মিলাদুন্নবী বনাম সীরাতুন্নবী বিতর্ক।সীরাতুন্নবী কি

 

মিলাদুন্নবী বনাম সীরাতুন্নবী বিতর্ক
 মোশাররফ হোসাইন সাগর 

বর্তমানে হিজরী বর্ষের রবিউল আউয়াল মাস চলছে। অনেকের মতে মাসেই দুনিয়াতে তাশরীফ এনেছিলেন বিশ্বমানবতার মুক্তির দূত আখেরী নবী এবং রাসূল হযরত মুহাম্মাদ মুস্তাফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।

কারো কারো মতে ১২ রবিউল আউয়াল তাঁর শুভজন্মদিন ধরে নিয়ে অনেকে এই দিনটিকে 'ঈদে মিলাদুন্নবী' হিসেবে ব্যাপক আয়োজন জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পালন করে থাকে। কেউবা তা পালন করে না। এই নিয়ে ফেসবুকজগতে চলছে তুমুল তর্ক-বিতর্ক, ঝগড়া-বিবাদ কাদা ছোড়াছুড়ি। এমনকি একদল আরেকদলকে 'কাফির-মুনাফিক' ফতুয়াও দিয়ে বসছে। নাউযুবিল্লাহ মিন যালিক!

কিন্তু কেউ কুরআন হাদিস থেকে দলিল-প্রমাণ তুলে ধরে 'ঈদে মিলাদুন্নবী' পালনের পক্ষে বা বিপক্ষে কিছু লিখছেন না, বলছেন না। যা বলছেন, লিখছেন সব- আবেগনির্ভর, জ্ঞাননির্ভর নয়।

ইসলামে আবেগনির্ভর কিছু বলার/লেখার সুযোগ নেই। যা-কিছু বলা হবে, লেখা হবে তা কুরআন হাদিসে থাকা দলিল-প্রমাণের ভিত্তিতে বলতে লিখতে হবে। সেহেতু এই বিষয়ে কুরআন হাদিস এবং অনেকগুলো নির্ভরযোগ্য এবং প্রামাণ্য সীরাতগ্রন্থ (নবীর জীবনী/জীবনচরিত) অধ্যয়নের মাধ্যমে লব্ধজ্ঞানের ভিত্তিতে কিছু লেখার প্রয়াস চালালাম। এটা মানা বা না মানা যার যার ইখতিয়ার।

অনেক ঘটনা বা বিষয় আছে যার গভীরে প্রবেশ করে বিচার-বিশ্লেষণ না করলে তার তাৎপর্য বা তা নিয়ে মতভেদ, মতপার্থক্য, তর্ক-বিতর্কের কারণ উদ্ঘাটন বা উপলব্ধি করা যায় না। 'মিলাদুন্নবী' 'সীরাতুন্নবী' এমনি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

পবিত্র আল-কুরআনের সূরা আল-আহযাবের ২১ নং আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেছেন : লাকাদ কানা লাকুম ফী রাসূলিল্লাহি উসওয়াতুন হাসানাহ।

অর্থ : রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনে তোমাদের জন্য সর্বোত্তম আদর্শ রয়েছে।

তাঁর চারিত্রিক গুণাবলি সম্পর্কে আল্লাহ তা'আলা ঘোষণা করেছেন: নিশ্চয়ই তুমি সুমহান চরিত্রের অধিকারী। (সূরা আল-কালাম : )

এছাড়াও কুরআনে মু'মিনদের উদ্দেশ্যে বারবার বলা হয়েছে : আতিউল্লাহ ওয়া আতিউর রাসূল....

অর্থাৎ তোমরা আনুগত্য করো আল্লাহর এবং অনুসরণ করো রাসূলের ...

নিজের সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্বয়ং বলেছেন : আমি উত্তম চরিত্রের পরিপূর্ণতা সাধনের জন্যই প্রেরিত হয়েছি। (মুসনাদে আহমাদ, মিশকাত)

কুরআন হাদিসের কথা ছাড়াও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইন্তেকালের পরে উম্মুল মু'মিনীন হযরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহাকে অনুরোধ করা হয়েছিল : তাঁর (রাসূলের) চরিত্র কেমন ছিল সেই সম্পর্কে আপনি কিছু বলুন।

হযরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা জবাবে বলেছিলেন : তোমরা কি কুরআন পড়োনি? কুরআন- তাঁর চরিত্র (অর্থাৎ কুরআনে যা করতে, যা বলতে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল তিনি তাই করেছেন বলেছেন, সেটাই তার জীবনচরিত)

কুরআর হাদিসের পরে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শ্রেষ্ঠত্ব, তাঁর সকল গুণাবলি স্বল্পকথায় বর্ণিত হয়েছে মহাকবি হযরত শেখ সাদী রাহমাতুল্লাহি আলাইহির রচিত মাত্র চার পঙক্তির কবিতায়। অবশ্য শেখ সাদী () এই কবিতার তিন পঙক্তি লিখে দিন-রাত বারবার শতবার চেষ্টা করেও যখন চতুর্থ পঙক্তিটি লিখতে ব্যর্থ হচ্ছিলেন তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একদিন স্বপ্নে দেখা দিয়ে তাঁকে চতুর্থ পঙক্তিটি নিজমুখে বলে বা মিলিয়ে দিয়ে গেছেন। সেই বিশ্ববিখ্যাত কবিতাটি হলো :

বালাগাল উলা বি কামালিহি,

কাশাফাদ্দুজা বি জামালিহি।

হাসুনাত জামিয়ু খিসালিহি,

সাল্লু আলায়হি ওয়া আলিহি।।

অর্থ : তিনি পৌঁছে গেছেন সর্বোচ্চ মর্যাদায় তাঁর সুমহান চরিত্রের দ্বারা।

বিদুরিত হয়েছে সকল অন্ধকার তাঁর সৌন্দর্যের ছটায়।

সম্মিলন ঘটেছে তাঁর মাঝে সকল উন্নত চরিত্রের।

পেশ করুন তাঁর প্রতি তাঁর সম্মানিত আহলে বাইতের প্রতি দরূদ সালাম।

সুতরাং একজন মানুষের খাঁটি মু'মিন বান্দাহ হওয়ার জন্য তাকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনাদর্শ (সীরাত) জানতে হবে, তাঁকে জীবনের প্রতিপদে অনুসরণ এবং সেই অনুযায়ী নিজের জীবন গঠন পরিচালনা করতে হবে। সেহেতু সীরাতুন্নবী নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা করাটা ফরযের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজ।

তবে এটা কোনো দিন-ক্ষণ দেখে নয়, সারাবছর এবং সারাজীবন অবিরত অবিরামভাবে করে যেতে হবে। মানুষের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত প্রতিটি কাজ সম্পাদনের আগে জানতে হবে সেই বিষয়ে রাসূল সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কর্মপন্থা বা নির্দেশনা কী ছিল।

'মিলাদুন্নবী' (নবীর জন্মবৃত্তান্ত) জানার জন্য, তাঁর জন্মদিনে সেটা নিয়ে আলোচনা করার জন্য কিংবা দিনটিকে কোনো জাঁকজমকপূর্ণ আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে পালন করার বিষয়ে কোনো নির্দেশ বা অনুমোদন কুরআন বা হাদিসে আসেনি। তবে এই বিষয়ে কোনো নিষেধাজ্ঞাও নেই।

কিন্তু দিনটিকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পালন করেননি। তাঁর ওফাতের পরে সাহাবীরা, তাবেঈনরা, তাবে তাবেঈনরাও কেউ পালন করেননি। সেহেতু 'মিলাদুন্নবী' পালনের পক্ষে শরয়ী কোনো দলিল নেই।

শরীয়তে যে কাজটি করার কোনো দলিল নেই, ধর্মীয় কাজ হিসেবে সওয়াবের নিয়তে সেই কাজটি করা সুস্পষ্টভাবে বিদ'আত। আর হাদিসের ভাষ্য অনুযায়ী 'বিদ'আত' হলো 'গুমরাহী' 'গুমরাহ' লোক কোনোদিন জান্নাতে প্রবেশাধিকার পাবে না। তবে জাহান্নামের দরজা তার জন্য অবারিত উন্মুক্ত। সেখানে যেতে কেউ তাকে নিষেধ করবে না, বাধাও দিবে না।

সবচেয়ে বড় কথা, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্মের মাস তারিখ কোনটি তা নিয়ে ইতিহাসবিদ সীরাতগ্রন্থের রচয়িতাদের মধ্যে ব্যাপক মতপার্থর্ক রয়েছে। সুতরাং রবিউল আউয়াল মাসে এবং ১২ তারিখে যে তাঁর জন্মদিন সেটা নিশ্চিতভাবে বলা যায় না।

উক্ত বিষয়ে আমার নিজস্ব মতামত : সারাবিশ্বের মানুষসহ আমরা কত দেশবরেণ্য বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিদের জন্মদিন জাঁকজমক আনন্দোৎসবপূর্ণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পালন করে থাকি। কিন্তু সেই দিনটা পালন করা বা না করা যার যার ইচ্ছাধীন।

'কেউ পালন করলে সে মহাপুর্ণ অর্জন করলো এবং কেউ পালন না করলে সে মহাপাপী হয়ে গেল' বলে আমরা কেউ মনে করি না। কাউকে 'কাফির' বা 'মুনাফিক' ফতুয়াও দেই না।

তেমনিভাবে আমাদের প্রাণপ্রিয় আখেরী নবী রাসূল হযরত মুহাম্মাদ মুস্তাফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কথিত জন্মদিনটাকে কোনো ইবাদাতের অংশ (ফরয, ওয়াযিব, সুন্নাত নফল) মনে না করে একটি 'মুবাহ' কাজ (কিন্তু ইসলামের মৌলিক নীতি-আদর্শের বিরোধী কোনো কাজ করা যাবে না) মনে করে যদি পালন করি এবং যারা তা পালন করে না তাদেরকে পাপী-গুনাহগার বা রাসূলের প্রতি প্রেম-ভালোবাসাহীন মনে না করি, তাহলে কোনো সমস্যা নেই। এতে যেমন সওয়াবও হবে না তেমনিভাবে গুনাহও হবে না। মাঝখান থেকে উভয় পক্ষ খুশি থাকবে এবং দ্বন্দ্ব-সংঘাতেও লিপ্ত হবে না।

উক্ত বিষয়ে কুরআন, হাদিস প্রামাণ্য সীরাতগ্রন্থ থেকে তথ্য, তত্ত্ব উপাত্তসহ আরও ব্যাপক আলোচনার দাবি রাখে। আল্লাহর মেহেরবানীতে আমি তা করতেও সক্ষম। কিন্তু তা কে পড়বে? ফেসবুকের পাঠবিমুখ পাঠকেরা? না, কখনোই নয়। সেহেতু এখানেই ইতি টানতে বাধ্য হলাম।

আশা করি আমার সংক্ষিপ্ত আলোচনার মাধ্যমে 'সীরাতুন্নবী' 'মিলাদুন্নবী' নিয়ে গোলকধাঁধায় ঘুরপাক খাওয়াদের বিভ্রান্তি কিছুটা হলেও দূর হবে। একদল আরেক দলের সাথে ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত হওয়া থেকে বিরত থাকবে। না হলে তাদের নসীব খারাপ।

পুনশ্চ : সাহাবীরা, তাবেঈনরা, তাবে তাবেঈনগণ কেউ 'ঈদে মিলাদুন্নবী' পালন বা উদযাপন করেননি। কিন্তু তাঁদের হুদয়-মনে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা-সম্মান প্রেম-ভালোবাসা আমাদের দেশের তথাকথিত আশেকে রাসূলদের চেয়ে কম ছিল?

মোটেই নয়। সুতরাং যারা 'মিলাদুন্নবী' মানে না বা পালন করে না তাদের সম্পর্কে আজেবাজে কথা বলা থেকে বিরত থাকুন।

যারা 'মিলাদুন্নবী' পালন করে তাদেরকেও গালাগালি করার কোনো যৌক্তিকতা নেই। তবে পারলে এই বিষয়ে তাদের সামনে সঠিক জ্ঞান শিক্ষাটা তুলে ধরুন। তাতেই হয়তো কোনো সুফল ফলতে পারে। অন্যথায় নয়।

আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদেরকে সব বিষয়ে সঠিক শিক্ষা বুঝ-জ্ঞান এবং সত্যপথে চলার তাওফিক দান করুন। আমীন!

Post a Comment