কবি সোহেল হাসান গালিব বাংলাদেশের সমসাময়িক কবিতার জগতে একটি উল্লেখযোগ্য নাম।
তিনি ১৯৭৮ সালের ১৫ নভেম্বর টাঙ্গাইলে জন্মগ্রহণ করেন এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। বর্তমানে তিনি জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমিতে (নায়েম) সহযোগী অধ্যাপক ও প্রশিক্ষণ বিশেষজ্ঞ হিসেবে কর্মরত।
গালিবের কবিতায় ভাষার নান্দনিকতা ও ভাবের গভীরতা বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয়। তার প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো "চৌষট্টি ডানার উড্ডয়ন" (২০০৭), "দ্বৈপায়ন বেদনার থেকে" (২০০৯), "রক্তমেমোরেন্ডাম" (২০১১), "অনঙ্গ রূপের দেশে" (২০১৪), "তিমিরে তারানা" (২০১৭) এবং "ফুঁ" (২০২০)।
এছাড়া, তিনি "শূন্যের কবিতা" (২০০৮) শিরোনামে প্রথম দশকের নির্বাচিত কবিতার সংকলন সম্পাদনা করেছেন।
তার কবিতায় প্রেম, প্রকৃতি, সমাজ ও দর্শনের মেলবন্ধন সুস্পষ্ট। উদাহরণস্বরূপ, "অধিকার" কবিতায় তিনি লেখেন:
"সমগ্র পৃথিবী নয়, একটি তৃণের অধিকারই যথেষ্ট আমার। যেন একটি রোমের ছোট্ট কূপে মধুপের আলতো ফুঁয়ে নিমেষেই ঢুকে যেতে পারি।"
সম্প্রতি, মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে নিয়ে কটূক্তির অভিযোগে তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এ ঘটনায় বইমেলায় তার প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান "উজান" স্টল বন্ধ রেখেছে।
সোহেল হাসান গালিবের কবিতা তার সৃজনশীলতা ও ভাষার প্রতি গভীর অনুরাগের পরিচায়ক, যা বাংলা সাহিত্যে তাকে বিশেষ স্থান প্রদান করেছে।
দেবলীনা
কেবল তোমার নামটিকে
আলতোভাবে ছুঁয়ে ধর্ম ও রাষ্ট্রের ভেদ আমি
কিছুটা বুঝেছি…
শুনেছি তৈমুর লঙ বহু গিরিপথ পাড়ি দিয়ে এসে
ছোট্ট এক সরোবরে থমকে দাঁড়িয়েছে
দেখতে স্নানদৃশ্য, ভীল রমণীর
মানুষেরা আর কত পড়বে গ্রন্থ, যদি নাই খুলবে
গ্রন্থি, হৃদয়ের
দেবলীনা, সেই কবে থেকে তুমি
ভাষাকে কেবলই টানছো বর্ণের ভিতর
আমি খুঁজছি আদিগন্ত পৃষ্ঠা মেলে
নৈশব্দের পরাগচুম্বন—
এইখানে, পাথরে ও তৃণে
নামকে ছাপিয়ে দেহ আজও
ফুটল না। ফুটবে না তবে
কোনো হরফেই?
দেহযান
ক’মাইল পর ভালোবাসার রঙ পাল্টায়, মানুষের স্বেদ ও স্বস্তি কি তা জানে! বীজের দিকে লক্ষ করি, পাখির নীলচে ডিমের দিকে—
জন্ম ও বিকাশ: একটি অলস হাসি-বিনিময় থেকে ছাড়া পাওয়া। নীড়ের সম্পর্ক থেকে দূরে এই অলসতা, আনন্দসেতু—পারাপারহীন, জলকল্লোলে রচিত।
তারই উপর দিয়ে দেহযান—ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে তরঙ্গ, হাওয়া, প্রত্যাশা, প্রশ্ন ও ক্ষুধা। দুলছে কাশবন। প্রসন্ন প্রচ্ছদপট। অবসাদ-গন্ধে ভরা।
ভাবনা-ভূগোল তাতে চোট পায় বলে ঘোরে। ঘূর্ণি, জানি না কোন সৌর-সংকেতে তমসা-তল্লাশ করে, কেবলই দূরে সরে যায়…
ব্যাধি
তোমার নগ্নতাটুকু না-হয় আমিই ঢেকে দেব। বাঘের সমস্ত ক্ষুধা নিয়ে আহত হরিণকে দেব শুশ্রূষা—ঘাস চিবিয়ে সবুজ রস লাগাব তার জখমে।
তাই বলে সন্ত আমি নই। আছে হস্ত-পদ-স্কন্ধে তালের মতন এক মস্তকের ভার। আছে এ দেহের অন্ধকূপে অনন্ত পিপাসা। তৃষ্ণার্ত কুকুর হয়ে তবু—জলে শুধু মুখ দেখে ফিরে যাব—
ফিরে যাব আমি, একসিন্ধু জলাতঙ্ক নিয়ে।
অধিকার
সমগ্র পৃথিবী নয়, একটি তৃণের অধিকারই
যথেষ্ট আমার। যেন একটি রোমের ছোট্ট কূপে
মধুপের আলতো ফুঁয়ে নিমেষেই ঢুকে যেতে পারি।
যেন বেজে উঠি ওই হাড়ের বাঁশিতে একা, চুপে;
ভেসে যাই সুর হয়ে—ঝরে-পড়া পাতার সওয়ারি...
ঢেউ
আমি যার ভাবনাতেও নাই, কেন তাকে নিয়ে ভেবে
হয়েছি অস্থির? আজ বলে যাও তুমি ঢেউ, আরও
একটু কাছে এসে। জানি, এখনই বাতাস মুছে নেবে
ফেনিল হাসিটি মুখ থেকে। এই পৃথিবী তোমারও
কথা যে না শুনে ফেরে, ব্যথা পাও মানুষ হিশেবে?
টলমল
গাছগুলি প্রশ্নব্যাংক। প্রশ্নের মতন পাতা ঝরে।
সব পাতা ভিজে যায়—ভেসে যায় নদীর ওপরে।
নদী কি উত্তর দেয়? চিঠি লেখে মেঘের সমীপে?
কত যে নরম মেঘ—বুঝতে চেয়ো না শরীর টিপে।
শরীরে শিশির-মন—সারাক্ষণ শুধু টলমল—
এই বুঝি খসে যাবে, তাই কাঁপে ঘাসের অঞ্চল।
হসন্ত
খসখসে ঠোঁট, পাতা-মরমর গাছে—
তবু কেন আসে চির-গরবর বসন্ত?
কথা কিছু নাই আজ, ব্যথা যেন আছে—
শব্দের পায় থমকে দাঁড়ায় হসন্ত।
কোনো বই আর পড়বার তাড়া নাই,
তবুও পড়তে চায় বুঝি প্রেমে কান্তারা!
ফুসলানো হাওয়া দেয় উসকানি তাই—
লেখো চিঠি তুমি বুড়োদের অভিধান ছাড়া।
অনঙ্গ রূপের দেশে
সুচ এক, সুতো ছাড়া, যুবতীর আঙুলে সে নাচে;
খেলে যায় ডুব-সাঁতারের খেলা—কাঁথার সমুদ্রে—সারাদিন।
পৃথিবীতে কিছু ফুটল না ফুল, যত্নে শুধু আঁকা হলো;
অরোরা-রাতের স্বপ্ন
বুঝল না কেউ।
আমি সুতো, গুটলি পাকানো, কেবলই গড়িয়ে যাই—
যদিও জড়াতে চাই, পড়ি গিয়ে জলে। দেখি ঢেউ,
অর্থহীন আদিম উল্লাস।
সে উল্লাসে নারীরা প্রহার ভোলে, পুরুষও ছলনা।
শিখার কবলে পড়ে তাই পুড়ে গেল বায়ু, আগুনেরও আয়ু
ফুরালো কি হাওয়ার ছোবলে? শেষ হলো দাবানল...
কখন ডানার ভস্ম ছেয়ে যায় আকাশদুপুর
বিষণ্ন ব্যাধের বুকে, চেয়ে দ্যাখো পাখি,
বিঁধেছে এ কোন ব্যাসকূট?
মর্ম-পরিযায়ী তুমি, ধুপছায়াময়—
ফেলে গেছ এইখানে খড়ের নূপুর।
পাঠ
যে ভাষা মরে মুছে গেল তিন হাজার বছর আগে
যে ভাষায় গাইলে তুমি একা বসে গান
বোবা পাহাড়ের বিষণ্ন চূড়ায় উঠে
তার কোনো লিপি, রেখাচিত্র
পাথরের গায়ে যদি লেখা নাও থাকে, কোনো বাজপাখি
উড়ে এসে তার সাক্ষ্য যদি নাও দেয়
শান্ত দুপুরের রৌদ্র-বিলাবলে
সহসা মেঘের ধূসর ইঙ্গিতে এইখানে ভেসে এলে তুমি
বৃষ্টির ফোঁটার মতো।
আজকে এই ডুমুরগাছের পাতায়
এত যে আলেখ্য, এত যে আখ্যান,
জেগে উঠছে কীটের অক্ষরে,
ফুটে উঠছে বনের চিন্তার বাইরে
বিচিত্র ফুল ও ফুলের বিভ্রম
আর উড়ে যাচ্ছে যেসব গান, কিচিরমিচিরে মুচড়ে যাওয়া
ব্যথিত হাওয়ার নির্জন পৃষ্ঠায়
স্নিগ্ধ কোনো জলাবনের ধারে
তুমি তা পড়তে গিয়ে
আমাকে পাঠ করতে পারছ কি?
বৈকালিকী
গজারি বনের ভেতর ৩৬ গজ হেঁটে পার হলেও
যে শব্দ পাতার মর্মরে বেজে ওঠে না কারো
অসতর্ক পায়ে,
ঘুমন্ত বিকেলের আয়না এড়িয়ে যাবার সময়
বিশেষত একটি জানালার পাশ দিয়ে,
চমকে উঠেছি আমি—থমকে গিয়েছি একেবারে—
এত যে অনৃত চিন্তা, এত যে দুরন্ত স্বপ্ন
জংধরা পাল্লার কব্জা নাড়িয়ে জেগে উঠছে—
যদি তুমি শুনতে, যদি দেখতে পেতে
গজারি বনের ভেতর
ধরাশায়ী কোনো গজের পিঠ থেকে
তোমার গড়িয়ে পড়া—গড়িয়ে গড়িয়ে পড়া
আর আমার জড়িয়ে ধরা—পাতার মর্মরগুলো
গা থেকে ধুলোর মতন সরিয়ে সরিয়ে...
আবার ঘুমিয়ে পড়তে কি তুমি
শিয়রে পলাশ কিংবা পারুল গাছটিকে রেখে?