ইজতেমা বলতে কি বুঝায়।ইজতেমা কি।ইজতেমা কি জায়েজ।ইজতেমা কি বিদআত

ইজতেমা কি?

ইজতেমা একটি বৃহৎ ধর্মীয় সমাবেশ, যা মূলত ইসলাম ধর্মের অনুসারীরা আয়োজন করে। এটি সাধারণত বিশ্ব ইজতেমা বা তাবলিগ জামাতের ইজতেমা নামে পরিচিত।

ইজতেমার বৈশিষ্ট্য ও গুরুত্ব
  • ১. ধর্মীয় সমাবেশ: ইজতেমা ইসলামের শিক্ষাগুলো প্রচার এবং ধর্মীয় জ্ঞান অর্জনের উদ্দেশ্যে আয়োজন করা হয়।
  • ২. স্থান: বাংলাদেশে এটি মূলত টঙ্গী, গাজীপুরের তুরাগ নদীর তীরে অনুষ্ঠিত হয়। এটি বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম জমায়েত (হজের পর)।
  • ৩. আয়োজক: ইজতেমা তাবলিগ জামাত কর্তৃক আয়োজিত হয়। এটি কোনও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে নয় বরং ধর্মীয় ও আত্মশুদ্ধির উদ্দেশ্যে করা হয়।
  • ৪. মেয়াদ: ইজতেমা সাধারণত তিন দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত হয় এবং এতে কোরআন, হাদিসের আলোচনার পাশাপাশি দোয়া ও ধর্মীয় উপদেশ প্রদান করা হয়।
  • ৫. আন্তর্জাতিক অংশগ্রহণ: এখানে দেশ-বিদেশের মুসলমানরা অংশগ্রহণ করেন।
কার্যক্রম
  • নামাজ আদায়
  • তাবলিগি বয়ান (ধর্মীয় আলোচনাসভা)
  • দোয়া ও মোনাজাত
  • ইসলামের শিক্ষা ও দাওয়াত প্রচার
বিশেষত্ব
বিশ্ব ইজতেমা মুসলমানদের মাঝে ঐক্য, শান্তি, সম্প্রীতি এবং ধর্মীয় মূল্যবোধ বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

বাংলাদেশে এটি প্রতি বছর জানুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত হয় এবং এর দ্বিতীয় পর্যায়ে স্থানীয় মুসলিমদের জন্য পৃথক তারিখ নির্ধারণ করা হয়।

ইজতেমা কি জায়েজ

ইজতেমা ইসলামিক দৃষ্টিকোণ থেকে জায়েজ এবং একটি প্রশংসনীয় কাজ, যদি তা কোরআন ও সুন্নাহর আলোকে পরিচালিত হয় এবং তাতে কোনও বিদআত বা শরীয়তের পরিপন্থী কিছু না থাকে। ইজতেমা মূলত ইসলাম প্রচার, দাওয়াত এবং মুসলিমদের মাঝে ধর্মীয় শিক্ষা ও ঐক্য গড়ে তোলার একটি মাধ্যম।

কেন ইজতেমা জায়েজ?
১. দাওয়াতের কাজ: ইজতেমার মূল উদ্দেশ্য হলো ইসলাম ধর্মের মূল শিক্ষা প্রচার করা, যা ইসলামে একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। কোরআনে বলা হয়েছে:

"তোমাদের মধ্যে একটি দল থাকা উচিত যারা কল্যাণের দিকে আহ্বান জানাবে এবং সৎকর্মের আদেশ দিবে ও অসৎকর্মের নিষেধ করবে। তারাই সফলকাম।"
(সূরা আল ইমরান: ১০৪)

২. একত্রিত হওয়া: মুসলমানদের একত্রিত হওয়া এবং আল্লাহর ইবাদত করা একটি প্রশংসনীয় কাজ। হাদিসে এসেছে:

"যখন লোকেরা আল্লাহর ঘরে একত্র হয়ে কোরআন তিলাওয়াত করে এবং পরস্পরের মধ্যে শিক্ষা দেয়, তখন তাদের ওপর প্রশান্তি নাযিল হয়, রহমত তাদের ঢেকে ফেলে এবং ফেরেশতারা তাদেরকে পরিবেষ্টন করে।"
(সহিহ মুসলিম: ২৬৯৯)

৩. বিদআত বর্জন: ইজতেমা তখনই জায়েজ ও গ্রহণযোগ্য হবে, যদি এতে কোনও বিদআত (ধর্মে নতুন সংযোজন) বা শরীয়তের বিরোধী কর্মকাণ্ড না ঘটে।

ইজতেমা করার শর্ত
  • কোরআন ও সুন্নাহর নির্দেশনা মেনে চলা।
  • কোনও প্রকার শিরক, বিদআত বা অন্যায় কাজ না করা।
  • ইবাদতের উদ্দেশ্যে একত্র হওয়া ও আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করা।
উপসংহার
যদি ইজতেমা কোরআন-সুন্নাহর আলোকে পরিচালিত হয় এবং উদ্দেশ্য হয় ইসলাম প্রচার, আত্মশুদ্ধি এবং মুসলমানদের মধ্যে ঐক্য স্থাপন, তবে তা সম্পূর্ণভাবে জায়েজ এবং একটি উত্তম কাজ। তবে এতে কোনও শিরক বা বিদআত যুক্ত হলে তা পরিহার করা আবশ্যক।

বিশ্ব ইজতেমার সংক্ষিপ্ত পরিচিতি

১. স্থান:
বিশ্ব ইজতেমা সাধারণত বাংলাদেশে গাজীপুর জেলার টঙ্গী তে তুরাগ নদীর তীরে অনুষ্ঠিত হয়।

২. শুরু:
বিশ্ব ইজতেমা শুরু হয়েছিল ১৯৪৬ সালে, ঢাকার কাকরাইল মসজিদে। এরপর ১৯৬৭ সাল থেকে এটি টঙ্গীতে অনুষ্ঠিত হচ্ছে।

৩. আয়োজক:
তাবলিগ জামাত বিশ্ব ইজতেমার প্রধান আয়োজক। এটি কোনও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নয় বরং ধর্ম প্রচার, আত্মশুদ্ধি এবং ইসলামের আহ্বান পৌঁছানোর জন্য আয়োজন করা হয়।

৪. অংশগ্রহণ:

এ অনুষ্ঠানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে লাখ লাখ মুসলিম অংশগ্রহণ করেন।
এটি হজের পর মুসলিমদের দ্বিতীয় বৃহত্তম জমায়েত হিসেবে বিবেচিত হয়।
বিশ্ব ইজতেমার প্রধান কার্যক্রম
১. বয়ান (ধর্মীয় আলোচনা):
আলেম ও ইসলাম প্রচারকগণ কোরআন, হাদিস এবং ইসলামের মূল শিক্ষা নিয়ে বয়ান করেন।

২. ইবাদত ও দোয়া:
পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায়।
বিশেষ দোয়া ও মোনাজাত, যেখানে লাখ লাখ মানুষ আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা ও কল্যাণের জন্য প্রার্থনা করেন।
৩. আত্মশুদ্ধি ও দাওয়াত:
ব্যক্তি জীবনে ইসলামি মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার জন্য মানুষকে উৎসাহিত করা হয়।
ইসলামের দাওয়াত মানুষের মাঝে পৌঁছে দেওয়ার তাগিদ দেওয়া হয়।
৪. আখেরি মোনাজাত:
ইজতেমার শেষ দিন অনুষ্ঠিত হয় বিশেষ মোনাজাত। এতে সারা বিশ্বের মুসলিম উম্মাহর শান্তি, কল্যাণ ও একতা কামনা করা হয়।

বিশ্ব ইজতেমার গুরুত্ব
  • ঐক্য: মুসলিম উম্মাহর মধ্যে ঐক্য, ভ্রাতৃত্ব ও সম্প্রীতি গড়ে তোলা।
  • আত্মশুদ্ধি: মানুষের মাঝে আল্লাহভীতি এবং আত্মশুদ্ধির অনুভূতি জাগ্রত করা।
  • ইসলাম প্রচার: দাওয়াত ও তাবলিগের মাধ্যমে ইসলামের শিক্ষা সবার মাঝে পৌঁছে দেওয়া।
  • আন্তর্জাতিক মিলনমেলা: এটি বিশ্বের মুসলমানদের একটি বৃহৎ মিলনমেলা।
বিশেষ তথ্য
বিশ্ব ইজতেমা দুই পর্বে অনুষ্ঠিত হয়, যাতে অংশগ্রহণকারীদের ভিড় নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
সারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে তাবলিগ জামাতের অনুসারীরা এতে অংশ নেন।
বিশ্ব ইজতেমা শুধু একটি ধর্মীয় সমাবেশ নয়, এটি মুসলমানদের জন্য একটি আত্মশুদ্ধি, ঐক্য ও ইসলামের দাওয়াতের বিশ্বজনীন প্ল্যাটফর্ম।

বিশ্ব ইজতেমা নিয়ে প্রচলিত ভুল ধারণা

টঙ্গীর তুরাগ নদীর তীরে আয়োজিত বিশ্ব ইজতেমা মুসলিমদের অন্যতম বৃহৎ গণজমায়েত হিসেবে পরিচিত। প্রতিবছর ইজতেমাকে কেন্দ্র করে তুরাগ তীরের এলাকায় এক ধরনের ধর্মীয় পরিবেশ সৃষ্টি হয়। তবে মহত্আয়োজনে কিছু ভুল ধারণাও ছড়িয়ে পড়ে, যা তাবলিগ জামাতের মূল আদর্শ বা ইসলামি শিক্ষার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। এই নিবন্ধে বিশ্ব ইজতেমা সম্পর্কিত কয়েকটি প্রচলিত ভুল ধারণা সেসব বিষয়ে আলেমদের মতামত তুলে ধরা হলো।

. গরিবের হজ ধারণা

অনেকেই মনে করেন, বিশ্ব ইজতেমা "গরিবের হজ" কেউ কেউ বিশ্বাস করেন, তিনবার বিশ্ব ইজতেমায় অংশগ্রহণ করলে তা একটি হজের সমান। তবে এই ধারণা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন।

হজ ইসলামের পঞ্চ স্তম্ভের একটি ফরজ বিধান। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন:
وَلِلَّهِ عَلَى النَّاسِ حِجُّ الْبَيْتِ مَنِ اسْتَطَاعَ إِلَيْهِ سَبِيلًا
(
সূরা আল ইমরান, আয়াত ৯৭)
অর্থাৎ, "সামর্থ্যবান মানুষের ওপর আল্লাহর উদ্দেশ্যে বায়তুল্লাহর হজ করা ফরজ।"

বিশ্ব ইজতেমা, যা শুরু হয় ১৯৬৬ সালে, এটি ইসলামের ফরজ, সুন্নত বা মুস্তাহাব কোনো বিধানের অন্তর্ভুক্ত নয়। বরং এটি তাবলিগ জামাতের মাধ্যমে ঈমান আমল সংক্রান্ত শিক্ষা তাবলিগের কাজের প্রচার-প্রসারে একটি আয়োজন। আলেমরা একমত যে, হজের সঙ্গে ইজতেমার তুলনা ইসলামি আকিদার পরিপন্থী।

. ইজতেমার জুমার নামাজের বিশেষ ফজিলত

বিশ্ব ইজতেমার সময় দেশের বৃহত্তম জুমার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে লাখ লাখ মানুষ অংশ নেন। জুমায় অংশগ্রহণকে বিশেষ ফজিলতপূর্ণ বলে মনে করেন কেউ কেউ। তারা বিশ্বাস করেন, এতে নামাজ আদায় করলে বা আখেরি মোনাজাতে অংশ নিলে আল্লাহ সকল গুনাহ মাফ করে দেন।

মুফতি আতাউল করিম মাকসুদের মতে, বৃহৎ জমায়েতে দোয়া ইবাদতের কবুল হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকলেও, জুমার নামাজের বিশেষ ফজিলত সম্পর্কে কোনো নির্দিষ্ট হাদিস নেই। বরং এটি শুধুমাত্র মুসলমানদের একটি বড় আকারের সম্মিলন।

. আখেরি মোনাজাত দোয়া কবুলের ধারণা

বিশ্ব ইজতেমার শেষ দিন আখেরি মোনাজাতের মাধ্যমে সমাপ্ত হয়। অনেকেই মনে করেন, মোনাজাতে অংশগ্রহণ করলে দোয়া নিশ্চিতভাবে কবুল হয়।

আলেমদের মতে, সম্মিলিতভাবে দোয়া করলে তা কবুল হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তবে দোয়া কবুল হবে কি না, তা একান্তই আল্লাহর ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল। বিষয়ে আল্লাহর রাসূলের (সা.) কোনো বিশেষ নির্দেশনা নেই।

. ইজতেমার ফজিলত নিয়ে ভিত্তিহীন দাবি

বিশ্ব ইজতেমার ফজিলত সম্পর্কে কোনো বিশেষ হাদিস বা নবীজির (সা.) নির্দেশনা নেই। আলেমরা উল্লেখ করেছেন, ইসলামে আমলের ফজিলত নির্ধারণের জন্য রাসূলের (সা.) হাদিস থাকা জরুরি। তাই ইজতেমার ফজিলত সম্পর্কে অতিরঞ্জিত দাবি করা বা ভিত্তিহীন ধারণা পোষণ করা ঠিক নয়।

উপসংহার

বিশ্ব ইজতেমা তাবলিগ জামাতের মাধ্যমে ইসলামি শিক্ষা, ঈমান আমল বাড়ানোর একটি উদ্যোগ। তবে এটিকে হজের বিকল্প বা কোনো বিশেষ ফজিলতপূর্ণ ইবাদত মনে করা ইসলামি আকিদার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ধরনের ভুল ধারণা দূর করে ইজতেমার প্রকৃত উদ্দেশ্য বুঝে অংশ নেওয়াই ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে সমীচীন।

Post a Comment