একুশের গান
আবদুল গাফফার চৌধুরী
আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি
ছেলেহারা শত মায়ের অশ্রু গড়া-এ ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি
আমার সোনার দেশের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি।।
জাগো নাগিনীরা জাগো নাগিনীরা জাগো কালবোশেখীরা
শিশু হত্যার বিক্ষোভে আজ কাঁপুক বসুন্ধরা,
দেশের সোনার ছেলে খুন করে রোখে মানুষের দাবী
দিন বদলের ক্রান্তিলগ্নে তবু তোরা পার পাবি?
না, না, না, না খুন রাঙা ইতিহাসে শেষ রায় দেওয়া তারই
একুশে ফেব্রুয়ারি একুশে ফেব্রুয়ারি।
সেদিনও এমনি নীল গগনের বসনে শীতের শেষে
রাত জাগা চাঁদ চুমো খেয়েছিল হেসে;
পথে পথে ফোটে রজনীগন্ধা অলকনন্দা যেন,
এমন সময় ঝড় এলো এক ঝড় এলো খ্যাপা বুনো।।
সেই আঁধারের পশুদের মুখ চেনা,
তাহাদের তরে মায়ের, বোনের, ভায়ের চরম ঘৃণা
ওরা গুলি ছোঁড়ে এদেশের প্রাণে দেশের দাবীকে রোখে
ওদের ঘৃণ্য পদাঘাত এই সারা বাংলার বুকে
ওরা এদেশের নয়,
দেশের ভাগ্য ওরা করে বিক্রয়
ওরা মানুষের অন্ন, বস্ত্র, শান্তি নিয়েছে কাড়ি
একুশে ফেব্রুয়ারি একুশে ফেব্রুয়ারি।।
তুমি আজ জাগো তুমি আজ জাগো একুশে ফেব্রুয়ারি
আজো জালিমের কারাগারে মরে বীর ছেলে বীর নারী
আমার শহীদ ভায়ের আত্মা ডাকে
জাগো মানুষের সুপ্ত শক্তি হাটে মাঠে ঘাটে বাটে
দারুণ ক্রোধের আগুনে আবার জ্বালবো ফেব্রুয়ারি
একুশে ফেব্রুয়ারি একুশে ফেব্রুয়ারি।।
কথা – আবদুল গাফফার চৌধুরী, ১৯৫২
সুর – আলতাফ মাহমুদ, ১৯৫৪
ভাবসম্প্রসারণ: আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি
উক্ত পঙ্ক্তিটি বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কোনো রচনা থেকে নেওয়া নয়, বরং এটি একুশে ফেব্রুয়ারির বিখ্যাত গান "আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি" থেকে নেওয়া হয়েছে। এই গানটি রচিত হয়েছে ১৯৫২ সালের মহান ভাষা আন্দোলনের স্মরণে, যেখানে বাঙালি জাতি তাদের মাতৃভাষা বাংলার জন্য প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিল।
এই পঙ্ক্তির গভীর তাৎপর্য রয়েছে। এটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, কীভাবে আমাদের ভাষার অধিকার আদায়ের সংগ্রামে সালাম, রফিক, বরকত, জব্বারসহ নাম না জানা অনেক শহীদ তাদের জীবন উৎসর্গ করেছেন। ভাষার জন্য এমন আত্মত্যাগের ঘটনা বিশ্ব ইতিহাসে বিরল। তাদের রক্তের বিনিময়ে আমরা আজ মাতৃভাষায় কথা বলার অধিকার পেয়েছি।
একুশে ফেব্রুয়ারি কেবল একটি দিন নয়, এটি আমাদের জাতীয় চেতনা, আত্মমর্যাদা ও স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতীক। এই দিন আমাদের শিখিয়ে যায়, অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো, নিজেদের ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করা এবং ঐক্যবদ্ধ থাকার গুরুত্ব। তাই একুশের চেতনা আমাদের জীবনের সব ক্ষেত্রে সত্য ও ন্যায়ের পথে এগিয়ে চলার অনুপ্রেরণা জোগায়।
অর্থাৎ, ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ শুধু একটি দিনের স্মরণ নয়, এটি বাঙালির আত্মপরিচয়, ভাষার অধিকার এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের এক অবিস্মরণীয় অধ্যায়।