চেতনাতে নজরুল
--- রণজিৎ কুমার দেব।
২০ এপ্রিল, ২০২৪
------------------------------------
কাজী নজরুল মৃত্যুঞ্জয়ী। নজরুল বাঁচিয়া রহিয়াছেন আমাদের প্রাণে, রহিয়াছেন বাংলার প্রতিটি ধূলিকণায়। নজরুল বাঁচিয়া রহিয়াছেন তাঁহারই সৃষ্টিতে, তাঁহার লেখায় কবিতায় গানে। কখনও দেশাত্মবোধের উদ্যমতায় কখনও প্রেমের মাদকতায় কখনও বা ভক্তিরসাপ্লুত গানে গানে।
মানবজাতিকে, -- বিশেষ করিয়া বাংলার মানুষের মধ্যে ইসলাম আর সনাতন ধর্ম্মের সমন্বয়ের দ্বারা সুবৃহৎ বাঙ্গালী জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করিতে নজরুল যাহা করিয়াছিলেন বা করিবার জন্য আপ্রাণ প্রচেষ্টা করিয়াছিলেন বাংলার কোনও কবি সাহিত্যিক বা বুদ্ধিজীবী এমন কি রবীন্দ্রনাথও ঠিক ততটা করেন নাই। ধর্ম্মে ইসলাম কাজী নজরুল ছিলেন যথার্থই একজন আদর্শ মুসলমান। নজরুল শুধুমাত্র বাঙ্গালীই ছিলেন না -- ছিলেন বাঙ্গলার পথপ্রদর্শক। সর্বোপরি এই মানুষের সাম্রাজ্যে জাতি-ধর্ম্মের ঊর্ধ্বে কাজী নজরুল ছিলেন এক আদর্শ মানুষ, মহামানব। আগেকার অনেক কবি লেখক স্বচ্ছল চিন্তাহীন জীবনযাত্রার মধ্য দিয়ে অনেক কিছুই লেখিয়া গিয়াছেন, কিন্তু দুঃখের নদীতীরে বসিয়া জীবন-সংগ্রামের মধ্য দিয়া দেশ সমাজ বিধ্বংসকারী ধর্মান্ধতা কুসংস্কার আর সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে এবং তৎসহ পরাধীনতার শৃঙ্খল মোচনে সংগ্রামী চেতনাকে জাগরিত করিয়া নজরুল যাহা লেখিয়াছিলেন তাহা নেহাৎ কাব্য নহে, হৃদয়ের গভীর হইতে উৎসরিত বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি। অনেক কবিই বাঙ্গলাকে লইয়া বাঙ্গালীকে লইয়া ধর্মীয় ভাবধারায় বা সামাজিক প্রেক্ষাপটে কতই মিষ্টি-মধুর কবিতা গান প্রবন্ধ লেখিয়া গিয়াছেন কিন্তু নজরুলের অধিকাংশ লেখাই ছিল বাস্তবধর্মী, ছিল প্রেরণামূলক বার্তাবহ। নজরুলের লেখা প্রেম-বিরহের গান যেন বাঙালির হৃদয়ের গান, অতুলনীয়; তবে সেই সবকিছুর পাশাপাশি তাঁহার লেখনী হইতে মাঝেমাঝে কালির বদলে বারুদ বাহির হইত; যে বারুদ হইতে আগুন জ্বলিয়া কবিকে ‘বিদ্রোহী’ আখ্যায় ভূষিত করিয়াছিল সেই আগুন আজ পর্যন্ত আমাদের মনের কলুষতা অজ্ঞানতা ভীরুতাকে অতি কিঞ্চিত হইলেও হয়তো বা পুড়াইতে সক্ষম হইয়াছে। অদূর ভবিষ্যতে হয়তো সেই আগুন হইতে জ্বালানো বাতি অন্ধকারের নাগপাশ ছিন্ন করিয়া আমাদেরকে আরও অনেকটা পথ দেখাইয়া লইয়া যাইবে।
আমি সাম্যের গান গাই >
মানুষ সত্য, খোদা-ঈশ্বর পরম সত্য,
গাহি সেই সত্যের জয়গান;
আত্মা হইতে উৎসরিত
ধর্ম্মের জয়গান।
আমি সাম্যের গান গাই;
আমি যখনি গান গাই —
কবি কাজী মোর জিহ্বাগ্রেতে
আসিয়া লহেন ঠাঁই।
ধর্ম্মের নামে কূটনীতি বিষে
ছিঁড়িল নাড়ির টান,
মানুষে মানুষে ভেদাভেদ রচি
জাতি হ’ল খানখান।
নেই ভক্তি নিষ্ঠা প্রেমের বালাই
মুখে ধর্ম্মের নাড়া,
ধরমের নামে শুধু বিদ্বেষ,
দিল হিংসা যে মাথাচারা।
ভণ্ডামি দেখে গরজে উঠিল
কন্ঠ সে প্রতিবাদী,
তা’রি কম্পন লেগে জাগিল যে
একবিংশ শতাব্দী।
মাটির গন্ধে একে অন্যেরে
টানিল বক্ষপাতি,
লুকাইল মুখ ভণ্ড যতেক
ঘুচিল জাতের বজ্জাতি।
কোথায় হিন্দু কোথায় বৌদ্ধ,
ঈসাই মুসলমান,
দু’চোখ মেলিয়া যাহারেই দেখি
দেখি শুধু ইনসান্।
হে আমার প্রিয় নজরুল !
তুমি যদিও আজ অতীত —
তুমি আমার দেবতা জাতির প্রেরণা,
বাংলার পথিকৃৎ ।