চিন্ময় দাস পরিচয়
ইউনূস সরকার গঠনের পর থেকেই বাংলাদেশ জুড়ে হিন্দু এবং সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতন বেড়েছে বলে অভিযোগ। এই অত্যাচারে প্রতিবাদ জানিয়ে করা সমাবেশগুলিতে হিন্দু এবং সংখ্যালঘুদের অধিকার নিশ্চিত করার দাবি জানিয়ে সোচ্চার হয়ে ওঠেন চিন্ময়কৃষ্ণ। খুবই অল্প সময়ের মধ্যে বাংলাদেশের হিন্দুদের নেতা হয়ে ওঠেন তিনি।
বাংলাদেশের হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলির দাবি, সেই সমাবেশেগুলিতে প্রচুর মানুষ যোগদান করতেন। তাঁরা আসতেন মূলত চিন্ময়কৃষ্ণর বক্তব্য শুনতে। এটাই সেখানে অন্তর্বর্তী সরকারের হৃদয়ে ভয় ধরিয়েছিল। এই কারণেই রাষ্ট্রদ্রোহিতার মিথ্যা মামলায় এবং চক্রান্ত করে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে অভিযোগ।
সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা এবং ধর্মীয় অধিকার নিশ্চিত করা-সহ আট দফা দাবিতে বাংলাদেশ জুড়ে সমাবেশ করছিল হিন্দু সংগঠনগুলি। সেই সমাবেশগুলিতে হাজির থেকে চিন্ময়কৃষ্ণ নিজেদের দাবিগুলি তুলে ধরছিলেন। সংখ্যালঘুদের দমিয়ে রাখতেই তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে দাবি করেছেন সেখানের বিভিন্ন হিন্দু সংগঠনের নেতারা।
কিন্তু কে এই চিন্ময়কৃষ্ণ? জানা গিয়েছে, ৩৯ বছর বয়সী চিন্ময়কৃষ্ণর আসল নাম চিন্ময়কুমার ধর। তাঁর জীবন সম্পর্কে বেশি কিছু জানা যায়নি। তবে, চট্টগ্রাম অঞ্চলের সন্ন্যাসীরা জানিয়েছেন, চিন্ময়ের জন্ম চট্টগ্রামের সাতকানিয়া এলাকার করিয়ানগরে। ১৯৮৫ সালের মে মাসে জন্মগ্রহণ করেন তিনি।
শৈশবকাল থেকেই ধর্মীয় পরিমণ্ডলে বেড়ে উঠেছেন তিনি। মাত্র ১২ বছর বয়সে দীক্ষা নিয়ে তিনি ইসকনের একজন ব্রহ্মচারী হয়েছিলেন। পুন্ডরীক ধামের অধ্যক্ষ হয়ে ওঠেন তিনি। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের হিন্দু, বিশেষ করে বৈষ্ণবদের কাছে পুন্ডরীক ধাম একটি পবিত্র ধর্মীয় স্থান।
সকলের কাছে তিনি পরিচিত চিন্ময় প্রভু নামে। তাঁকেই বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র করা হয়। সেখানকার হিন্দু সংগঠনের নেতারা জানান, হিন্দুদের উপর অত্যাচার করে যখন তাঁদের চুপ করিয়ে দেওয়া হচ্ছে তখনই সোচ্চার হয়েছিলেন চিন্ময়কৃষ্ণ। তাঁকেও চুপ করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। এই কারণেই তিনি টার্গেট হয়েছিলেন।
চিন্ময় দাস কে?
চট্টগ্রামের হাটহাজারীর পুন্ডরীক ধামের অধ্যক্ষ চিন্ময় কৃষ্ণ ব্রহ্মচারী। সম্প্রতি গঠিত বাংলাদেশ সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। চট্টগ্রাম নগরীর নিউমার্কেট মোড়ের স্বাধীনতা স্তম্ভে জাতীয় পতাকা অবমাননার অভিযোগে তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়, যার পরিপ্রেক্ষিতে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এই ঘটনার পরপরই প্রতিবাদ ও নিন্দা জানায় ভারত এবং দেশটির শাসক দল বিজেপি।
চিন্ময় কৃষ্ণ দাস আসল নাম ছিল চন্দন কুমার ধর। বাংলাদেশে ইসকনের সংগঠকদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন চিন্ময় কৃষ্ণ দাশ ব্রহ্মচারী। ভক্তরা তাকে ডাকেন ‘চিন্ময় প্রভু’ নামে। কিন্তু সংগঠনের শৃঙ্খলাবিরোধী কার্যকলাপের কারণে তিনিসহ আরও কয়েকজনকে গত জুলাই মাসে ইসকন থেকে বহিষ্কার করা হয়।
তবে গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর একাধিক সমাবেশের নেতৃত্ব দেন তিনি। তার দাবি, সনাতন ধর্মাবলম্বীদের উপর হওয়া 'নিপীড়নের' বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতেই এ সমাবেশ। তবে তার কর্মকাণ্ড নিয়ে বিতর্ক দানা বাঁধে। বিশেষত গত অক্টোবরে চট্টগ্রামে একটি মিছিলের সময় বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার অবমাননার অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে।
পরে গত ৯ নভেম্বর রাজধানীর স্বামীবাগ ইসকন আশ্রমে ‘ইসকন বাংলাদেশ’ আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনের বক্তব্যে সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক চারু চন্দ্র দাস ব্রহ্মচারী বলেন, সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে ইসকনের যাবতীয় কার্যক্রম থেকে চট্টগ্রামের পুন্ডরীক ধামের অধ্যক্ষ চিন্ময় কৃষ্ণ দাস, প্রবর্তক শ্রীকৃষ্ণ মন্দিরের অধ্যক্ষ লীলারাজ গৌরদাস ও সদস্য স্বতন্ত্র গৌরাঙ্গ দাসকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। বহিষ্কৃতদের মাধ্যমে সংঘটিত কোনো কার্যক্রমে ইসকন জড়িত নয়।
জাতীয় পতাকার অবমাননার ঘটনায় তার বিরুদ্ধে মামলাও করা হয়, যে মামলায় বর্তমানে তিনি কারাবন্দী। তবে তার সমর্থকদের দাবি, তাকে গ্রেপ্তারের বিষয়টি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশের প্রতিবাদে আদালত প্রাঙ্গণে বিক্ষোভ করেছেন সনাতন সম্প্রদায়ের কয়েক হাজার মানুষ।
হাইকোর্টের কর্মকর্তা- কর্মচারীদের সম্পদ বিবরণী দাখিলের নির্দেশহাইকোর্টের কর্মকর্তা- কর্মচারীদের সম্পদ বিবরণী দাখিলের নির্দেশ
ধর্মীয় এই নেতাকে গ্রেপ্তারের বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের মুখপাত্র তালেবুর রহমান জানিয়েছেন, কৃষ্ণ দাসের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্তাধীন রয়েছে। তবে সুনির্দিষ্টভাবে কী অভিযোগ আনা হয়েছে, সে বিষয়ে বিস্তারিত কিছু জানানো হয়নি।
গ্রেফতার ও কারাবরণ
২০২৪ সালের ২৪শে নভেম্বরে চিন্ময়কে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ ঢাকা বিমানবন্দর থেকে গ্রেপ্তার করে। জাতীয় পতাকার উপরে গেরুয়া পতাকা উত্তোলনের অভিযোগে একটি সমাবেশ সম্পর্কিত অভিযোগের পরে তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ আনা হয়েছিল। চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীকে ২০২৪ সালের ২৬শে নভেম্বর চট্টগ্রাম ষষ্ঠ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করা হয়, যেখানে ম্যাজিস্ট্রেট কাজী শরিফুল ইসলাম তার জামিন আবেদন নাকচ করে তাকে আটকের আদেশ দেন। তার আইনজীবীরা হেফাজতে থাকাকালীন তাকে ধর্মীয় অনুশীলন অনুসরণ করার অনুমতি দেওয়ার অনুরোধ করেছিলেন, যাতে আদালত কারাগারের নিয়ম মেনে চলার নির্দেশ দেয়।
তার জামিন মঞ্জুর না হওয়ার পর, তার অনুসারীরা আদালত ভবনের সামনে বিক্ষোভ করে, যেটি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষের পর সহিংস হয়ে উঠে। সহিংসতার সময়, সাইফুল ইসলাম আলিফ নামে রাষ্ট্রপক্ষের এক আইনজীবীকে কিছু ব্যক্তি কুপিয়ে হত্যা করে।তার মৃত্যুতে আইনজীবী ও বিভিন্ন সংগঠন দেশজুড়ে পাল্টা বিক্ষোভ করে এবং ইসকন নিষিদ্ধের দাবি জানায়। প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস এই হত্যাকাণ্ডের নিন্দা জানান এবং ঘটনাটির যথাযথ তদন্তের আহ্বান জানান।
প্রতিক্রিয়া
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তার গ্রেফতারের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে এবং শান্তিপূর্ণ সমাবেশের অধিকারের ওপর জোর দিয়ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য বাংলাদেশ সরকারকে আহ্বান জানিয়েছে।বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে হিন্দু ধর্মীয় নেতা চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের গ্রেফতার নিয়ে ভারত সরকারের এই বক্তব্যকে “ভিত্তিহীন” অভিহিত করে বলেছে, এ’ধরনের বক্তব্য দু’দেশের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের পরিপন্থী। পাশাপাশি বলা হয় ভারত চিন্ময় দাসের গ্রেফতারের ভুল ব্যাখ্যা দিয়েছে।