শামসুর রাহমান : আধুনিক কবি ও কবিতা
ড. এস এ মুতাকাব্বির মাসুদ
১. কবিতা বস্তুনিরপেক্ষ নয়। উৎসর্জিত হয়না কোনো নির্দিষ্ট বস্তুর কাছে।কবিতার বিষয় নির্বাচিত হয় কবির মনকে কেন্দ্র করে এবং জাগতিক আবর্তের স্বরূপকে লক্ষ্য করে। কবিতার তত্ত্বের উপর কবিমনের নিরঙ্কুশ প্রভাব থাকলেই 'কবিতা'-কবিতা হয়ে ওঠে। ফলে কবিতায় আমরা ব্যক্তি কবিকে খুঁজে পাই।কবির কবিচেতনার অন্তর্লোকে এক সামগ্রিক জীবনদৃষ্টি লক্ষ করা যায়। এ অনিবার্য সত্যটি কবিতার অন্তর্নিহিত ভাবের সত্য। এ অনুভূতি-ই আধুনিক কবিতার অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ।
২. উত্তর তিরিশের আধুনিক বাংলা কবিতায় সমর্পিত এক অতুল সত্তা-শামসুর রাহমান (১৯২৯-২০০৬)। বাংলা সাহিত্যের পঞ্চাশ'র দশকে
নগরের বিস্তীর্ণ পথে তাঁর নৈঃশব্দ্য বিচরণ আধুনিক বাংলা কবিতার উৎকর্ষ ও শিল্পচর্চাকে দীপবর্তিকার
মতো নিষ্ঠতায় প্রতিষ্ঠিত করেছে।তাঁর কবিতায় নাগরিক সভ্যতার কোমল-মসৃণ চিত্রের ভেতর জীবন বাস্তবতার কঠিন রূপবৈচিত্র্যের সন্ধান মেলে। তাঁর কবিতার নরম শরীরে যে শেকড়ের অবয়ব উদ্ভাসিত তা
পুরোটাই নগর। মনে করা হয় বোদলেয়ারের (১৮২১-১৮৬৭) নাগরিক চেতনার ভেতর ক্রমাগত উন্মেষিত এবং বিকীর্ণ প্রক্রিয়ার যে বলয় ;শামসুর রাহমান সেখানে নিজেকে হারিয়ে পুনরায় আবিষ্কার
করেছেন। আধুনিক কবিতার এ পর্যায়ে মেধাবী এবং
শৈল্পিক বিচরণে তাঁর কাব্যসত্তার অন্যমাত্রা অনুস্যূত
হয়েছে। জীবনানন্দ (১৮৯৯-১৯৫৪) যেখানে কোলাহলমুখর লোকালয় থেকে দূরে মুক্তির স্বাদ খুঁজেছেন ; শামসুর রাহমান সেখানে বিচরণ করছেন
শব্দহীন প্রতীতির সাথে এবং নগরের সার্বিক কোলাহল
আকণ্ঠ পান করে তার-ই নির্যাস কবিতায় তুলে এনেছেন নিপুণভাবে।নগরের জীবন বাস্তবতায় পারিপার্শ্বিক জ্বালাময় কষ্ট ও যন্ত্রণার শৈল্পিক চিত্রের
বিভাব বিনির্মানে তিনি ছিলেন একজন বোদ্ধা স্থপতি।
নগর বাস্তবতায় সংস্থিত মানুষের যন্ত্রণাময় জীবনের যে
বিষণ্ণ সুর অনুরণিত হতে দেখা যায়- কিবতায় তারই
সফল উপস্থাপক শামসুর রাহমান এবং সেই যন্ত্রণাকাতর চিত্তের বিক্ষত সুরধ্বনির সফল প্রয়াস
পরিলক্ষিত হয় কবির 'প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে'
(১৯৬০) শিরোনামের অমর কব্যগ্রন্থে। তিনি লিখেন :
'দুর্গন্ধের সুতীব্র পীড়নে রাত্রিদিন বিভীষিকা
সমপরিমাণে ;ক্রমাগত কেবলই জড়াই পাঁকে
নিঃশ্বাসে নারক ফোঁসে, আমার অধীর আত্মা
সে-ও গরলের বিন্দু হয়ে ঝরে সারাক্ষণ,' ('খাদ')
৩. বস্তুত তিরিশের কবিরা আধুনিক বাংলা কবিতায় বিষয় ও ভাষা বুননের বিশ্লেষণধর্মী নীরিক্ষা
চালিয়েছিলেন নতুন আঙ্গিকে।তাঁদের কবিতায় ব্যক্তিসত্তা ও প্রতিবেশের সামগ্রিক চিত্ররূপ তুলে ধরার
যে প্রয়াস, তা কাব্যশৈলী নির্মিতির অনিবার্য শর্ত হিসেবে প্রয়োগের চেষ্টা করেছেন। এমন কী সমাজ ও
প্রতিবেশ-বাস্তবতার অনন্যপূর্ব জীবনচিত্রের যৌক্তিক
উপস্থাপন তাঁদের কবিতায় যথাযথ বিনির্ণীত হওয়ার স্পর্ধা ছিলো! এ প্রসঙ্গে বুদ্ধদেব(১৯০৮-১৯৭৪) বলেন
' প্রান্তরে কিছুই নেই, জানালার পর্দা টেনে দে'র
প্রাসঙ্গিকতাই ছিলো উত্তর তিরিশের মূল কথা। '
তিরিশের মেধাবী কবিগোষ্ঠী- জীবনানন্দ দাশ
(১৮৯৯-১৯৫৪),সুধীন্দ্রনাথ দত্ত(১৯০১-১৯৬০),অমীয়
চক্রবর্তী(১৯০১-১৯৮৬),প্রেমেন্দ্র মিত্র(১৯০৪-১৯৮৮),
অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত(১৯০৩-১৯৭৬),বিষ্ণু দে
(১৯০৯-১৯৮২) প্রমুখ কবিদের তিরিশি চেতনাসমৃদ্ধ
উদ্দীপিত বলয় সমকালীন কাব্যসাহিত্যে নবীভূত এক
সৃজনশীল ধারার প্রস্তাবনা তৈরি করেছিলো। তিরিশি
কবিদের সেই বলয় ভেঙ্গে পঞ্চাশের দশকে শামসুর
রাহমান আধুনিক বাংলা কবিতায় নিজেকে ব্যতিক্রমী
ধারায় উপস্থাপন করেন। অতঃপর সাথেসাথে তিনি
খোলে দিলেন সকল পথ-ভেঙ্গে দিলেন সংস্কারের দেয়াল ; আর কবিতায় মিশে গেলো মানুষ-জীবন
এবং সময় ব্যক্তিসত্তার সাথে। নগরকেন্দ্রিক জীবন
বাস্তবতার পাশাপাশি তাঁর লেখায় অসম্ভব প্রত্যয়ে
বিজ্ঞাপিত হয় সমকালীন সমাজ-প্রতিবেশ,এবং
কবির ব্যক্তিগত যত অভিলাষ-বাসনা। তাঁর কবিতায়
ওঠে আসে নগর-জনপদের বাস্তব চিত্র।নিষ্ঠার সাথে
'impersonal' চেতনায় তুলে ধরেন বক্তব্য ও ভাষাকে।
তাই এই ঋত্বিক কবির কবিতায় প্রশান্তির বদলে ওঠে
আসে বিশশতকের জ্বালাময় দগ্ধ জীবনের পাণ্ডুলিপি।
তারই প্রতিচ্ছবি চিত্রার্পিত হয় 'আত্মজীবনীর খসড়া'
শীর্ষক কবিতায় -
'শহর জেগেছে, দূরে ঘণ্টায় প্রাণের ধ্বনি,
রোগীর শরীরে নামল নিদ্রা হাসপাতালে,
...
দুরাশয় আজও জোনাকি-জীবন, কখনো তারা
দূরের শরতে স্মৃতিগন্ধার পাবে কি আলো?
এ-কথা কখনো জানবে না তবু মৃত্যু হবে।'
৪. জীবনানন্দীয় বলয় থেকে বেরিয়ে আধুনিক বাংলা কবিতাকে শামসুর রাহমান নিজস্বতায় প্রতিষ্ঠিত
করে কবিতার শৈল্পিক উৎকর্ষকে আলোকধারায়
উদ্ভাসিত করেছেন। আধুনিক বাংলা কবিতার সফল
উৎসর্জন তাঁর কাব্যচেতনার মননশীল অনুধ্যানেরই
ফসল।বলা যায় পঞ্চাশের দশকে আধুনিক কবিতার
কোরক কবি শামসুর রাহমানের হাতেই উৎকর্ষ ধারায়
পূর্ণ বিকশিত হয়- অধুনা স্বাতন্ত্র্যে, যা কবির ব্যতিক্রমী এক অধ্যাস হিসেবে প্রমাণিত সত্য। এক্ষেত্রে উত্তর তিরিশের কবিদের চেনা পথে বিচরণ না করে মেধাবী
দক্ষতায় তিনি বাংলা সাহিত্যের আধুনিক কবিতার
শৈল্পিক বৈভবের দ্যোতিত বিভঙ্গ উপস্থাপনে নতুন মাত্রা
সংস্থাপনের কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। তিনি কবিতার অন্তর্ভেদী চেতনাকে দীপিত আলোয় শক্তিতে রূপান্তর করে নষ্ট আর কষ্টের বেদীতে নিজেকে খুঁজে পেয়েছেন
নিয়ত সাধারণের মাঝে।
কবি তাঁর প্রগাঢ় অনুভূতির যৌক্তিক সমাধান
শহরের 'চিপাগলিতে' খুঁজতে গিয়ে মানুষের বিবেকের
অন্ধ গলিতে নিরন্তর বিচরণ করেছেন নিরঙ্কুশ সাহসের
সাথে।আর সেই অনুভূতির উদ্দীপ্ত বিভায় তাঁরই হাত দিয়ে অনায়াস বেরিয়ে আসে তাঁর প্রথম কবিতা
'উনিশ শ' উনোপঞ্চাশ'।(১৯৪৮ এ লেখা- এ কবিতা প্রকাশিত হয় নলিনীকিশোর সম্পাদিত 'সোনার বাংলা' পত্রিকায় ১ জানুয়ারি ১৯৪৯) বাংলা সাহিত্যের এই অধুনা অঙ্গনে উদ্বেলিত আধুনিক ঋষি কবি শামসুর
রাহমানের এভাবেই পথচলা শুরু। তিনি বলেন -
'সেকালে একজন তরুণ কবি হিসেবে আমার সুখ্যাতি হয়েছিল,একথা সবিনয়ে নিবেদন করছি। ইতিমধ্যে
আমার অনেক কবিতা পূর্ব বাংলার তো বটেই, পশ্চিম
বাংলার বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত 'কবিতা' এবং সঞ্জয়
ভট্টাচার্য সম্পাদিত 'পূর্বাশা' পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।'
বস্তুত কবির কবিভাবনায় আধুনিক মনন ও অনুশীলনের মৌলিক উৎস ছিলো নগর ও নাগরিক জীবন। জীবন বাস্তবতায় এ নগরযন্ত্রণার ভেতর
শামসুর রাহমান নিজেকে আমৃত্যু আবিষ্কার করেছেন
গভীর বিশ্বাসে এবং অবিষণ্ণ প্রতিভার সঠিক স্বাক্ষর রেখেছেন কবিতার অজর পঙক্তিতে।এখানে তাঁর সেই বিখ্যাত কবিতা 'আঁরাগ তোমার কাছে' এবং 'প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে' শিরোনামে লেখা কবিতা দু'টির লাইন উদ্ধৃত করা গলো -
'আঁরাগ তোমার কাছে কোনোদিন পরিণামহীন এই পঙক্তি মালা জানি না পৌঁছবে কী না, তবু
তোমারই উদ্দেশে এই শব্দাবলী উড়ে যাক
পেরিয়ে পাহাড়
অনেক পুরনো হৃদ বনরাজি এবং প্রান্তর।'
(আঁরাগ তোমার কাছে)
'স্বর্গদীপ্ত প্রাণ নিয়ে এসে এ কোথায় কোন দেশে
হারিয়ে ফেলেছি রূপ পশুর রোমশ অন্ধকারে?
...
আর চেয়ে দেখি মৃত্তিকায় করোটিতে জ্যোৎস্না জ্বলে
বিষণ্ণ স্মৃতির মতো,দ্বিতীয় মৃত্যুর ধ্বনি ভাসে।'
(প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে)
৫. সৃজনশীলতায় সমৃদ্ধ কবির অতুল সত্তা কাব্যকলার অনির্বচনীয় শিল্প রসে মগ্ন কবি- কবিতার উঠোনে জীবনকে খুঁজে নেন নিরন্তর সীমাহীন পথচলায়।কবিতায় তারই সুর স্পর্ধার সাথে অনিবার্য
ধারায় সুব্যক্ত হতে দেখা যায়।বাংলা কবিতায় কবির
আধুনিকতার শৈল্পিক উন্মীলন বস্তুত এখান থেকেই।
আর এখানেই শামসুর রাহমান কবিতায় মৌলিকতার
স্বাক্ষর রেখেছেন- আধুনিকতার ধারায় নতুন মাত্রা যোগ করেছেন।একাল-সেকাল-সমকালকে ধারণ করেছেন দক্ষতার সাথে সংবেদনশীলতায়।
শামসুর রাহমানের কবিতা প্রসঙ্গে হুমায়ুন আজাদ বলেন '... আমাদের মধ্যে কবি তুমি নিঃসন্দেহে
দীর্ঘ তিরিশ বৎসরে তরুণ থেকে প্রৌঢ়ত্বে যেতে যেতে
অনেকখানি পথ, অনেক বাঁক ও বন্ধুরতা পার হতে
হয়েছে তোমাকে, কিন্তু কবিতার রাজতিলক তোমার
ললাট থেকে কখনো মোছেনি।আমাদের ব্যক্তিক
আনন্দ-সংকট,জাতির গৌরবে কি দুর্দিনে আমাদের হাতে হাত রেখে চলেছে শামসুর রাহমানের কবিতা। '
বলাচলে বিউটি বোর্ডিং এর করিডোর থেকে কবিতার অন্তঃপুরে শামসুর রাহমানের নিরন্তর পথচলা আধুনিক বাংলা কবিতার প্রদৃপ্ত এক দিগন্তকে উন্মুক্ত করেছে।অসামান্যতায় মেধার বিভব দেখিয়েছেন আত্মগত উপলব্ধির জগতে উত্তীর্ণ কবি ; মুগ্ধ করেছেন তাঁর প্রথম প্রয়াস 'প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে'(১৯৬০)শিরোনামে লেখা কাব্যগ্রন্থের মধ্য দিয়ে।এ প্রসঙ্গে হুমায়ুন আজাদ লেখেন: 'বাংলাদেশের কাব্যমণ্ডলের প্রথম সুবর্ণমণ্ডিত ঘটনা;চল্লিশের দশক থেকে আধুনিকতা ও আধুনিক কবিতার সাথে যুক্ত হওয়ার জন্যে স্খলন-পতন-ভরা যে শ্রমসাধনা ক'রে আসছিলেন বাঙালি মুসলমান কবিমণ্ডল, তা ব্যাপক
সাফল্য আয় করে 'প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগেতে।'
উল্লেখ্য স্বদেশ, জাতি,মানুষ-মানবতা,বিবেক-স্বাধীনতা,যুদ্ধ-যন্ত্রণা, কষ্ট, প্রেম-ভালোবাসা,বিরহ-বিচ্ছেদ, এবং যে শহরকে ভালোবেসেছেন নিয়ত
অন্তর্লোকে পরম মমতায়, সে শহরের অলিগলির
বিমূর্ত পাণ্ডুলিপি স্বাচ্ছন্দ্যে ঠাঁই পেয়েছে শামসুর রাহমানের কবিতার উচ্ছল পঙক্তিতে।দীর্ঘ সময়ের প্রতীক্ষার পর কবির বিলম্বিত-প্রমিত সিদ্ধ কাব্য প্রয়াস-
তাঁর অনুপুঙ্খ উপলব্ধির শৈল্পিক শুচিকে নির্দেশ করে।
সৈয়দ শামসুল হোক বলেন ' বইয়ের পাণ্ডুলিপি করেছেন শামসুর রাহমান ও সপ্তাহ কী মাস পরেই তা
সরিয়ে রাখছেন। পুনর্বিবেচনার জন্যে।বারবার নাম ও পাল্টাচ্ছেন বইয়ের। একবার ভাবছেন বইয়ের নাম হবে
'মেধাবী রাতের নদী', কিছুদিনের মধ্যে সেটা হয়ে গেছে
'রূপালি স্নানে'র কিছু পরেই 'রুটি ও গোলাপ',শেষ পর্যন্ত শামসুর রাহমানের প্রথম কবিতার বইটি বেরুলো
'প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে' নামাঙ্কনে।
৬. যন্ত্রণায় দগ্ধ কবি-তাঁর কবিতায় তুলে এনেছেন অবিদগ্ধ অস্পৃশ্য মানুষের ছবি। বলা যায় আধুনিক বাংলা কবিতায় শামসুর রাহমান নিজেকে ক্রমান্বয়ে অতিক্রম করে পৌঁছে গেছেন এক অনন্য উচ্চতায়। তাঁর কবিতায় নাগরিক জীবনের যে যন্ত্রণাদগ্ধ চিত্রের আধিপত্য লক্ষ্য করা যায়-তা মূলত ঢাকা শহর। বলা যায় যে কারণে শামসুর রাহমানের চোখে রাজধানী ঢাকা বিম্বিত হয় স্বপ্নের শহরে।'রৌদ্র করোটিত'(১৯৬৩)
ভিন্ন স্বাদে বিজ্ঞাপিত ঢাকা-পরিবর্তিত রূপ নেয় সময়ের
কঠিন- রূঢ় বাস্তবতার প্রেক্ষিতে। সেখানে কবির সেই ঢাকা আর খুঁজে পাওয়া যায় না! 'আত্মপ্রতিকৃতি'কবিতায় তার সে সুরটি জীবন বাস্তবতায় অনুরণিত হতে দেখা যায়।
'...এভেন্যুর মধ্যরাত্রির স্তব্ধতা,
সার্কাসের আহত ক্লাউন আর প্রাচীনের অতন্দ্র বিড়াল,কলোনির জীবনমথিত ঐকতান,
...গলির অন্ধ বেহালাবাদক,ব্রাকের সুস্থির মাছ
সেঁজার আপেল জানে কত।
সহজে আমাকে, জানে কবরের দুর্বিনীত ফুল।'
এ ধারায় নিরীক্ষিত অনুভূতির বৈচিত্র্যময়
বাস্তবতার দৃশ্যমান-দুর্বিষহ ও অপ্রসন্ন চিত্রের নন্দিত বিভঙ্গ প্রকাশে 'পারিপার্শ্বিকের আড়ালে' শীর্ষক কবিতায় কবির উচ্চারণ :
'প্রতিদিন শহরের সবচেয়ে করুণ গলির মুখচ্ছবি
মুখের রেখায় নিয়ে নিয়ে হাঁটে ফুটপাতে
...
শুধু মধ্যরাতে ঢাকা তার রহস্যের অন্তর্বাস খুলে বলে
ফিরে এসো তুমি।
মধ্যরাতের ঢাকা বড় একা ফাঁকা হয়ে যায়,'
কবির স্বপ্নময় সুখ-শান্তির আবাসস্থল ঢাকা একটি দুঃস্বপ্নের দলিল মাত্র। বস্তুত তাঁর কবিতায়
যে বার্তা উপস্থাপিত হয়েছে, তা হলো মানুষের
বিবর্ণ-ক্লান্ত নগরের দিকে নিরন্তর যাত্রার প্রবণতা।
কবিতায় শামসুর রাহমান নিয়ত খুঁজে ফিরেছেন
তাঁর স্মৃতির অতলান্তে হারিয়ে যাওয়া চিরচেনা
চির উজ্জীবিত স্মৃতির শহর ঢাকা। স্মৃতিকাতর উপলব্ধি থেকে তাঁর হাত থেকে বেরিয়ে আসে স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থ 'স্মৃতির শহর'।
৭. শামসুর রাহমানের কবিতা আমাদেরকে পৌঁছে
দিয়েছে নতুন 'বঙ্গ উন্মেষের' বার্তা। তাঁর কবিতায়
পাশ্চাত্য সুর-চেতনা ও প্রতিবেশের জীবনচিত্র অনায়াস
উদ্ভাসিত। বাঙালির প্রচল ঐতিহ্যে কবি থেমে থাকতে
চান নি বলেই এক উদ্দাম উদ্বেলিত চেতনায় একাত্মবোধ করার তাগিদ অনুভব করেছেন পাশ্চাত্য জীবনচেতনার সাথে।চিন্তায় ও মননে আধুনিক কবি
মিশে যেতে চেয়েছেন বারবার প্রতীচ্য ধারায় নিজের
প্রতিবেশ-সংস্কৃতিকে সাথে নিয়ে।আবার কবি এ-ও
ভুলে যাননি নিজস্বতা ও পারিপার্শ্বিকতাকে। তাই কবি
প্রতীচ্য জীবন-সংস্কৃতিতে মিলতে চেয়েছেন কিন্তু হারিয়ে যেতে চান নি।তাঁর কবিতায় বিদ্যমান ব্যবহৃত
শব্দ-সার্কাসের 'আহত ক্লাউন',কিংবা গলির 'অন্ধ বেহালাবাদক ' প্রতীচ্য জীবনের প্রতীকী চিত্রায়ণ বলে মনে করা হয়। কবি প্রতীচ্য কাব্যস্টাইল এবং শিল্প
- সৌন্দর্যকে অন্তরে লালন করেছেন নিজস্বতায়।
তাই তাঁর কবিতায় মেধাবী উপস্থাপনে উদ্ভাসিত হয়ে
ওঠে-ব্রাক, সেঁজা,দান্তে(১২২৬-১৩২১),বোদলেয়ার
(১৮২১-১৮৬৭),লোর্কা,এলিয়ট(১৮৮৮-১৯৬৫),কীটস,আঁরাগ,ফ্রস্ট,নেরুদা,টেনেসি উইলিয়াম এবং কবির প্রিয় যত চিত্রশিল্পী-মাবিস, পিকাসো,মাতিস,কাত্তিনস্কি-এর জগৎ।
আর এখানেই কবি শামসুর রাহমান নিজেকে সমর্পিত করেন একজন বিশুদ্ধ নাগরিক কবি হিসেবে।
বলা যায় শামসুর রাহমানের সে সত্তারই শাশ্বত উত্তরাধিকার তাঁর প্রতিটি কালজয়ী কবিতা।
দ্র. এ গ্রুপে প্রবন্ধ 'এলাউ' না হলে ডিলিট দেবেন।
"""""""""""""""""""""