বিশ্ব ইজতেমা কেন বাংলাদেশে হয়।বিশ্ব ইজতেমার ইতিহাস

বিশ্ব ইজতেমার ইতিহাস, প্রেক্ষাপট বর্তমান

বিশ্ব ইজতেমা শুধু একটি ধর্মীয় সম্মেলন নয়; এটি মুসলিম উম্মাহর জন্য একটি ঐতিহাসিক, আধ্যাত্মিক এবং সাংস্কৃতিক মিলনমেলা। এর শেকড় প্রোথিত রয়েছে ভারতের উত্তর প্রদেশে মাওলানা ইলিয়াস (রহ.) এর হাতে প্রতিষ্ঠিত তাবলিগ জামাতের আন্দোলনে।


তাবলিগ জামাতের সূচনা

১৯২৬ সালে ভারতের উত্তর প্রদেশের মেওয়াত অঞ্চলে মাওলানা ইলিয়াস (রহ.) ইসলামের জাগরণ ঘটানোর উদ্দেশ্যে তাবলিগ আন্দোলনের সূচনা করেন। এর মূল লক্ষ্য ছিল মুসলমানদের মধ্যে ঈমানি চেতনা বৃদ্ধি এবং তাদের দৈনন্দিন জীবনে ইসলামিক মূল্যবোধ চর্চার পুনরুত্থান ঘটানো।
সে সময় ভারতে হিন্দু সংস্কার আন্দোলন ("শুদ্ধি" এবং "সংঘঠন") মুসলমানদের নিজ ধর্ম থেকে বিচ্যুত করার চেষ্টা করছিল। এই পরিস্থিতিতে মাওলানা ইলিয়াস (রহ.) ইসলামী চেতনা পুনর্জাগরণের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। তিনি মুসলমানদের ইসলামের প্রতি আরও সচেতন করার লক্ষ্যে মসজিদকেন্দ্রিক এই আন্দোলন পরিচালনা করেন।

বাংলাদেশে ইজতেমার সূচনা

বাংলাদেশে তাবলিগ জামাতের কার্যক্রম শুরু হয় চট্টগ্রামে ১৯৪০-এর দশকে। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল মুসলমানদের ইসলামের দাওয়াতি কার্যক্রমে অংশগ্রহণে উদ্বুদ্ধ করা।
১৯৪৬ সালে ঢাকার কাকরাইল মসজিদে প্রথমবারের মতো একটি আঞ্চলিক ইজতেমার আয়োজন হয়। স্বাধীনতার পর ১৯৬৬ সালে টঙ্গীর তুরাগ নদীর তীরে এটি স্থানান্তরিত হয়। এরপর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ইজতেমার জন্য ১৬০ একর জমি বরাদ্দ করেন, যা আজকের বিশ্ব ইজতেমার মূল কেন্দ্রস্থল।

বিশ্ব ইজতেমা নামকরণ

'বিশ্ব ইজতেমা' নামটি তাবলিগ জামাতের প্রবর্তিত নয়। স্থানীয় মুসলমানরা যখন দেখেন বিদেশি মুসল্লিরা এতে অংশ নিচ্ছেন, তখন থেকেই এটিকে 'বিশ্ব ইজতেমা' বলা শুরু হয়। যদিও তাবলিগ জামাত এটিকে বরাবরই বার্ষিক সম্মেলন বলে উল্লেখ করেছে।

ইজতেমার কার্যক্রম

বিশ্ব ইজতেমার প্রধান কার্যক্রমগুলো হলো:

  1. বয়ান:
    প্রতিদিনের বয়ানে ইসলামিক শিক্ষার মৌলিক বিষয় এবং জীবনধারার দিকনির্দেশনা প্রদান করা হয়।
  2. তাশকিল:
    মুসলমানদের ইসলামের দাওয়াত নিয়ে জামাতে বের হওয়ার জন্য উৎসাহিত করা।
  3. মুনাজাত:
    ইজতেমার শেষদিনে বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর শান্তি, কল্যাণ এবং দাওয়াতি কার্যক্রমের জন্য বিশেষ দোয়া করা হয়।

ইজতেমার আয়োজন এবং সময় বিভাজন

১৯৬৫ সাল থেকে ইজতেমায় অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পায়। ২০১১ সাল থেকে এটি দুই পর্বে বিভক্ত করা হয়। বর্তমানে ৩২টি জেলা একবার এবং পরবর্তী বছর অন্য ৩২টি জেলা অংশ নেয়। সাধারণত জানুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহে এটি অনুষ্ঠিত হয়।

বিশ্ব ইজতেমার বৈশ্বিক গুরুত্ব

বিশ্ব ইজতেমা বর্তমানে মুসলিম উম্মাহর বৃহত্তম ধর্মীয় জমায়েতগুলোর একটি। এটি মক্কা মদিনার হজ্বের পরেই বৃহত্তম সম্মেলন হিসেবে বিবেচিত হয়।
ইজতেমা শুধু ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান নয়, এটি মুসলিম উম্মাহর একতার প্রতীক এবং ধর্মীয় শিক্ষা বিস্তারের একটি মঞ্চ।

শেষ কথা

বিশ্ব ইজতেমা আমাদের জন্য শুধুই একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, বরং এটি ইসলামী ঐক্যের প্রতীক। এটি মুসলমানদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব, শান্তি, এবং সামাজিক সংহতি তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে।

বিশ্ব ইজতেমা কেন বাংলাদেশে হয়

বিশ্ব ইজতেমা বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হয় তার কারণ মূলত ধর্মীয়, ঐতিহাসিক এবং সাংগঠনিক। তাবলিগ জামাতের একটি অন্যতম বড় জমায়েত হিসেবে এটি পরিচিত এবং এর বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। এর মূল কারণগুলো হলো:

. তাবলিগ জামাতের কেন্দ্রীয় ভূমিকা

তাবলিগ জামাতের বিশ্বব্যাপী কার্যক্রমের সূচনা ভারত উপমহাদেশে হয়েছিল। ১৯২৬ সালে ভারতের মেওয়াতে তাবলিগ জামাত প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তীতে এটি বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় হয় এবং বাংলাদেশের টঙ্গীর তুরাগ নদীর তীরে ইজতেমা আয়োজনের উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি হয়।

. ভৌগোলিক সাংগঠনিক সুবিধা

বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান দক্ষিণ এশিয়ার কেন্দ্রস্থলে, যা ভারত, পাকিস্তান এবং অন্যান্য দেশের তাবলিগ অনুসারীদের জন্য সহজে যাতায়াতযোগ্য। বিশেষ করে টঙ্গী এলাকা বড় জমায়েত আয়োজনের জন্য যথাযথ স্থান হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। এখানে স্থানীয় প্রশাসন এবং জনগণের সহযোগিতা সহজলভ্য।

. ইতিহাসিক গুরুত্ব

১৯৪৬ সালে ঢাকার কাকরাইলে তাবলিগ জামাতের আঞ্চলিক কেন্দ্র স্থাপন করা হয়। তখন থেকেই বাংলাদেশে তাবলিগ জামাতের কার্যক্রম জোরদার হয়। ১৯৬৭ সালে প্রথমবারের মতো টঙ্গীর তুরাগ নদীর তীরে বিশ্ব ইজতেমার আয়োজন হয় এবং সেটি একটি ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে।

. বাংলাদেশের মুসলিম সংখ্যা গরিষ্ঠতা

বাংলাদেশ একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ এবং এখানকার মানুষ তাবলিগ জামাতের কার্যক্রমের প্রতি বিশেষ আগ্রহী। এর ফলে বাংলাদেশ বিশ্ব ইজতেমার একটি কেন্দ্রীয় স্থান হিসেবে গড়ে উঠেছে।

. আন্তর্জাতিক অংশগ্রহণ সহযোগিতা

বিশ্ব ইজতেমা একটি আধ্যাত্মিক পুনর্মিলনী যেখানে বিভিন্ন দেশ থেকে লক্ষ লক্ষ মুসলমান অংশগ্রহণ করেন। বাংলাদেশ সরকার জনগণ এই আয়োজন সফল করতে আন্তরিকভাবে সহযোগিতা করে।

বিশ্ব ইজতেমা শুধু ধর্মীয় জমায়েত নয়, এটি মুসলিম উম্মাহর ঐক্য ভ্রাতৃত্বের প্রতীক হিসেবেও বিবেচিত। বাংলাদেশের এই ভূমিকা বিশ্ব মুসলিম সমাজে বিশেষ গুরুত্ব বহন করে।

Post a Comment