মাতৃ দিবস
হিফজুর রহমান
লস্কর
বিয়ের পর থেকেই
রেহানা ঘর সংসার
নিয়ে এতই ব্যস্ত
যে কোথাও বেড়াতে যাওয়া তো দূরের
কথা বাবার বাড়িতে যাওয়ারও সময়
সে পায় না।
শ্বশুর বাড়িতে দেবর
ননদদের নিয়ে সাত
আট জনের পরিবার। এতবড় সংসারে সবার
খাবার রান্না করতেই
তার দিন শেষ
হয়ে যেতো। তার
উপর যখন যার
যা কিছুর প্রয়োজন রেহানারই ডাক
পড়তো। সেও মুখবুজে সব সহ্য করে
চালিয়ে যেত।
প্রথম প্রথম তার
খুব কষ্ট হতো
তাই মাকে গিয়ে
বলতো, ' মা, আমি
আর পারছি না।
সারাদিন রান্নাবান্না নিয়ে ব্যস্ত থাকতে
হয়। তিন তিনটা
ননদ। কিন্তু কেউ
কোন কাজে হাত
দেয় না। বরং
তাদেরও কাপড় চোপড়
আমাকে ধৌত করতে
হয়।' সব শুনে
মা বলতেন,' নারীর
জীবনটাই এরকম।
একটু মানিয়ে নিতে
হবে।' স্বামী সাজেদুর খুব সহজ সরল।
সে জানে এতবড়
সংসারের সমস্ত
কাজ রেহানাকে একা
সামলাতে হয়।
তবু কিছু করার
নেই। বোন গুলো
তাদের নিজেদের পড়া
নিয়েই ব্যস্ত থাকে।
সে সবসময় রেহানাকে বলতো একটু কষ্ট
করে কোন রকম
কয়েকটা বছর
চালিয়ে যাও।
মা-বাবা আর
কদিন আছেন। তাঁদের
সেবা তো করতেই
হবে। বোন তিনটির
তো বিয়ে হয়ে
যাবে, এরপর তো
সংসারের ঝামেলা
অনেক কমে যাবে।
দিন গড়িয়ে যায়।
সারাদিন রান্নাবান্না , রেহানা এক মুহুর্তের জন্যও অবসর পায়না। ইতিমধ্যে তাদের
দুটো ছেলে মেয়ে
হয়েছে। পরিবারের সকল কাজের ফাঁকে
এদেরকেও দেখতে
হয়। হাড়ভাঙা খাটুনির মাঝেও মাঝে মধ্যে
ননদদের নানা ধরনের
বকুনিও শুনতে হয়।
কখনো অতিষ্ঠ হয়ে
স্বামীকে অভিযোগ
করলে সে রাগ
করতো। কখনো কখনো
সাজেদুর এসব
শুনে বলতো,' কি
আর এমন কাজ,
এক দুঘন্টা করলেই
তো শেষ হয়ে
যায়। একটু ধৈর্য
ধর।' এভাবেই আট
দশ বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেল। এরমধ্যে একে একে বোন
গুলোর ও বিয়ে
হয়ে গেল। ছোট
ভাই দুটিকেও অল্প
দিনের মধ্যে বিয়ে
দিয়ে দুজন বৌ
আনা হলো। কিন্তু
এখন আরেক নতুন
সমস্যা দেখা দিল।
সাংসারিক কাজ
কর্ম নিয়ে ঠেলাঠেলি দেখে বাবা তিন
ভাইকে বিষয় সম্পত্তি বুঝিয়ে দিয়ে
আলগা করে দিলেন।
কিন্তু মা-বাবা
তাদের সাথেই থেকে
গেলেন। আরও কয়েকদিনের মধ্যে মা-বাবাও
সংসার ছেড়ে চলে
গেলেন। ইতিমধ্যে তাদের
ছেলেমেয়েদের স্কুলে
ভর্তি করে দিয়েছেন। কিন্তু সংসারের ঘেরাটোপ আরও যেন বেড়ে
গেল। এখন ছেলে
মেয়ে গুলোকে খাইয়ে
দাইয়ে তৈরি করে
স্কুলে পাঠাতে হয়।
ইতিমধ্যে তার
বয়সও বেড়েছে। এখন
কাজের চাপটা যেন
আরও বেড়ে গেছে।
এক এক সময়
মায়ের সেই কথাটা
তার মনে পড়ে,'
নারীর জীবনটাই এরকম।'
সুখের আশায় জীবনটা
বুঝি এভাবেই চলে
যায়। কিন্তু সুখের
দেখা তো আর
হয় না। সংসারের কাজ কর্মের ঝামেলা
দিন দিন তো
বাড়তেই থাকে।
সাজেদুর কাঠের
ব্যবসা করে। কখন
ঘর থেকে বেরিয়ে যায় আর কখন
ফিরে আসে তার
কোন ইয়ত্তা নেই।
সকাল থেকে বিকেল
রোজ তিনবার রুটিন
মাফিক চা চাই,
ভাত খাবার চাই।
ইতিমধ্যে ছেলে
মেয়েরা অনেক
বড় হয়ে গেছে।
ছেলে সাহির এবছর
বি এ পাশ
করে শহরের একটি
ইউনিভার্সিটিতে মাস্টার্সে ভর্তি হয়েছে। আর
মেয়ে সাহানা এবছর
শহরের একটি কলেজে
বি এ সেকেন্ড সেমিস্টারে। উভয়েই
বাড়ি থেকে আসা
যাওয়া করে। স্বাভাবিক মধ্যবিত্ত পরিবার। কিন্তু তা হলে
কি হলো তাদের
চলাফেরা অনেক
উন্নত মানের। নিত্য
নতুন পোশাক চাই।
রোজ রোজ কাপড়
ধোয়া, ইস্ত্রি করা
চাই। আর এসকল
করতে হবে মা'কে
ই।
ফলে ঘুম থেকে
উঠে আবার রাত
ঘুমোবার পূর্ব
পর্যন্ত এক
মুহুর্ত রেহানা
বিশ্রাম নেওয়ার সুযোগ পায় না।
হায়রে নারীর জীবন!
সেদিন রাতে শুয়ে
শুয়ে এসব চিন্তা
করতে করতে রেহানার ঘুম আসছিল না।
এসব ভাবতে ভাবতে
দুচোখে জ্বালা শুরু
হয়ে গেল। সে
উঠে গিয়ে দেখলো
সবাই নিজের নিজের
মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত। রাত তখন বারোটা। হঠাৎ তার মনটা
বিদ্রোহী হয়ে
উঠলো। অনেক কষ্টে
আত্ম সম্বরণ করে
সে মনে মনে
স্থির করলো এদেরকে
একটা শিক্ষা দিতে
হবে। নিজেকে কঠোর
করে তুলতে হবে।
সে এগিয়ে গিয়ে
ছেলে মেয়েকে ডেকে
বাবার রোমে নিয়ে
গিয়ে কঠোর স্বরে
বলল,' কাল আমাকে
এক বান্ধবীর বাড়ি
যেতে হবে।' তোমরা
তিনজন কাল একটু
সকাল সকাল ঘুম
থেকে উঠবে। সাহির
ঘরদোর ঝাড়ামুছা করবে
আর তোমরা বাবা
ও মেয়ে মিলে
চা নাস্তা প্রস্তুত করবে। আমি ততক্ষণে প্রস্তুত হয়ে
চায়ের টেবিলে আসবো।
আমি নাস্তা করে
বেরিয়ে গেলে
তোমরা সবাই মিলে
রান্না বান্নার কাজ
শেষ করে যে
যার কাজে যাবে।
আমার ফিরতে হয়তো
দেরি হবে। দুপুরের খাবার তোমরা খেয়ে
নিও। আবার রাতের
খাবার প্রস্তুত করে
রাখবে। কোন কাজ
আমার জন্য ফেলে
রাখবে না। '
এতক্ষণ সবাই অবাক
হয়ে তার কথা
শুনছিল। এবার
সাজেদুর অবাক
বিস্ময়ে জিজ্ঞেস করল, 'এরা কি
এসব পারবে?' রেহানা
বলল,' না পারলে
তুমি তো আছ।
সংসার কি আমার
একার? তুমি তো
অনেক দিন বলেছ,
এক দুঘন্টা কাজ
করলে ঘরের সমস্ত
কাজ শেষ হয়ে
যায় আর বাকি
সারাদিন আমি
অবসরে কাটাই। তাহলে
তুমি পারবে না
কেন?' বাবার কথার
উপর কথা বলতে
শুনে ছেলে যেন
আকাশ থেকে পড়ল।
সে বলল,' মা,
আজ তোমার কি
হয়েছে, একি বলছো
তুমি?' তোমার কী
এমন কাজ আছে?'
'হে
যা শুনছো তাই
বলছি। তোমাকে কি
কৈফিয়ত দিতে
হবে?'
মেয়ে বললো,' মা
কাল যে আমার
প্রোগ্রাম আছে,
তোমাকে বললাম না?'
মা আরো রাগান্বিত হয়ে বললেন,' তোমাদের প্রত্যেকের তো
রোজই প্রোগ্রাম থাকে,
আমি তো কাউকে
কিছু বলি না।
তবে আমার বেলা
এত কথা কেন?
যা বললাম তা
যেন মনে থাকে।'
কথা কটি শেষ
করে রেহানা বেরিয়ে গিয়ে দুম করে
দরজা বন্ধ করে
দিল।
পরদিন সকালে যথারীতি সবাই একটু দেরি
করে ঘুম থেকে
উঠে প্রাতঃকাজ শেষ
করে চায়ের টেবিলে
অপেক্ষা করছে।
কিন্তু আজ তো
আর কেউ চা
নিয়ে আসে না।
রেহানা একবার এদিকটায় এসে তাদের দেখে
গেল। তারপর সে
স্নান টান করে
প্রস্তুত হতে
লাগলো। তার ভাবভঙ্গি দেখে সবাই নীরব
নিস্তব্ধ।
রেহানা নতুন শাড়ি
পরে গয়নাগাটি লাগিয়ে সাজগোজ করে চায়ের
টেবিলের পাশে
এসে বলল,' চা
হয়নি বুঝি? ঠিক
আছে আমি চললাম।
রাতের কথা গুলো
যেন মনে থাকে।'
বলেই হনহন করে
বেরিয়ে গেল।
তারা তিনজনই হতভম্ব
হয়ে বসে রইল।
সাজেদুর মনে
মনে ভাবতে লাগল
রেহানা কেন এমন
করল, নাকি ওকে
ভুতে ধরেছে! চা
নাস্তা কিছুই হলো
না। অথচ--
সাহানা আজ বয়
ফ্রেন্ড এর
সাথে মিলতে যাবে,
মা এসব জানেন
অথচ - -- - ওর কাপড়
গুলো ইস্ত্রি করা
হল না। তাছাড়া না খেয়ে কেমন
করে যাবে। গৃহস্থালির কাজ গুলো আজ
সবার চোখেই পাহাড়
পরিমান মনে হচ্ছে।
অথচ মা তো
সব একাই করেন।
সাহিরের ক্লাবে
আজ মাতৃ দিবসের
এত বড় প্রোগ্রাম। বিভিন্ন জায়গা
থেকে নিমন্ত্রিত অতিথিরা আসবে। সেখানে আজ
সে ভাষণ দেওয়ার জন্য তিন দিন
থেকে প্রস্তুতি নিচ্ছে। মা তা জানেন,
কিন্তু ----- সাহির চিন্তায় পড়ে গেল। সত্যিই
তো জন্মের পর
থেকে সে দেখে
আসছে মা' ই
বাড়ির সমস্ত কাজকর্ম করেন। সেই দাদু
দিদা থেকে শুরু
করে পরিবারের সবার
কাজ তো মা
একাই করতেন। অথচ
কোন কিছুতে একটু
দেরি হলে সবার
বকুনিও খেতে হতো।
সাহানা আজ বুঝতে
পারল জীবনের মানে
কি। তাকেও তো
একদিন এভাবে সবকিছুই করতে হবে। ' ঠেলার
নাম বাবাজি ' ঠেলা
খেয়ে সাজেদুরের অন্তরাত্মা জেগে উঠলো। সেও
ভাবতে লাগলো, সত্যিই
তো গৃহস্থালির কাজ
বড়ই কঠিন। পুরুষরা যেভাবে মনে করে
নারীরা সারাদিন ঘরে
বসে এমন কি
আর করে। আসলে
কিন্তু তা নয়।
যে কোন নারীর
তুলনায় পুরুষরা তো কিছুই করে
না। অথচ সব
পুরুষই যখন তখন
নারীর প্রতি কঠোর
ব্যবহার করতে
দ্বিধাবোধ করে
না।
সাজেদুর অনেক
সময় রেহানার প্রতি
যে রূঢ় আচরণ
করেছে তার জন্য
আজ সে অনুতপ্ত।
শেষ পর্যন্ত ঐদিন
তাদের একপ্রকার না
খেয়েই থাকতে হল।
দু-তিন দিন
থেকে মাতৃ দিবসের
অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখার জন্য সাহির
যে প্রস্তুতি নিয়েছিল তা ছিল মেকি।
আজ মায়ের এক
মুহুর্ত অনুপস্থিতি তার জীবনটা যেন
পাল্টে দিল। সভায়
উপস্থিত হয়ে
সাহিরের নিজের
মায়ের জীবন চোখের
সামনে ভেসে উঠল।
সে অনুধাবন করতে
পারল একজন নারীর
জীবন আর মায়ের
অনুপস্থিতি। তার
সুদীর্ঘ ভাষণে
মায়ের ভূমিকা সবার
নজর কাড়ে। মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে সে
বলতে শুরু করল,'
আমাদের লালন পালনের
জন্য মায়েদের সংগ্রাম ও বেদনার কথা
আমরা ভুলে যাই
এবং আমাদের কাজের
মাধ্যমে তাঁকে
কত আঘাত করি।
আমাদের মনে রাখতে
হবে মায়েদের এ
সংগ্রাম ও
বেদনার আমরা তো
অংশীদার হতে
পারব না তবে
বিভিন্ন উপায়ে
আমরা সর্বদা তাদের
কাজের বোঝা কমানোর
চেষ্টা করতে পারি
এবং তাদের কাজে
সাহায্য করতে
পারি। একটু চিন্তা
করলে আপনারা অনুধাবন করতে পারবেন মা
তথা নারী জাতি
ছদ্মবেশে যেন
এক একজন দেবদূত। আমরা অনেক সময়
সে কথা ভুলে
গিয়ে তাদের অবাধ্য
হয়ে কত অবমাননা করি। আমাদের একথা
মনে রাখতে হবে
যে সকল সফল
মানুষের পেছনে
একজন নারীর অবদান
থাকে আর তিনি
হলেন মা। প্রকৃতার্থে নারী জাতির উপর
নির্ভর করে একটা
সমাজ, একটা জাতি
তথা একটা দেশের
উন্নতি। কাজেই
আমাদের উচিত আজীবন
মায়ের কাজে সাহায্য করা, মায়ের সেবা
শুশ্রূষা করা।'
কথা বলতে বলতে
সাহিরের নিজের
মায়ের কষ্টের জীবন
চোখের সামনে ভেসে
ওঠে আর তার
দু'চোখ বেয়ে
গড়িয়ে পড়ে
অশ্রুধারা। সে
খোলা মঞ্চে সকলকে
আহ্বান করে, 'এ
সংসার নারীর শুধু
একার নয় বরং
পরিবারের সকলের।
কাজেই সকলের সম্মিলিত কাজকর্ম আর
প্রচেষ্টায় সংসারে
সুখ আসতে পারে।'
সেদিন
থেকে সাহির যেন
বদলে গেল। সন্ধ্যায় মা বাড়িতে আসলে
তার কাজে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিল।
তার এমন পরিবর্তনে বাবা ও বোনের
মধ্যেও পরিবর্তন লক্ষ্য
করা গেল। ফলে
সবার সম্মিলিত কাজে
সংসারে সুখের হাওয়া
বইতে লাগলো।