বাংলাদেশের উৎসব
ভূমিকা:
বাংলাদেশ একটি বৈচিত্র্যপূর্ণ সংস্কৃতির দেশ। এদেশের মানুষ জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে বিভিন্ন উৎসব পালন করে থাকে। এসব উৎসব শুধু আনন্দ-উৎসব নয়, বরং তা আমাদের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও সামাজিক সম্প্রীতির প্রতিচ্ছবি। শহর থেকে গ্রাম—সবখানেই উৎসব কেন্দ্র করে তৈরি হয় মিলনমেলা, হাসি-কান্না, আনন্দ ও ঐক্যের এক অনন্য পরিবেশ।
ধর্মীয় উৎসব:
বাংলাদেশে প্রধানত ইসলাম, হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীরা বসবাস করে, ফলে ধর্মীয় উৎসবগুলোর বৈচিত্র্য চোখে পড়ার মতো।
ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা:
মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব। ঈদুল ফিতর রমজান মাসের শেষে পালিত হয় এবং ঈদুল আজহা কোরবানির মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে পশু কোরবানি করে উদযাপিত হয়। এ সময় ঘরে ঘরে খাবার, নতুন পোশাক, সালামি ও সৌহার্দ্যের পরিবেশ সৃষ্টি হয়।
দুর্গাপূজা:
হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের প্রধান উৎসব। এটি আশ্বিন মাসে পালিত হয় এবং পাঁচ দিনব্যাপী পূজা, বিসর্জন ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে উদযাপন করা হয়।
বুদ্ধ পূর্ণিমা:
বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের জন্য বিশেষ একটি দিন। এই দিনে গৌতম বুদ্ধের জন্ম, বোধিলাভ ও মহাপরিনির্বাণ ঘটেছিল বলে মনে করা হয়। তারা মন্দিরে প্রার্থনা, দান ও ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন করে।
বড়দিন (ক্রিসমাস):
খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উৎসব। এই দিনে যিশু খ্রিস্টের জন্মদিন পালিত হয়। গির্জায় প্রার্থনা, উপহার আদান-প্রদান, ও কেক কাটা হয়।
জাতীয় উৎসব:
বাংলাদেশের জাতীয় ইতিহাস, সংগ্রাম ও বিজয়কে কেন্দ্র করে বিভিন্ন জাতীয় উৎসব পালিত হয়।
স্বাধীনতা দিবস (২৬ মার্চ):
১৯৭১ সালের এই দিনে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষিত হয়। এ উপলক্ষে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে আলোচনা সভা, কুচকাওয়াজ, শিশু-কিশোরদের চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়।
বিজয় দিবস (১৬ ডিসেম্বর):
১৯৭১ সালের এই দিনে পাকিস্তানি হানাদারদের আত্মসমর্পণের মাধ্যমে বাংলাদেশ চূড়ান্তভাবে স্বাধীনতা লাভ করে। সারাদেশে পতাকা উত্তোলন, জাতীয় সংগীত, স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন, র্যালি ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পালিত হয়।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস (২১ ফেব্রুয়ারি):
ভাষা শহীদদের স্মরণে সারাদেশে শহীদ মিনারে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ, প্রভাতফেরি ও আলোচনা সভার মাধ্যমে দিনটি পালিত হয়।
ঋতুভিত্তিক ও লোকজ উৎসব:
বাংলাদেশের ষড়ঋতুর দেশ হওয়ায় ঋতুভিত্তিক নানা উৎসব পালিত হয়।
পহেলা বৈশাখ:
বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন, অর্থাৎ ১৪ এপ্রিল পালিত হয়। গ্রামীণ মেলা, হালখাতা, মঙ্গল শোভাযাত্রা, পান্তা-ইলিশ খাওয়া—সব মিলিয়ে এটি এখন জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়েছে।
নবান্ন উৎসব:
নতুন ধান ঘরে তোলার আনন্দে আয়োজন করা হয় এই উৎসব। পিঠা-পুলি, হালুয়া, চিতই ও নতুন চালের ভাতের আয়োজন থাকে।
বসন্ত উৎসব:
ফাল্গুন মাসের প্রথম দিনে পালিত হয়। সবাই হলুদ পোশাক পরে ফুলের মালা গলায় দেয় এবং কবিতা, গান, নাচের মাধ্যমে ঋতুর আগমনে আনন্দ প্রকাশ করে।
চাঁদ দেখা উৎসব ও শবে বরাত, শবে কদর:
চাঁদ দেখা উপলক্ষে ঈদের খবর পাওয়ার পর তাৎক্ষণিক আনন্দ ও আতশবাজির এক চমৎকার পরিবেশ তৈরি হয়। শবে বরাত ও শবে কদরে মুসলমানরা রাত্রি জেগে ইবাদত করে।
সংস্কৃতিমূলক উৎসব:
একুশে বইমেলা:
ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে বাংলা একাডেমির প্রাঙ্গণে এই মেলা অনুষ্ঠিত হয়। এটি জ্ঞানচর্চা ও সাহিত্যপ্রেমীদের মিলনমেলা।
জাতীয় চলচ্চিত্র, নাট্য ও সংগীত উৎসব:
দেশের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান বছরের বিভিন্ন সময়ে এ ধরনের উৎসবের আয়োজন করে।
উপসংহার:
বাংলাদেশের উৎসবসমূহ কেবল আনন্দ-উল্লাস নয়, বরং জাতীয় চেতনা, ঐতিহ্য ও সমাজে সৌহার্দ্য রক্ষার প্রতীক। এসব উৎসব আমাদের মনন ও সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করে। তাই উৎসবকে ঘিরে আমাদের উচিৎ ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ববোধ বজায় রাখা।