জলবায়ু পরিবর্তন ও বাংলাদেশ রচনা ৩০ পয়েন্ট।বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তন ও বাংলাদেশ রচনা।জলবায়ু পরিবর্তন ও বাংলাদেশ রচনা hsc

সূচনা:

বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তন বাংলাদেশে অস্থায়ী ও স্থায়ীভাবে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পরিবেশগত বিপর্যয় বাংলাদেশের জন্য একটি দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, যা দেশের বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের বাংলাদেশ জাতীয় পরিবেশ ব্যবস্থাপনা কর্মপরিকল্পনায় বিশেষভাবে উল্লেখিত হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন একটি দেশকে কীভাবে প্রভাবিত করছে, তা চারটি মূল দিক দিয়ে মূল্যায়ন করা হয়: (১) কোন জনগণ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, (২) কোথায় প্রাকৃতিক দুর্যোগ বেশি ঘটছে, (৩) কোথায় জনসংখ্যা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং (৪) ক্ষতিগ্রস্ত দেশটি কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করছে তা মোকাবিলা করার জন্য।


বাংলাদেশে সমুদ্রস্তরের উচ্চতা বৃদ্ধি, লবণাক্ততার সমস্যা, হিমালয়ের বরফ গলার কারণে নদী পরিবর্তন, বন্যা ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের মাত্রা বেড়েছে। আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান জার্মান ওয়াচ ২০১০ সালে প্রকাশিত গ্লোবাল ক্লাইমেট রিস্ক ইনডেক্স অনুযায়ী, ১৯৯০ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত ১৯৩টি দেশের মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ প্রথম স্থানে অবস্থান করছে। ২০০৭ ও ২০০৮ সালের প্রতিবেদনে বাংলাদেশ একইভাবে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।

জলবায়ু

বাংলাদেশে ঋতুবৈচিত্র্য দীর্ঘদিন ধরে বিদ্যমান থাকলেও জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এই চিত্রটি অনেকটা পরিবর্তিত হয়েছে। বিশেষত, বর্ষা মৌসুমে অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত এবং তার পরবর্তী সময়ে ঘূর্ণিঝড়, টর্নেডো এবং সাগরে নিম্নচাপ, ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস প্রভৃতির কারণে বাংলাদেশ নিয়মিতভাবে আক্রান্ত হচ্ছে। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এই স্বাভাবিক চিত্রটি এখন বদলে গেছে। তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাত, বায়ুপ্রবাহ এবং সমুদ্রস্তর সব দিক থেকেই উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটছে, যা বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবকে আরও প্রকট করে তুলছে।


জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বৃষ্টিপাত কমে যাওয়ায় নদ-নদীর পানির প্রবাহ যথাযথভাবে স্বাভাবিক থাকে না, বিশেষত শুকনো মৌসুমে। ফলে সমুদ্রের লোনা পানি স্থলভাগে চলে আসার ফলে উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, কম বৃষ্টিপাত এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততার সমস্যা আরো তীব্র হবে, যার প্রভাব পড়ছে দেশের পরিবেশ ও প্রাকৃতিক সম্পদে। সুন্দরবনে গাছপালা ও প্রাণীজগতের ক্ষতি হচ্ছে, বিশেষত আগামরা রোগের কারণে সুন্দরীগাছ আক্রান্ত হচ্ছে।


বাংলাদেশের তাপমাত্রা গত কয়েক দশকে অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পেয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ১৯৬০ সালে বঙ্গীয় এলাকায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৪২.৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা ১৯৭২ সালে ৪৫.১ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছায়। তাপমাত্রার এই পরিবর্তন, বিশেষত শহরাঞ্চলে, প্রাকৃতিক পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে। ঢাকায় গড় তাপমাত্রা ১৯৯৫ সালের মে মাসের তুলনায় এক ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে এবং নভেম্বর মাসে ১৪ বছর আগের তুলনায় ০.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেয়েছে।


এছাড়া, বাংলাদেশের গড় বৃষ্টিপাত কমে যাওয়ার কারণে কৃষি ও পানির ব্যবস্থাপনা সংকটে পড়ছে। ২০০৮ সালে বাংলাদেশের গড় বৃষ্টিপাত ছিল ২৩০০ মিলিমিটার, যা বর্তমানে অনেকটাই কমেছে। খরার ফলে বাংলাদেশে কৃষক ও মৎস্যজীবীদের জীবনযাত্রা দুর্বিষহ হয়ে উঠছে, বিশেষত উত্তরাঞ্চলের কৃষকরা ভূগর্ভস্থ পানি কমে যাওয়ার কারণে বিপদগ্রস্ত হচ্ছেন। গবেষণায় পূর্বাভাস দেয়া হয়েছে যে, ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশে প্রায় ৮০ লাখ মানুষ খরার কারণে উদ্বাস্তু হতে পারে।

দূযোর্গ:

প্রাকৃতিক দুর্যোগের পরিমাণও বাড়ছে, যেমন ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, নদীভাঙন এবং ভূমিধস। ১৯৯০ সালের পর থেকে বাংলাদেশে এসব দুর্যোগের ঘনত্ব বেড়েছে এবং বর্তমানে প্রতি দু-তিন বছর পরপর বড় ধরনের দুর্যোগ আঘাত হানছে। জলবায়ু পরিবর্তন একদিকে যেমন প্রাকৃতিক সম্পদের ক্ষতি করছে, অন্যদিকে মানুষের জীবনযাত্রার ওপরও মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। একে সামাল দিতে আন্তর্জাতিক সমুদ্রতীরবর্তী দেশের তালিকায় বাংলাদেশ উচ্চ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।


বাংলাদেশের কৃষি খাতও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিপদগ্রস্ত হচ্ছে। অনিয়মিত ও অপর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত, সেচের পানির সংকট এবং উপকূলীয় অঞ্চলের জমি লবণাক্ত পানিতে ডুবে যাওয়ার কারণে বাংলাদেশের কৃষির ভবিষ্যৎ চরমভাবে হুমকির মুখে। বিশেষ করে মৎস্য খাতের ওপর তীব্র প্রভাব পড়ছে, কারণ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে মৌসুমি বৃষ্টিপাতের ধরণ বদলাচ্ছে, যা মাছের প্রজনন ও উৎপাদন ব্যাহত করছে।


সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্যও বিপন্ন হয়ে পড়ছে। সমুদ্রস্তরের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে রॉयাল বেঙ্গল টাইগারের বিচরণভূমি কমে যাচ্ছে, ফলে বাঘের সংখ্যা কমে যাবে। এছাড়া, গাঙ্গে বিচরণকারী শুশুক এবং মায়া হরিণের মতো প্রজাতিও হুমকির মুখে পড়বে।


বাংলাদেশের জনগণের স্বাস্থ্যঝুঁকিও বেড়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে শ্বাসকষ্ট, হিটস্ট্রোক এবং ঠান্ডাজনিত মৃত্যুর হার বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়া, প্রাকৃতিক দুর্যোগের পরিমাণ বৃদ্ধি পেলে শহরের দিকে মানুষের অস্বাভাবিক পরিমাণে উদ্বাস্তু হওয়ার প্রবণতা বাড়ে, যার ফলে শহরগুলোর জনসংখ্যা বেড়ে গিয়ে বসবাসের পরিবেশ আরও খারাপ হয়ে ওঠে। শহরের জনগণের জন্য এই অতিরিক্ত চাপ সুরক্ষা, কর্মসংস্থান এবং উন্নয়ন কার্যক্রমের জন্য একটি বড় প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

উপহংসার:

জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বাংলাদেশ সরকারকে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ করতে হয়, যার ফলে অন্যান্য উন্নয়ন প্রকল্পে বাধা সৃষ্টি হচ্ছে। সমাজের বিভিন্ন স্তরে এই পরিবেশগত পরিবর্তনের ফলে সামাজিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক সংকট এবং আইনশৃঙ্খলা অবনতির মতো সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে।


২.

জলবায়ু পরিবর্তন ও বাংলাদেশ

বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তন একদিকে যেমন পরিবেশ, প্রাকৃতিক সম্পদ এবং জীববৈচিত্র্যের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে, অন্যদিকে মানব জীবনের বিভিন্ন দিকেও গভীর পরিবর্তন ঘটাচ্ছে। বাংলাদেশ, একটি নিম্নাঞ্চলীয় দেশ হিসেবে, জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাবের শিকার হয়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। দেশের প্রাকৃতিক পরিবেশ, কৃষি, অর্থনীতি এবং জনগণের জীবনযাত্রায় এই পরিবর্তন একটি গভীর চ্যালেঞ্জ হিসেবে দাঁড়িয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্য, কৃষি উৎপাদন এবং মানুষের স্বাস্থ্যসহ নানা ক্ষেত্রে বিপর্যয় সৃষ্টি হচ্ছে, যা ভবিষ্যতে দেশের উন্নয়নকে অন্তরায় হিসেবে দাঁড়াবে।


জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব

বাংলাদেশের ভূগোল, জনসংখ্যা এবং অর্থনীতির প্রেক্ষাপটে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব অত্যন্ত তীব্র। সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি, অতিরিক্ত তাপমাত্রা, মৌসুমি বায়ুর পরিবর্তন এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঘনঘনতা বাড়ছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাওয়ায় বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের অধিকাংশ এলাকা পানিতে ডুবে যেতে পারে, যার ফলে ব্যাপকভাবে জনসাধারণের জীবিকা, বসবাস এবং কৃষি উৎপাদন প্রভাবিত হবে। বিশেষ করে, সুন্দরবন এবং অন্যান্য উপকূলীয় বনাঞ্চলগুলোর অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়বে, যা দেশের জীববৈচিত্র্য এবং পরিবেশের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।


তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও বৃষ্টিপাতের অস্বাভাবিকতা বাংলাদেশের কৃষি খাতকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করছে। মৌসুমি বায়ু এবং বর্ষা মৌসুমের সময় বৃষ্টিপাতের অনিয়মিত হওয়া, সেচের পানি সংকট, নদীভাঙন এবং লবণাক্ততা বৃদ্ধি বাংলাদেশের কৃষকদের জন্য অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে। বিশেষত, উপকূলীয় অঞ্চলের কৃষকরা লবণাক্ত পানির কারণে তাদের জমি হারাচ্ছে, যা খাদ্য উৎপাদন ও কৃষি অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলছে।


জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতেও নানা ধরনের সমস্যা দেখা দিচ্ছে। তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে শ্বাসকষ্ট, হিটস্ট্রোক, জলবাহিত রোগ ও ঠান্ডাজনিত রোগের প্রবণতা বাড়ছে। এ ছাড়া প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে বিপুলসংখ্যক মানুষ আশ্রয়হীন হয়ে পড়ছে, যার ফলে তাদের স্বাস্থ্যঝুঁকি আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে।


জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য বাংলাদেশ দায়ী নয়, তবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সবচেয়ে বেশি

বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে গ্রীণহাউস গ্যাস নিঃসরণের পরিমাণ অনেক কম, তবে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশের ক্ষতি সবচেয়ে বেশি হচ্ছে। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি, অস্বাভাবিক বৃষ্টিপাত ও সৃষ্ট প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রভাবে বাংলাদেশ অধিক ক্ষতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানের র‌্যাংকিংয়ে শীর্ষে অবস্থান করছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রকৃতির নানা দুর্যোগের আঘাত বাড়ছে, যা দেশটির জনগণ, অর্থনীতি এবং প্রকৃতিকে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।


বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় পদক্ষেপ

বাংলাদেশ সরকার এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। সরকারের জাতীয় জলবায়ু পরিবর্তন কৌশল (National Climate Change Strategy) এবং পরিবেশ সংরক্ষণ সংক্রান্ত বিভিন্ন আইন প্রণয়ন এরই অংশ। এছাড়া, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চুক্তি ও সহায়তা পেতে বাংলাদেশের সরকার বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে অংশগ্রহণ করছে। সরকারের পাশাপাশি, বিভিন্ন এনজিও ও সামাজিক সংগঠনও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় জনগণকে সচেতন করার এবং অভিযোজনের জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে।


উপসংহার

বাংলাদেশ একটি জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশ এবং দেশটির অনেক উন্নয়ন কার্যক্রম জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব থেকে দেশের জনগণ, বিশেষত কৃষক, মৎস্যজীবী, উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষ ও গরিব জনগণ অত্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তবে সরকারের ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলা করার জন্য নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় জনগণ, সরকার ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে একযোগে কাজ করতে হবে, যাতে বাংলাদেশ তার প্রাকৃতিক পরিবেশ এবং জনগণের জীবনমান রক্ষা করতে পারে।

Post a Comment