আন্তর্জাতিক নারী দিবস
ভূমিকা:
“পৃথিবীতে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর,
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।”
নারী মানব সভ্যতার এক অপরিহার্য অংশ। সমাজের অগ্রগতির ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের সমান ভূমিকা থাকলেও যুগ যুগ ধরে নারীরা বৈষম্য, অবহেলা এবং শোষণের শিকার হয়ে আসছে। এই কারণেই নারীদের অধিকার ও সমতা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালিত হয়। প্রতি বছর ৮ মার্চ বিশ্বব্যাপী এই দিবস উদযাপিত হয়। এই দিনটি নারীদের অবদানকে স্বীকৃতি দেওয়া, তাদের প্রতি সম্মান জানানো এবং নারীদের ক্ষমতায়ন ও সমতা নিশ্চিত করার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ উপলক্ষ।
নারী দিবসের ইতিহাস:
আন্তর্জাতিক নারী দিবসের সূচনা হয় ১৯০৮ সালে, যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক শহরে প্রায় ১৫,০০০ নারী শ্রমিক ভোটাধিকার, সমান মজুরি এবং কাজের উপযুক্ত পরিবেশের দাবিতে বিক্ষোভ করেন। এরপর ১৯১০ সালে কোপেনহেগেনে আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলনে জার্মান সমাজতান্ত্রিক নেত্রী ক্লারা জেটকিন ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে ঘোষণা করার প্রস্তাব দেন। ১৯১১ সালে প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালিত হয়। ১৯৭৫ সালে জাতিসংঘ ৮ মার্চকে আনুষ্ঠানিকভাবে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
নারীর অধিকার ও সংগ্রাম:
নারী অধিকার রক্ষার জন্য যুগে যুগে বিভিন্ন আন্দোলন হয়েছে। নারীরা শিক্ষা, স্বাস্থ্য, রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজে সমান সুযোগ পাওয়ার জন্য সংগ্রাম করেছে। বিভিন্ন দেশে নারীরা ভোটাধিকার অর্জন করেছে, কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণের সুযোগ পেয়েছে এবং আইনি অধিকার পেয়েছে। কিন্তু এখনো নারী নির্যাতন, বৈষম্য ও লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা অনেক দেশে বিদ্যমান।
বাংলাদেশে নারী অধিকার ও অবস্থা:
বাংলাদেশে নারীরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান, রাজনীতি এবং উদ্যোক্তা খাতে নারীদের অংশগ্রহণ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার, মন্ত্রীসহ প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়ে নারীরা দায়িত্ব পালন করছেন। পোশাক শিল্প, কৃষি, আইটি এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগে নারীদের ভূমিকা প্রশংসনীয়। তবে, এখনো নারীরা বিভিন্ন সামাজিক কুসংস্কার, পারিবারিক ও কর্মক্ষেত্রের বৈষম্য, সহিংসতা ও নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন।
নারী দিবসের তাৎপর্য:
নারী দিবস শুধু একটি উদযাপনের দিন নয়, এটি নারীদের অধিকার আদায়ের জন্য সচেতনতা বৃদ্ধির একটি দিন। এই দিবস আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে নারীরা সমান অধিকারের দাবিদার। নারীরা যদি সঠিকভাবে শিক্ষিত হয়, তাদের যদি সমান সুযোগ দেওয়া হয়, তাহলে তারা জাতীয় উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
জাতিসংঘের প্রতিপাদ্য:
প্রতি বছর জাতিসংঘ নারী দিবসের জন্য একটি বিশেষ প্রতিপাদ্য ঘোষণা করে। ২০২৫ সালের জন্য জাতিসংঘের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে—“নারীর সুস্বাস্থ্য ও জাগরণ”। এই প্রতিপাদ্য নারীদের স্বাস্থ্য সচেতনতা, সুস্থ জীবনযাত্রা ও মানসিক শক্তির উপর গুরুত্বারোপ করে।
নারী দিবস উদযাপন:
নারী দিবস উদযাপনের অংশ হিসেবে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে র্যালি, আলোচনা সভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, সেমিনার ও কর্মশালার আয়োজন করা হয়। সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, এনজিও ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এই দিবসটি নানা কর্মসূচির মাধ্যমে পালন করে।
নারীদের উন্নয়নে করণীয়:
- নারীদের উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নের জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন:
- শিক্ষা বিস্তার: নারীদের জন্য মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। শিক্ষাই নারীর ক্ষমতায়নের মূল হাতিয়ার।
- অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা: কর্মসংস্থান ও উদ্যোক্তা উন্নয়নে নারীদের সুযোগ দিতে হবে।
- আইন ও নিরাপত্তা: নারী নির্যাতন ও সহিংসতা রোধে কঠোর আইন প্রয়োগ করতে হবে।
- স্বাস্থ্যসেবা: নারীদের জন্য স্বাস্থ্যসেবা সহজলভ্য করতে হবে।
- সচেতনতা বৃদ্ধি: নারীদের অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে হবে।
উপসংহার:
আন্তর্জাতিক নারী দিবস কেবল একটি আনুষ্ঠানিকতা নয়, এটি নারীদের অধিকারের দাবিকে আরও সুসংহত করার একটি সুযোগ। নারীর ক্ষমতায়ন ও সমতা নিশ্চিত হলে সমাজ আরও এগিয়ে যাবে। সমাজের অর্ধেক জনগোষ্ঠীকে বাদ দিয়ে কোনো দেশ বা জাতি উন্নতির চূড়ান্ত শিখরে পৌঁছাতে পারে না। তাই নারী দিবসের মূল লক্ষ্য—প্রতিটি নারীর মর্যাদা, অধিকার ও সমান সুযোগ নিশ্চিত করা। আসুন, আমরা সবাই একসঙ্গে নারীদের ক্ষমতায়নে কাজ করি এবং একটি সমতার বিশ্ব গড়ে তুলি।