ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে তাবলীগ বা দ্বীন প্রচার করা একটি মহৎ কাজ এবং তা জায়েজ। তাবলীগের মাধ্যমে মানুষকে ইসলামের মৌলিক শিক্ষা, আল্লাহর পথে আসার দাওয়াত এবং সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ করার আহ্বান জানানো হয়, যা কুরআন ও হাদিসের শিক্ষার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
কুরআন ও হাদিসে দাওয়াতের গুরুত্ব:
কুরআনে বলা হয়েছে:
- “তোমাদের মধ্যে এমন একটি দল থাকা উচিত যারা মানুষকে কল্যাণের দিকে আহ্বান জানাবে, সৎ কাজের আদেশ দেবে এবং অসৎ কাজ থেকে বিরত রাখবে।”
(সূরা আলে ইমরান: ১০৪)
হাদিসে এসেছে:
- রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “তোমরা ভালো কথা প্রচার করো এবং খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখো। যদি তা না করো, তবে আল্লাহ তোমাদের উপর শাস্তি পাঠাবেন।”
(তিরমিজি, হাদিস: ২১৭২)
তবে তাবলীগের পদ্ধতি ও কর্মসূচি শরিয়তের সীমার মধ্যে হতে হবে। কোনো রকম বাড়াবাড়ি, শিরক বা বিদআতের মতো কাজ এড়ানো উচিত। তাবলীগ জামাত একটি বিশেষ পদ্ধতিতে কাজ করে, যা মূলত আল্লাহর পথে মানুষকে আহ্বান করার একটি সংগঠিত উদ্যোগ। এটি জায়েজ এবং প্রশংসনীয়, যতক্ষণ এটি ইসলামের মৌলিক বিধান ও আকীদার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ থাকে।
তাবলীগ জামাতের ইতিহাস
তাবলীগ জামাতের ইতিহাস শুরু হয় ১৯২৬ সালে ব্রিটিশ শাসিত ভারতের মেওয়াত অঞ্চলে। এই জামাত প্রতিষ্ঠা করেন একজন ইসলামি পণ্ডিত এবং আলেম মাওলানা মুহাম্মদ ইলিয়াস কান্ধলভী (রহ.)। তিনি তখনকার সমাজে মুসলমানদের ধর্মীয় জীবন থেকে দূরে সরে যাওয়া এবং ইসলামি চর্চার অভাব দেখে দাওয়াতি আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন।
প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট:
১. মেওয়াত অঞ্চলের অবস্থা: মেওয়াতের মুসলমানরা তখন ধর্মীয় শিক্ষা ও চর্চা থেকে অনেক দূরে ছিল। হিন্দু সংস্কৃতি ও রীতিনীতি তাদের জীবনে প্রভাব ফেলেছিল, ফলে তারা ইসলামি আদর্শ থেকে বিচ্যুত হচ্ছিল।
২. প্রাথমিক লক্ষ্য: মাওলানা ইলিয়াস (রহ.) প্রথমে নিজের এলাকায় ধর্মীয় পুনর্জাগরণের জন্য কাজ শুরু করেন। তিনি মসজিদে ধর্মীয় শিক্ষা প্রচলন, নামাজের গুরুত্ব বোঝানো এবং ইসলামের মৌলিক বিষয়গুলোকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য উদ্যোগ নেন।
তাবলীগ জামাতের শুরু:
- ১৯২৬ সালে মেওয়াত থেকে যাত্রা:
মাওলানা ইলিয়াস (রহ.) মেওয়াত অঞ্চলে "দাওয়াত ও তাবলীগ" নামে এই আন্দোলনের সূচনা করেন। তার স্লোগান ছিল:
"আ’ও, মুসলমান বনা’ও" (এসো, মুসলমান হও)।
- ছয় মৌলিক বিষয়ের ভিত্তি:
তিনি তাবলীগ জামাতের কাজকে সহজ ও প্রভাবশালী করার জন্য ছয়টি মৌলিক বিষয় নির্ধারণ করেন। এই বিষয়গুলো এখনো তাবলীগ জামাতের মূল কাঠামো:
- ঈমান ও ইয়াকিন (আল্লাহর প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস)।
- নামাজের গুরুত্ব ও আদায়।
- ইলম (জ্ঞান) ও জিকির (আল্লাহর স্মরণ)।
- মুসলমানদের প্রতি ইখলাস বা আন্তরিকতা।
- দাওয়াত ও তাবলীগের কাজ।
- জীবনে ইসলামি আদর্শ অনুসরণ।
তাবলীগ জামাতের প্রসার:
১. তৃতীয় আমিরের নেতৃত্বে বিস্তার:
মাওলানা ইলিয়াস (রহ.)-এর মৃত্যুর পর তার ছেলে মাওলানা ইউসুফ (রহ.) এবং পরবর্তীতে মাওলানা ইন’আমুল হাসান (রহ.) তাবলীগ জামাতের নেতৃত্ব দেন। তাদের সময়ে এটি উপমহাদেশের বাইরে মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা, ইউরোপ, আমেরিকা এবং বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে।
২. আলমি মারকাজ:
তাবলীগ জামাতের মূল কেন্দ্রস্থল (মারকাজ) হলো নয়াদিল্লির বস্তি নিজামুদ্দিন। এখান থেকে জামাতের কার্যক্রম পরিচালিত হয়।
৩. বিশ্ব ইজতেমা:
বাংলাদেশে প্রতিবছর আয়োজিত টঙ্গীর বিশ্ব ইজতেমা তাবলীগ জামাতের অন্যতম বৃহৎ সমাবেশ। এটি বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম সম্মেলন হিসেবে পরিচিত।
সমালোচনা ও বিতর্ক:
তাবলীগ জামাত সাধারণত রাজনীতি থেকে দূরে থাকে এবং ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে ইসলামি চর্চার ওপর গুরুত্ব দেয়। তবে কিছু ক্ষেত্রে তাদের পদ্ধতি নিয়ে সমালোচনা হয়েছে। যেমন:
- জামাতের কাজের সময় পরিবার বা সমাজের প্রতি দায়িত্ব অবহেলার অভিযোগ।
- বিদআত বা ধর্মে অতিরিক্ত বিষয় যোগ করার আশঙ্কা।
সারাংশ:
তাবলীগ জামাত একটি অরাজনৈতিক এবং ইসলামী পুনর্জাগরণমূলক আন্দোলন। এটি মূলত মুসলমানদের ধর্মীয় চেতনা জাগ্রত করতে কাজ করে। মাওলানা ইলিয়াস (রহ.)-এর এই উদ্যোগ আজ সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে এবং লক্ষ লক্ষ মানুষ এতে অংশগ্রহণ করছেন।
তাবলীগ জামাতের প্রতিষ্ঠাতা
তাবলীগ জামাতের প্রতিষ্ঠাতা হলেন মাওলানা মুহাম্মদ ইলিয়াস কান্ধলভী (রহ.)। তিনি ১৮৮৫ সালে ব্রিটিশ ভারতের উত্তর প্রদেশের কান্ধলা এলাকায় জন্মগ্রহণ করেন।
মাওলানা মুহাম্মদ ইলিয়াসের জীবনী সংক্ষেপ:
শিক্ষা:
মাওলানা ইলিয়াস (রহ.) বিখ্যাত দারুল উলুম দেওবন্দ থেকে ইসলামি শিক্ষা লাভ করেন। তিনি সূফি চিন্তা-চেতনা এবং দ্বীনি দাওয়াতের কাজে গভীর আগ্রহী ছিলেন।
দৃষ্টিভঙ্গি ও লক্ষ্য:
মেওয়াত অঞ্চলের মুসলমানদের ইসলামী শিক্ষা ও চেতনা থেকে বিচ্যুত হওয়া দেখে তিনি তাদের মধ্যে ধর্মীয় চেতনা ফিরিয়ে আনার জন্য একটি বিশেষ আন্দোলন শুরু করেন।
তাবলীগ জামাতের সূচনা:
১৯২৬ সালে মেওয়াত অঞ্চলে তাবলীগ জামাতের কার্যক্রম শুরু হয়। মাওলানা ইলিয়াস (রহ.) মনে করতেন, ইসলামের মৌলিক বিষয়গুলোর চর্চা পুনরুজ্জীবিত করতে ব্যক্তিগত ও দলীয় প্রচেষ্টা প্রয়োজন। তাই তিনি মানুষকে ইসলামের প্রতি দাওয়াত দেওয়ার জন্য এই জামাত প্রতিষ্ঠা করেন।
মৃত্যু:
মাওলানা মুহাম্মদ ইলিয়াস (রহ.) ১৯৪৪ সালে ইন্তেকাল করেন। তার কাজ আজ সারা বিশ্বে মুসলমানদের মধ্যে প্রচারিত হয়েছে।
মাওলানা ইলিয়াসের মূল বার্তা:
তিনি মানুষকে দাওয়াত দিতেন এভাবে:
"হে মুসলমানগণ! মুসলমান হও।"
অর্থাৎ ইসলামি চেতনায় ফিরে আসার আহ্বান জানানো ছিল তার প্রধান লক্ষ্য।