ভাষা দিবসের শ্রদ্ধাঞ্জলী। ভাষা দিবসের রচনা।ভাষা দিবস অনুচ্ছেদ


*ভাষা দিবসের শ্রদ্ধাঞ্জলী*
-----------------
কলমে-প্রদীপ বাগ
রচনা কাল-২১-২-২০২৪

মানুষের মুখে কিভাবে কখন ভাষা এসেছিল তা এক বিরাট রহস্য।বাংলা ভাষায় কবে থেকে মানুষ কথা বলা শুরু করে তার সঠিক তথ্য পাওয়া যায় না।বাংলা ভাষার উদ্ভবের পিছনে রয়েছে সুদীর্ঘ ইতিহাস ও বিবর্তনের ধারা।পন্ডিতগণ অধিকাংশ ভাষার ই আদি উৎস খুঁজে পেয়েছেন।
পৃথিবীর যাবতীয় ভাষারই উৎপত্তি হাতে গোনা কয়েকটি মূল ভাষাগোষ্ঠী থেকে।পাশাপাশি দুটি ভুখন্ডের একই ভাষাকে ভাষা বংশ বলা হয়।পৃথিবীর আদি ভাষাগোষ্ঠীর অন্যতম ইন্দ- ইউরোপীয় ভাষা। এই ভাষা ও উপভাষা বিশ্বের প্রায় ছয়টি দেশে পাওয়া যায়।যেমন- ইংরেজি, ল্যাটিন,ফার্সী,রুশ,বাংলা এবং হিন্দি।এছাড়াও বিশ্বের অনেক ভাষা ইন্দো- ইউরোপীয় ভাষার অর্ন্তগত। আনুমানিক প্রায় খ্রী:পূ: ৫০০০ পাঁচ হাজার বছর আগে পূর্ব ইউরোপের মধ্যভাগ থেকে শুরু করে দক্ষিণ পূর্বাংশ পর্যন্ত এই ভাষার প্রভাব বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।এছাড়াও মধ্য এশিয়ার পশ্চিমাঞ্চলে মূল ভূখণ্ডে যে ভাষা প্রচলন হয় তা ইন্দ-ইউরোপীয় ভাষা বলে জানা যায়।ইন্দো ইউরোপীয় ভাষার বিবর্তনের ফলে দুইটি শাখায় বিভক্ত হয়ে যায়।একটি হলো 'কেন্তম শাখা' অপরটি হচ্ছে 'শতম শাখা'।ইন্দো ইউরোপীয় অঞ্চলের মানুষ যে ভাষায় কথা বলত তা ছিল 'কেন্তম শাখা' ভুক্ত। ভারতীয় অঞ্চলের মানুষ যে ভাষায় কথা বলত তা ছিল 'শতম শাখা' ভুক্ত।ইন্দো ইউরোপীয় ভাষা গোষ্ঠী থেকে খ্রী:পূ: প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছর আগে 'শতম' শাখা সৃষ্টি হয়।
*আর্য ভাষা গোষ্ঠী*-- ভাষাতত্ত্ব বিদগণ মনে করেন খ্রী:পূ:২৫০০  আর্য ভাষার উদ্ভব হয়।আর্যরা ভারতবর্ষে আসার পর ভারতীয় ভাষার সংমিশ্রণে খ্রী:পূ:১৫০০ থেকে ১২০০ অব্দে জন্ম হয় ভারতীয় আর্য ভাষা।এই ভাষার তিনটি স্তর আছে-
 ১/ প্রাচীন ভারতীয় আর্য ভাষা।
২/ মধ্য ভারতীয় আর্য ভাষা।
৩/ নব্য ভারতীয় আর্য ভাষা।
*প্রাচীন ভারতীয় আর্য ভাষা*-- খ্রী:পূ: ১৫০০-১২০০ অব্দের মধ্যে এর জন্ম ও বিকাশকাল। প্রাচীন ভারতীয় আর্য ভাষায় বেদ রচিত হয়েছে বলে মনে করা হয়।যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ঋগ্বেদ তাই এই ভাষাকে বৈদিক ভাষাও বলা হয়ে থাকে।বৈদিক ভাষার পাশাপাশি সংস্কৃত ভাষার প্রচলন ছিল বৈদিক ও আর্য ভাষা দুটি প্রাচীন ভারতীয় আর্য ভাষা।মূলত আর্যরা এদেশে আসার পরবর্তী সময়ে প্রাচীন ভারতীয় আর্য ভাষার উদ্ভব হয় এবং কালক্রমে বৈদিক ভাষা হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। একসময়ে বৈদিক ভাষা ও স্থানীয় ভাষার সংমিশ্রণে নিজের স্বকীয়তা হারিয়ে ফেলে।বৈদিক ভাষার সংস্কারে সংস্কৃত ভাষার সৃষ্টি হয়।
খ্রী:পূ:৬০০-৫০০অব্দে ব্যাকারণবিদ পাণিনি: ব্যাকারণ রচনার মাধ্যমে বৈদিক ভাষাকে সংস্কার করেন। প্রাচীন ভারতীয় আর্য ভাষার আর একটি রূপ হলো পাণিনির সংস্কার জাত 'সংস্কৃত' ভাষা।সংস্কৃত ভাষাকে তদানীন্তন সাহিত্যিক ভাষা বলা হতো। সমাজের উঁচু শ্রেণীর মানুষেরা এই ভাষা ব্যবহার করতেন।স্থানীয় সাধারণ মানুষ কথা বলত তা ছিল প্রাচীন ভারতীয় আর্য কথ্য ভাষা।
*মধ্য ভারতীয় আর্য ভাষা*-- খ্রী:পূ:৬০০-১০০০অব্দে এই ভাষার উৎকর্ষ ও বিকাশ লাভ করে।পালি,প্রাকৃত ও অপভ্রংশ এসময়ের ভাষারূপ।
*প্রাকৃত ভাষা ও অপভ্রংশ*-- আর্যদের সংস্কৃত ভাষার সাথে স্থানীয় আর্য ভাষার পুণরায় সংমিশ্রণ ঘটে।সংস্কৃত ও স্থানীয় আর্য কথ্যভাষার মিলিত রূপান্তরিত ভাষাকে প্রাকৃত ভাষা বলা হয়।প্রাকৃত হলো কথা বলার ভাষা।যা মানুষের বোধগম্যের ভাষা।রূপান্তরিত প্রাকৃত ভাষা সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক ভাবে প্রসার লাভ করে। পরবর্তী কালে এই প্রাকৃত ভাষা ই ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে কথ্য ভাষায় পরিণত হয়।বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্নতা নিয়ে এই ভাষা ভিন্ন ভিন্ন ভাবে চিহ্নিত হয়।প্রাকৃত ভাষা মগধে- মাগধি প্রাকৃত ভাষা,মহারাষ্ট্রে- মহারাষ্ট্রীয় প্রাকৃত ভাষা,গৌড়ে-গৌড়ীয় প্রাকৃত ভাষা বলে পরিচিতি লাভ করে।লেখার জন্য ব্যবহৃত হতো সংস্কৃত ভাষা।
 *গৌড়ীয় অপভ্রংশ ও মাগধি অপভ্রংশ*-- মাগধি প্রাকৃত ভাষার ব্যাপক বিস্তার ঘটলেও ব্যাকারণবদ্ধ কাঠামো না থাকায় মূল ভাব ও গাম্ভীর্য হারিয়ে ফেলে এবং নানা অপভ্রংশের জন্ম নেয়। অর্থাৎ বিকৃত হওয়ার ফলে গৌড়ীয় অপভ্রংশ ও মাগধি অপভ্রংশ সৃষ্টি হয়।
*নব্য ভারতীয় আর্য ভাষা*-- খ্রী:পূ:১০০০ হতে আধুনিক কাল পর্যন্ত প্রচলিত। বাংলা,হিন্দি,মারাঠি,বিহারী, উড়িয়া,অসমীয়া এই সময়কার ভাষা।মতান্তরে সর্ব শেষ যে অপভ্রংশ তা থেকে বাংলা ভাষার উদ্ভব হয়েছে।
ড: সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় ও স্যার জজ গিয়ারসনের মতে দশম শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে অর্থাৎ ৯৫০খ্রী: অব্দে মাগধি প্রাকৃত ভাষা থেকে বাংলা ভাষার জন্ম হয়েছে।
অপরদিকে ভাষাবিদ ড: মহম্মদ সৈয়দ উল্লাহ্ তাঁর যুক্তি তর্ক দ্বারা প্রমাণ করছেন যে,গৌড়ীয় অপভ্রংশ থেকে বাংলা ভাষার সৃষ্টি হয়েছে যা সপ্তম শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে অর্থাৎ ৬৫০ খ্রী:পূ: অব্দে।ড: মহম্মদ সৈয়দ উল্লাহ্ ৩৫০ খ্রী: চর্চাপদের প্রথম কবি মেনোনাথের আবির্ভাব কাল বিবেচনা করে বাংলা ভাষার উৎপত্তির সাম্ভাব্য সময় স্থির করেন এবং বিখ্যাত পন্ডিত আর্থার বেরিডল কেথ এই যুক্তি কে সমর্থন করেন।
গৌড়ীয় অপভ্রংশ থেকে বিহারী ভাষা সৃষ্টি হয়েছে।বিহারী ভাষা থেকে উড়িয়া ভাষা ও বঙ্গ কামরূপী ভাষা বিভক্ত হয়ে পড়ে।
এই বঙ্গ কামরূপী ভাষা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে অসমীয়া ও বাংলা ভাষার জন্ম হয় আনুমানিক খ্রী:পূ:৬৫০ সালে। এককথায় ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা গোষ্ঠীর 'শতম শাখা'র গর্ভে বাংলা ভাষার মূল শিকড় বলে প্রমাণিত।

Post a Comment