযুক্ত যে পাহাড়টি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করছে, এর উত্তরাংশের নাম ময়নামতি আর দক্ষিণাংশের নাম লালমাই পাহাড়।

 স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, কিভাবে ময়নামতি নামের উদ্ভব হয়েছে? প্রাচীন ইতিহাস থেকে জানা যায়, খ্রীষ্টপূর্ব নবম দশম শতাব্দীতে চন্দ্রবংশীয় বৌদ্ধ রাজারা রাজত্ব করতেন সমতট ভূভাগে।চন্দ্রবংশীয় রাজাদের মধ্যে একজন প্রখ্যাত রাজা ছিলেন মানিকচন্দ্র।মুকুল বা মিহিরকুল নামক স্হানে তার রাজধানী ছিল।ঐতিহাসিকেরা মনে করেন, বর্তমান কুমিল্লা জেলার মেহারকুল পরগণাই মুকুল নামের অপভ্রংশ।

 সেই সময় মানিকচন্দ্রের সাথে মেহারকুলের রাজা তিলকচন্দ্রের কন্যা রাজকুমারী মদনাবতীর বিবাহ হয়। রানী মদনাবতী ছিলেন এক অসাধারণ মহিলা এবং নিজ ক্ষমতার বলে তিনি রাজ্যের সর্বেসর্বা হয়েছিলেন। প্রাচীন গীতিকাতে তার অসাধারন গুণের উল্লেখ রয়েছে।রানী মদনাবতী আধ্যাত্ম শক্তির অধিকারিণী ছিলেন। মর্মে প্রবাদ আছে যে, মদনাবতী এক পাহাড়ের গুহায় অদৃশ্য হয়ে যান এবং অধ্যবধি তিনি সেখানে অমরত্বের কঠোর সাধনায় রত আছেন। বিদূষী ধর্মপরায়ণ রানী মদনাবতীর নামানুসারে বর্তমান ময়নামতীর এরুপ নামকরণ করা হয়েছে। তবে যুগে যুগে নিয়ে যথেষ্ট মতভেদ রয়েছে।

যুগের পর যুগ ধরে কত রাজবংশের আবির্ভাব হয়েছে ময়নামতীর বুকে। ইতিহাসের অদ্ভুত রহস্যজনক অনেক কাহিনী জড়িয়ে রয়েছে ময়নামতির মাটিতে।রাজ্য শাসনের সাথে সাথে তাঁরা মানুষের জীবনের সৌন্দর্যবোধকে বাস্তবে রুপায়িত করার নিমিত্তে সৃষ্টি করেছিলেন সাহিত্য দর্শন, গড়ে তুলেছিলেন হৃদয়গ্রাহী অনেক শিলা ভাস্কর্য। বর্তমানে ময়নামতিতে আবিষ্কৃত বিভিন্ন রাজবংশের মহিমাযুক্ত তাম্রফলক মুদ্রা,প্রস্তরশিল্প, ধাতবশিল্প এবং মাটির ফলকে  খোদিত বাংলার লোকায়ত শিল্পগুলো তার যথার্থ সাক্ষ্য বহন করছে।

>          ময়নামতি যাদুঘরে সংরক্ষিত প্রাচীন স্বর্ণ রৌপ্যমুদ্রার প্রচলন ময়নামতির অর্থনৈতিক সম্মৃদ্ধির এক উজ্জ্বল স্বাক্ষর বহন করছে। ময়নামতির পার্শ্ববর্তী প্রতিটি গ্রাম নগরে এখনো অনেক স্মৃতিচিহ্ন জড়িয়ে রয়েছে। বিশিষ্ট পাহাড় মুড়ার মাঝে ময়নামতি পাহাড়, রুপকন্যার পাহাড়, ইটাখোলা পাহাড়, কোটবাড়ি পাহাড় উজিরপুরা পাহাড়, হাতীগাড়া পাহাড়, চন্ডীমুড়া বৈরাগীমুড়া, রুপবানমুড়া , খিলামুড়া, কুটিলামুড়া, ছাড়পত্রমুড়া অন্যতম।

> প্রাচীন ঐতিহ্যে ভরপুর ময়নামতির লালমাই পাহাড় ইতিহাসের স্মৃতি বুকে ধারণ করে মাথা উঁচু করে দাড়িয়ে আছে আজো। তথাকথিত প্রাচীন রোহিতগিরি বা বর্তমান লালমাইয়ের লালমাটির সাথে চন্দ্রবংশীয় বৌদ্ধ রাজাদের সুখ দুঃখ এবং শৌর্যবীর্য ওতপ্রোতভাবে জড়িত রয়েছে। লালমাই ময়নামতি পাহাড়ের মাঝে আনন্দরাজার প্রাসাদ দীঘি, ভোজরাজার দীঘি, শালবন রাজার দীঘির ঐতিহাসিক গুরুত্ব অনেক বেশী।

> ময়নামতি আজ ঐতিহাসিক স্হান হিসেবে সারা বিশ্বে স্হান দখল করে আছে। ময়নামতির দক্ষিণাংশে রয়েছে পল্লী উন্নয়ন একাডেমি, সামরিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, গবেষণাগার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিস্ঠান এবং ময়নামতি যাদুঘর।

> ময়নামতিতে প্রাপ্ত বিভিন্ন উপকরণ গুলো ইতিহাস রচনার ভিত্তিমূল হিসেবে ধরা যেতে পারে। প্রত্নতাত্ত্বিকগণ আরো তৎপর হয়ে খননকার্য চালালে আরো বস্তু নির্ভর তথ্য সংগ্রহ করার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে যা ভবিষ্যতে ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।


জাহানারা রেখা

প্রভাষক বাংলা

কাঁচকুড়া ডিগ্রি কলেজ

ঢাকা।

Post a Comment