পিতা মাতার দায়িত্ব ও কর্তব্য রচনা। শিশু শিক্ষা অনুচ্ছেদ

পিতা মাতার দায়িত্ব ও কর্তব্য শিশু শিক্ষা
অমলেশ কুমার ঘোষ

পরিবার নিয়ে একটা বড় গল্প লেখার পরিকল্পনা পুত্রের বিবাহের সময় মাথায় ছিল, টেবিলে কাগজে লিখে রাখা ছিল। লেখা শুরু হলে, তিন, চার বা পাঁচ ভাগে কি থাকবে। পরিকল্পনা নিয়ে লিখতে হবে ডিভোর্স, দাম্পত্য কলহ, শিশুরা কি(?) পিতামাতা দুজনকে একসাথে পাবে না। ডিভোর্স, পিতা মাতার দায়িত্ব কর্তব্য ও শিশু শিক্ষা বিষয়গুলি সাপ্তাহিক লেখনী সাহিত্য পরিষদ ও  নবদিগন্তে সাহিত্য বিনোদনে রাখি। লেখা আসলে মন দিয়ে পড়েছি। ইতিমধ্যে  আমার গল্প “পরিবারের” প্রথম অংশ- “হৃদয়ের স্মৃতিকথায়” শেষ করেছি- সেখানে এখনো বিষয়গুলি আসে নি। তাই, এই জায়গায় এসে পিতা ও মাতা নিয়ে পড়লাম, কয়েকটা পাতায় পোস্ট করবো, যদি পাঠক পড়ে। 

বিভিন্ন আইন, রীতি ও রেওয়াজ অনুসারে শিশুর সাবালক হয়ে ওঠা অবধি - প্রতিপালন শিক্ষা স্বাস্হ্যর দায়িত্ব, সামাজিক সচেতনতা তৈরীর আলোচনা, প্রাচীন পুঁথি ধর্মগ্রন্থে আছে। এজন্য পিতা মাতা, দাদু ঠাকুমা ছাড়াও সৎ বাবা, সৎ মা, আইনী অভিভাবক বা আরও বলা আছে। শিশু ভূমিষ্ট হবার পর প্রাকৃতিক ও বিভিন্ন কারণে পিতা-মাতার একজনকে বা দুইজনকেও হারাতে পারেন, তবুও সমাজের বেশীরভাগ অংশ নিয়ে এই আলোচনা, সীমাবদ্ধতা মানুষ জন্ম নিয়েই। বিভিন্ন তত্ত্ব বা প্রাচীন পুঁথি সহ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও বলেছেন শিশু জন্ম দুবারে- একবার গর্ভাবসহায় আরেকবার ভূমিষ্ট হবার পর। এই দুই ক্ষেত্রে নবাগতদের অভ্যর্থনার আয়োজন রেওয়াজ রীতি আনন্দের। সন্তান ভূমিষ্ট হবার পরই সবাই আনন্দে অংশগ্রহণ করে, নবজাতকের জন্য বিভিন্ন অনুষ্টানের মাধ্যমে। মা বাবা দুজনেই নবজাতকের জন্য সদা ব্যস্ত ও ক্রমশ চিন্তিত হতে থাকেন। কিন্তু  নবজাতকের কোনো ভূমিকা নেই, সে নিজের ইচ্ছে বা পছন্দের দ্বারা চালিত নয়। এই জন্যই শিশুর প্রতিপালন, শিক্ষা স্বাস্হ্যর দায়িত্ব, সুস্হ সামাজিক বাতাবরণ নিয়ে আইন নীতির কথা বলা হয়। এইজন্য শিশু গর্ভাবস্তায়  থেকে শুরু পিতা মাতার দায়িত্ব কর্তব্য। আমাদের প্রাচীন পুঁথি রীতি ও সংস্কার অনুসারে - জন্ম মৃত্যু বিবাহ- মনুষ্যের অজানা। পরম্পরা অনুযায়ী, শুধু নিজের বিবাহের রীতি সংস্কারে অংশগ্রহণ করে, মনুষ্য নিজ জ্ঞানে। বাকি দুটি মনুষ্যের হাতের বাইরে, এইজন্য বিবাহের সমস্ত রীতি রেওয়াজ, সংস্কার পালনে নব দম্পত্তির আনন্দ আসে- যা চিরন্তন সত্য।

আন্তর্জাতিক সংজ্ঞানুযায়ী, স্বামী স্ত্রী নাবালক পুত্র কন্যা পরিবারের মৌলিক অংশ। শিশু থেকে সাবালক (১৮/২১ বছর) অবধি সব দায়িত্ব পিতা মাতার। (১৮/২১) বছর অবধি সন্তানের দায়িত্ব মৌলিক পরিবারের অংশবিশেষ, যেমন তাদের পিতা মাতা করেছিলেন। - শিশুর কল্যাণ, রক্ষা ও সুন্দর পরিবেশ বজায় রাখা, বাসস্থান, পোশাক পরিচ্ছদ , সুসম আহার সাথে শিশুর পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া সব প্রাথমিক দায়িত্ব পিতা মাতার। সন্তানের প্রতি ভালবাসা প্রকাশ করা গুরুত্বপূর্ণ, এবং বাবা-মা তাদের সন্তানদের ভালবাসেন। সন্তানের সাথে শারীরিকভাবে স্নেহশীল হয়ে এবং তাদের সাথে একের পর এক সময় ব্যয় করেন। বাবা-মায়েরা- প্রতি নিয়ত সন্তানদের সাথে কথা বলেন ও শোনেন- খেলাচ্ছলে বা নীতি কথার গল্পে। 

আমাদের প্রাচীন পুঁথি বলে, বাবার দায়িত্ব - শিশু ভূমিষ্ট হবার পর শিশুর মায়ের খেয়াল রাখা - শারীরিক মানসিক ও সামাজিক দিক থেকে, তাহলে ত্রিকোন ভালোবাসা তৈরী হবে। শিশু জীবনের প্রথম পাঁচ/ সাত বছর গুরুত্বপূর্ণ। অবচেতন মনে শিশুর মধ্যে ঐসময় গড়ে উঠে বিশাল তথ্য ভান্ডার। এজন্য ছোট বাচ্চাদের জীবনে বাবা-মা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের মধ্যে রয়েছেন। জন্মের পর থেকে, শিশুরা সব শিখছে মা ও বাবাদের উপর নির্ভর করেই। শিশু পিতা মাতা কে জানে না, প্রকৃতি ও পরিবেশ তাকে পরিচয়ে শিক্ষিত করে, এটা এক সহজ সত্য।

পিতামাতারা তাদের সন্তানদের জীবনে একটি অপূরণীয় ভূমিকা পালন করে। শিশুর মানসিক, শারীরিক, সামাজিক এবং মানসিক বিকাশের পাশাপাশি পিতা মাতার সামগ্রিক সুস্থতা এবং সুখের উপর গভীর প্রভাব ফেলে। দাম্পত্য কলহ মাত্রাতিরিক্ত হলে, শিশু মা বা বাবা একজনের সান্নিধ্য কম পেতে পারে বা নাও পেতে পারে। এতে শিশুমনের পরিপূর্ণ বিকাশ হয় না, যার জন্য শিশু দায়ী নয়। পিতামাতার মধ্যকার কলহ বাহ্যিক কারণে, চাইল্ড ইগো (Child Ego) ও অ্যাডাল্ট ইগো (Adult Ego) দ্বারা ভিন্ন মুখে পরিচালিত হতে থাকে। পিতা মাতার দায়িত্ব কর্তব্য এবং শিশু শিক্ষা গভীর প্রভাব ফেলে। মনে রাখা জরুরী- বাবা মায়ের জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপ সন্তানের মনে গাঁথা থাকে।

তবুও মন্টেসরি শিক্ষায়, একটি সাধারণ শ্রেণীকক্ষ বিভিন্ন বয়সের শিক্ষার্থীদের বিকাশের পর্যায়ের উপর ভিত্তি করে তৈরি, যাকে মন্টেসরি উন্নয়নের চারটি প্লেন বলে। 

ð প্রথম সমতল (জন্ম থেকে 6 বছর বয়সী): এই পর্যায়ে, শিশুরা তাদের চারপাশের জগত সম্পর্কে দ্রুত তথ্য ভিজিয়ে রাখে, যে কারণে মন্টেসরি এটিকে "শোষক মন" হিসাবে উল্লেখ করেছে। 

ð দ্বিতীয় সমতল (বয়স 6-12): এই পর্যায়ে, শিশুদের স্বাধীনতার দিকে মনোনিবেশ করে, তবে শারীরিক নয় বরং বুদ্ধিবৃত্তিক।

ð তৃতীয় সমতল (বয়স 12-18): এই পর্যায়ে, কিশোর-কিশোরীদের মানসিক স্বাধীনতা এবং নিজের উপর ফোকাস করার জন্য স্থানান্তরিত হয়। নৈতিক মূল্যবোধ, সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা এবং স্ব-পরিচয় অন্বেষণ এবং শক্তিশালী করা হয়। 

ð চতুর্থ সমতল (বয়স 18-24): এই শেষ পর্যায়ে, মনোযোগ আর্থিক স্বাধীনতায় স্থানান্তরিত হয়। এই সমতলে তরুণ প্রাপ্তবয়স্করা তাদের ব্যক্তিগত বিশ্বাস, পরিচয় এবং বিশ্বে ভূমিকাকে দৃঢ় করতে শুরু করে। 

শিশু শিক্ষার কথা বললে লেভ ভাইগটস্কির কথা বলতেই হয়, উনি "সামাজিক-সাংস্কৃতিক শিক্ষার তত্ত্ব" প্রস্তাব করেছিলেন, যা ব্যক্তি চিন্তাভাবনা এবং মানসিক প্রক্রিয়াগুলির বিকাশের উপর সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞতার প্রভাবের উপর জোর দেয়। 

ভাইগটস্কির শিক্ষার তত্ত্ব গুলিতে, তিনি প্রক্সিমাল ডেভেলপমেন্ট জোনের তত্ত্বও হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন- অনেকটা প্র্যাকটিক্যাল কর্মগুণে। এটি তত্ত্ব রুপে বর্ণনা করে, কীভাবে নতুন জ্ঞান বা দক্ষতা গ্রহণ করা যায়। একজন শিক্ষক বা বয়স্ক বন্ধু একটি শিশুকে দক্ষতা শিখতে সহায়তা করে, তা সে ব্লকের দুর্গ তৈরি করা, জুতো বাঁধা বা নিজের নাম লেখা। শিশুটি ক্রিয়াকলাপের ধাপে আরও বেশি সক্ষম হয়ে উঠলে, প্রাপ্তবয়স্ক বা বড় শিশু ধীরে ধীরে সমর্থন প্রত্যাহার করে নেয়, যতক্ষণ না শিশুটি নিজে থেকে প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণ করতে সক্ষম হয়। এটি সেই ক্রিয়াকলাপের অঞ্চলের মধ্যে করা হয় - শিশুটি কোথায় আছে এবং সে সম্ভাব্য ভাবে কোথায় থাকবে তার মধ্যে দূরত্ব।  প্রক্সিমাল ডেভেলপমেন্টের প্রতিটি জোনে, তারা দক্ষতা তৈরি করে এবং তাদের প্রক্সিমাল ডেভেলপমেন্ট রেঞ্জে আরও দক্ষতা শেখার মাধ্যমে বৃদ্ধি পায়। তারা শিক্ষক এবং অভিভাবকদের দ্বারা পরিচালিত হয়ে দক্ষ তৈরি হয়। তারা যেখান থেকে তাদের প্রক্সিমাল ডেভেলপমেন্ট জোনে আছে সেখান থেকেই গড়ে তুলতে হবে। 

যাইহোক, ভাইগোটস্কি দৃষ্টিভঙ্গি নির্দেশিত অংশগ্রহণ এবং সমর্থন সহ ছাত্রদের অন্বেষণকে উৎসাহিত করে। শিক্ষকরা সহযোগিতামূলক জ্ঞান তৈরির শেখার প্রক্রিয়াগুলির ধারাবাহিক এবং নিয়মিত মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের তাদের জ্ঞানীয় বিকাশের স্তর অর্জনে সহায়তা করতে পারেন। ভাইগোটস্কি দৃষ্টিভঙ্গি বা মন্টেসরি শিক্ষা নিয়ে যত বলা হবে শেষ হবে না, অনেকটা ওপেন এ্যানডেড আলোচনার মতো।

ফিরে আসি মৌলিক কথায়, আজকাল লেখা পড়ি, কবিতায় বা ছোট গল্প বা অণু গল্পে পিতা মাতা বৃদ্ধাশ্রমে, ছেলে দেখে না বা স্বামী স্ত্রী দাম্পত্য কলহ, ডিভোর্স - সিঙ্গল মাদার বা সিঙ্গল ফাদার অথবা বোর্ডিং বা ক্রেশ জাতীয়। কিন্তু ভুলে যাই - একজন পিতামাতার আইনগত দায়িত্ব রয়েছে যে তাদের সন্তানদের যত্ন নেওয়া এবং তারা সেই সন্তানের সাথে থাকে বা না থাকে তা নিশ্চিত করার জন্য। এটি পিতামাতার দায়িত্ব হিসাবে পরিচিত এবং আইনে এটি অন্তর্ভুক্ত যাতে যথাযথ শিক্ষার ব্যবস্হা করা হয়। তবুও খামতি থেকে যায়, অবচেতন মনে, ঐ সন্তান যখন পূর্ণ বয়সের মানুষ হিসেবে আসে। ডিভোর্স বা সিঙ্গল মাদার বা সিঙ্গল ফাদার মাথায় নিয়ে স্বাধীনতা নামক শৃঙ্খলা মুক্ত জীবনে শিশু আনলে, ঐ শিশুর অবচেতন মনে থাকবে- অপরিস্কার তথ্য ভান্ডার- এই কথাটাই বলার প্রয়োজন। এই অপরিস্কার তথ্য ভান্ডার সমাজের ভিত নাড়িয়ে দিতে পারে, যার জন্য তাকে কঠিন শাস্তির মুখোমুখি হতে হয় বা হবে।

এটা, লিখলাম, আমার গল্পের হরিপদ অ্যাডভোকেট, আইনের সিভিল অংশ নিয়ে প্র্যকটিস শুরু করে দেখছে, জমি বাড়ি সম্পত্তির কলহের থেকে দাম্পত্য কলহের কেস অনেক বেশী। বেশীর ভাগই হরিপদকে নাড়া দেয়- শেষ যেটা নাড়া দিয়েছে- পরিবার চাই- সবার জন্য। ডিভোর্স  কেসের মামলাটা যুধিষ্ঠির এনেছে, মেয়েটি - গত পাঁচ বছর ধরে ডিভোর্স দিচ্ছিলো না, একমাত্র পুত্র, ছেলের মা -  বৌমাকে ফিরে আসতে বা রফা করে নিতে, পায়ে ধরে বিনতিও করেছে। সিঙ্গল মাদারের একমাত্র মেয়ে, ছেলে ও বৌয়ের নামে যৌথ ফ্লাটে মা মেয়ে থাকে। লোনের কিস্তি ছেলেটি দেয়। দুপক্ষ সময় নিয়ে তিনজন করে হরিপদর অফিসে। বারাসাত কোর্টে কেস। সব শুনছিল -  কখনো একা একা, কখনো দুজনকে বসিয়ে আবার সবাইকে একসাথে নিয়ে। মেয়েটি তিন মাসের অন্তঃসত্ত্বা, সেও সিঙ্গল মাদার হিসেবে থাকবে। সমস্যা - এইখানে- পিতৃ পরিচয় জানে না, উনার পক্ষে বলা অসম্ভব। 

নির্মলবাবু, খবর পেয়ে, বৌমাকে ডেকে বিস্তর আলোচনা করে ও দিকে ছেলেকেও বোঝায়, সমাজে একটি নবজাতক যদি পিতৃ মাতৃ পরিচয় নিয়ে আসে, আমরা সবাই এক হয়ে যাই, এটা স্বাভাবিক। তিনজনের মধ্যে কথাগুলো সীমাবদ্ধ রেখে পথ খুঁজতে থাকে। গত পাঁচ বছর এই চাপে নিয়ে নির্মলবাবুর বয়স ২০ বছর বেশী বেড়ে গেছে। অনেক খবর পেয়ে হৃদয়বাবুর কাছে আসা, বিচারককেও উনি সব সত্য বলে মিটমাট করে দেন যদি, যতটা সম্ভব অপ্রকাশিত রেখে। গল্পে নবজাতকের ভূমিষ্ট আনন্দ উল্লাস নিয়ে, সত্য জানলো নির্মলবাবু ছাড়া পাঁচ জন - বিচারক, অ্যাডভোকেট, পিতা, মাতা ও যুধিষ্ঠির।

   

Post a Comment