একটি নদীর আত্মকাহিনী

নদীর আত্মকাহিনী

আমি এক প্রবাহমান নদী। আমার জন্ম হয়েছে সুদূর পাহাড়ের কোলে, এক অচেনা ঝর্ণাধারা থেকে। জন্মের পর আমি ছিলাম ছোট, দুর্বল, সরু এক কিশোরী ধারা।


পাহাড়ের বুকে লাফিয়ে-ঝাপিয়ে, পাথরের গায়ে আছড়ে পড়ে ছুটতাম সামনে। তখন আমার কোনো দিশা ছিল না, ছিল শুধু প্রবাহের উচ্ছ্বাস।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমি বড় হতে লাগলাম। নানা ছোট ছোট স্রোত এসে মিশল আমার বুকে, শক্তি বাড়ল, গতি বাড়ল। আমি এখন উন্মুক্ত প্রান্তরে প্রবাহিত এক পূর্ণাঙ্গ নদী। আমার দু’পাশে গড়ে উঠেছে জনপদ। আমার জলেই কৃষকের সোনালি ধানক্ষেত স্নান করে প্রাণ পায়, আমার বুক চিরে চলে নৌকা, মাঝিদের প্রাণ ভরে ওঠে আনন্দে। আমি তাদের বন্ধু, তাদের আশ্রয়।

বর্ষা এলে আমার রূপ পাল্টে যায়। আমি তখন দুর্দান্ত, অপার শক্তিধর। বৃষ্টির জল আমাকে ভরিয়ে তোলে, আমার স্রোত হয়ে ওঠে তীব্র, দুর্বার। কখনো কখনো এত বেশি উচ্ছ্বাসে ভেসে যাই যে, আমার দু’কূল ছাপিয়ে বিস্তীর্ণ অঞ্চলকে বানিয়ে তুলি জলমগ্ন। তখন আমার দুঃখ হয়, কারণ আমি জীবন দান করতে চাই, ধ্বংস নয়।

গ্রীষ্ম এলে আমি ক্লান্ত হয়ে পড়ি। আমার বুক শুকিয়ে আসে, কোথাও কোথাও শুধু ফাটল ধরা কাদামাটি পড়ে থাকে। আমার দেহ শীর্ণ হয়ে যায়, স্রোত হারিয়ে নিস্তব্ধতায় হারিয়ে যাই। তখন আমার আপনজনেরা ব্যথিত হয়, আমার কান্না তাদেরও কাঁদায়।

কিন্তু আমি জানি, এটাই জীবন। আমি চিরকাল বয়ে চলেছি, চলব। একদিন আমি সমুদ্রের সঙ্গে মিশে যাব, নিজেকে বিলীন করে দেব তার বিশাল বুকে। কিন্তু তাতেও আমার শেষ নেই। জলবাষ্প হয়ে আমি আবার ফিরব, বৃষ্টি হয়ে ঝরব পাহাড়ের কোলে, আবার জন্ম নেব এক নবীন নদী হয়ে।

আমি নদী—আমি ধারা, আমি জীবন, আমি প্রকৃতির এক চিরন্তন সঙ্গীত। আমার চলার কোনো শেষ নেই, কারণ আমি প্রবাহমান, আমি অনন্ত।

Post a Comment