আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস: গৌরব ও তাৎপর্য
মাতৃভাষা দিবসের পটভূমি
পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয় ১৯৪৭ সালে। এই রাষ্ট্রের গঠনের পর থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মাতৃভাষা ছিল বাংলা। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের গণপরিষদে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেওয়ার দাবি জানান। এরপর পূর্ব বাংলায় বাঙালিদের মাঝে প্রতিবাদের সুর বেজে ওঠে।
১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি ঢাকায় বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেওয়ার দাবিতে ছাত্র ও সাধারণ মানুষ বিক্ষোভে অংশ নেয়। আন্দোলন ঠেকাতে পাকিস্তানি শাসকরা গুলি চালায়, যেখানে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারসহ অনেকেই প্রাণ হারান। তাদের আত্মত্যাগের ফলে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দিতে সরকার বাধ্য হয়।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ
বাংলা ভাষার জন্য বাঙালির এই আত্মত্যাগের ঘটনা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পায় প্রবাসী বাঙালি রফিকুল ইসলাম ও আব্দুস সালামের উদ্যোগে। ১৯৯৮ সালে তারা জাতিসংঘের মহাসচিবকে একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতির প্রস্তাব দেন। বাংলাদেশের সরকারের সমর্থনে এই প্রস্তাব ইউনেস্কোর কাছে উপস্থাপিত হয়। ১৯৯৯ সালের ১৭ই নভেম্বর ইউনেস্কো ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে।
একুশের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি
২০০০ সাল থেকে একুশে ফেব্রুয়ারি বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে। এদিন মাতৃভাষার গুরুত্ব, ভাষার বৈচিত্র্য, এবং বহুভাষিক শিক্ষার ওপর আলোকপাত করা হয়। বাঙালির আত্মত্যাগের চেতনা আজ বিশ্বের সব ভাষাভাষী মানুষের জন্য প্রেরণার উৎস।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের তাৎপর্য
ভাষা শুধু যোগাযোগের মাধ্যম নয়, এটি একটি জাতির সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং আত্মপরিচয়ের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস আমাদের শিখায় প্রতিটি ভাষার মর্যাদা রক্ষা করা এবং ভাষার বৈচিত্র্য সংরক্ষণ করা আমাদের দায়িত্ব। এই দিবস বিশ্বব্যাপী ভাষার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন এবং মাতৃভাষার গুরুত্ব তুলে ধরে।
একুশের শিক্ষা
একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের শিখায় যে ভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য সংগ্রাম কেবল একটি জাতির নয়, বরং এটি সার্বজনীন। মাতৃভাষার প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা একটি জাতির ঐক্যের ভিত্তি। ভাষার জন্য বাঙালির এই ত্যাগ বিশ্বব্যাপী মানুষের মধ্যে মাতৃভাষার গুরুত্বের প্রতি সচেতনতা বৃদ্ধি করেছে।
উপসংহার
একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালির ইতিহাসের এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি অর্জন বাঙালির সংগ্রামী চেতনার ফল। এই দিনটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে মাতৃভাষা কেবল একটি ভাষা নয়, এটি আমাদের জাতিগত পরিচয়ের ভিত্তি। সারা বিশ্বে এই দিনটি পালিত হওয়া আমাদের জন্য গর্বের বিষয়। মাতৃভাষার প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার এই চেতনা আমাদের আগামীর পথচলায় প্রেরণা যোগায়।
রচনা ১০০০ শব্দের
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস
ভূমিকা:
"মা তোর মুখের বাণী আমার কানে লাগে সুধার মতন।" রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই অমর বাণী শুধু একটি কবিতার অংশ নয়, এটি মাতৃভাষার প্রতি মানুষের গভীর মমত্ববোধের প্রতিফলন। মাতৃভাষা মানুষের আত্মপরিচয়ের প্রথম ধাপ। একটি জাতির সংস্কৃতি, ইতিহাস, এবং আবেগকে ধারণ করে মাতৃভাষা। ভাষার জন্য আত্মত্যাগ শুধু আমাদের নয়, বিশ্ববাসীর কাছেও বিরল। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলাভাষার জন্য বাঙালির আত্মত্যাগকে আজ গোটা বিশ্ব "আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস" হিসেবে পালন করে। এই দিবসটি মাতৃভাষার গুরুত্ব ও মর্যাদার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের প্রতীক।
মাতৃভাষার ধারণা ও তাৎপর্য:
মাতৃভাষা মানে হলো সেই ভাষা, যা মানুষের জীবনের প্রথম ভাষা, যা তাকে পরিচয় দেয় তার সমাজ ও সংস্কৃতির সঙ্গে। মাতৃভাষার মাধ্যমে মানুষ তার চিন্তা, অনুভূতি এবং আবেগকে প্রকট করে। এটি শুধু যোগাযোগের মাধ্যম নয়, এটি একটি জাতির শিক্ষা, সংস্কৃতি, এবং ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক। প্রখ্যাত ভাষাবিজ্ঞানী ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছেন, "মা, মাতৃভূমি এবং মাতৃভাষা—এই তিনটি বিষয় প্রতিটি মানুষের কাছে শ্রদ্ধার।" মাতৃভাষাই জাতির উন্নতির প্রধান ভিত্তি।
মাতৃভাষার গুরুত্ব:
জাতীয় জীবনে মাতৃভাষার গুরুত্ব অপরিসীম। এটি শুধু একটি ভাষা নয়; এটি একটি জাতির স্বাতন্ত্র্য ও অস্তিত্বের চিহ্ন। শিক্ষা, বিজ্ঞান, শিল্প, সংস্কৃতি—সব ক্ষেত্রেই মাতৃভাষা প্রয়োজন। মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ রাখে। যেমন কবি রামনিধি গুপ্ত বলেছেন:
"নানান দেশের নানান ভাষা,
বিনা স্বদেশি ভাষা;
পুরে কি আশা।"
মাতৃভাষা ছাড়া একটি জাতি কখনো তার নিজস্ব উন্নয়ন ও সংস্কৃতির বিকাশ ঘটাতে পারে না।
বাংলা ভাষার জন্য আত্মত্যাগ:
পাকিস্তান সৃষ্টির পর বাংলাভাষার উপর যখন উর্দুর চাপ প্রয়োগের চেষ্টা হয়, তখন বাঙালি প্রতিবাদে ফেটে পড়ে। পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মুহম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকায় দাঁড়িয়ে ঘোষণা দেন, "উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।" এ ঘোষণা বাংলাভাষী জনতাকে ক্ষুব্ধ করে তোলে।
১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ভাষার দাবিতে ছাত্র-জনতা ১৪৪ ধারা ভেঙে মিছিলে অংশ নেয়। পুলিশ গুলি চালায় এবং সালাম, রফিক, বরকত, জব্বারসহ অনেক তরুণ প্রাণ হারান। তাদের রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল ঢাকার রাজপথ। ভাষার জন্য এ ধরনের আত্মত্যাগ বিশ্ব ইতিহাসে অনন্য। তাই একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের জন্য শুধু ভাষা আন্দোলনের দিন নয়, এটি আত্মপরিচয়ের জন্য লড়াইয়ের প্রতীক।
আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি:
একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর। কানাডায় বসবাসরত রফিকুল ইসলাম এবং আব্দুস সালাম নামের দুই ভাষাপ্রেমী উদ্যোগ নিয়ে একুশের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জন্য কাজ করেন। তাদের প্রস্তাব ইউনেস্কোতে গৃহীত হয় এবং ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা করা হয়।
এই স্বীকৃতির ফলে বাংলাভাষার জন্য বাঙালির আত্মত্যাগ বিশ্বে মর্যাদার আসন পায়। একইসঙ্গে বিশ্বের প্রতিটি জাতি তাদের মাতৃভাষার গুরুত্ব উপলব্ধি করে।
মাতৃভাষার বর্তমান অবস্থা:
আজকের বিশ্বে প্রযুক্তির বিকাশ ও ভাষার মিশ্রণের ফলে মাতৃভাষা অনেক জায়গায় অবহেলিত। বাংলা ভাষার ক্ষেত্রেও এ সমস্যা স্পষ্ট। টিভি, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বাংলা-ইংরেজির মিশ্র ব্যবহার মাতৃভাষার বিকৃতির উদাহরণ। এভাবে চলতে থাকলে একদিন বাংলা ভাষাও হারিয়ে যেতে পারে, যেমন হারিয়ে গেছে বহু প্রাচীন ভাষা।
মাতৃভাষার প্রতি শ্রদ্ধা ও সঠিক চর্চা ছাড়া একটি জাতি তার আত্মপরিচয় ধরে রাখতে পারে না।
একুশের শিক্ষা:
একুশ আমাদের শুধু ভাষার মর্যাদা নয়, আত্মপরিচয়ের জন্য লড়াই করার শিক্ষা দেয়। এটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, মাতৃভাষার প্রতি অবহেলা একটি জাতির অস্তিত্বকে হুমকির মুখে ফেলে দিতে পারে। আমাদের করণীয় হলো মাতৃভাষার প্রচার ও প্রসারে কাজ করা এবং নতুন প্রজন্মকে বাংলা ভাষার ইতিহাস ও গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন করা।
উপসংহার:
একুশ আমাদের অহংকার, আমাদের প্রেরণা। এই দিনটি শুধু বাঙালির নয়; এটি গোটা বিশ্বের মাতৃভাষার প্রতি শ্রদ্ধার দিন। আমরা যদি মাতৃভাষার প্রতি সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করি, তবে একুশের আত্মত্যাগ কখনো ব্যর্থ হবে না। ভাষার মর্যাদা রক্ষার মাধ্যমে আমরা জাতি হিসেবে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে পারি।
"মোদের গরব মোদের আশা,
আ-মরি বাংলা ভাষা।"