বিশ্বকোষ
ভূমিকা
মানব সভ্যতার ইতিহাস যত পুরোনো, জ্ঞানচর্চা ও তথ্য সংগ্রহের আগ্রহও ততটাই প্রাচীন। সেই প্রাচীন কালের থেকেই মানুষ তার জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ও গবেষণার ফলাফলকে সংরক্ষণ করে রাখার চেষ্টা করেছে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য। এই জ্ঞান সংরক্ষণের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হলো বিশ্বকোষ। এটি এমন একটি সংকলন যেখানে বিশ্বের বিভিন্ন বিষয়ে তথ্য সংক্ষিপ্ত, সুসংগঠিত ও সহজবোধ্যভাবে উপস্থাপন করা হয়। বিশ্বকোষ শুধু জ্ঞানভাণ্ডার নয়, এটি একটি জাতির সংস্কৃতি, ইতিহাস ও প্রগতিরও পরিচায়ক।
বিশ্বকোষের সংজ্ঞা ও প্রকৃতি
‘বিশ্বকোষ’ শব্দটি সংস্কৃত শব্দ ‘বিশ্ব’ (বিশ্ব বা সার্বজনীন) ও ‘কোষ’ (ভাণ্ডার) থেকে এসেছে, যার অর্থ ‘বিশ্ব-জ্ঞানভাণ্ডার’। ইংরেজিতে একে বলা হয় Encyclopedia, যা গ্রিক শব্দ “ἐγκύκλιος παιδεία” (enkyklios paideia) থেকে এসেছে, যার অর্থ “বহুমুখী শিক্ষা”। বিশ্বকোষে বিজ্ঞানের নানা শাখা, ইতিহাস, সাহিত্য, ভূগোল, দর্শন, সমাজবিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান, চিকিৎসা, ধর্ম, রাজনীতি প্রভৃতি অসংখ্য বিষয়ে সংক্ষিপ্ত কিন্তু নির্ভরযোগ্য তথ্য প্রদান করা হয়।
বিশ্বকোষ সাধারণত বর্ণানুক্রমে সাজানো হয়, যেন পাঠক নির্দিষ্ট বিষয়ে সহজে তথ্য খুঁজে পেতে পারেন। এটি একটি নিরপেক্ষ ও তথ্যভিত্তিক গ্রন্থ, যার প্রধান লক্ষ্য শিক্ষিত জনসাধারণকে তথ্য সরবরাহ করা।
বিশ্বকোষের ইতিহাস
বিশ্বকোষের ইতিহাস বহু প্রাচীন। প্রাচীন চীন, গ্রিস, ভারত ও মুসলিম সভ্যতায় বিশ্বকোষ রচনার প্রচেষ্টা দেখা যায়।
- চীনে, হান রাজবংশের সময় 'ইয়ংলে দাদিয়েন' নামে একটি বিশাল বিশ্বকোষ রচিত হয়েছিল।
- গ্রিসে, এরিস্টটল ও প্লিনির লেখা গ্রন্থগুলোকে প্রাচীনকালের বিশ্বকোষ বলা যায়।
- ভারতে, পুরাণ, উপনিষদ ও অন্যান্য শাস্ত্রেও নানা বিষয়ে বিশ্বকোষীয় তথ্য উপস্থাপন ছিল।
- ইসলামি সভ্যতায়, আল-ফারাবি, ইবনে সিনা, আল-বিরুনি প্রমুখ দার্শনিক ও বিজ্ঞানী বিভিন্ন বিষয়ে বিশ্বকোষধর্মী গ্রন্থ রচনা করেন।
মধ্যযুগে ইউরোপে খ্রিস্টীয় ধর্মতত্ত্ব নিয়ে কিছু বিশ্বকোষ রচিত হলেও আধুনিক অর্থে বিশ্বকোষ রচনার সূচনা হয় ১৮শ শতকে।
আধুনিক বিশ্বকোষ
আধুনিক বিশ্বের সবচেয়ে বিখ্যাত বিশ্বকোষ হলো ব্রিটানিকা এনসাইক্লোপিডিয়া। এটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৭৬৮ সালে স্কটল্যান্ডে। এটি একটি দীর্ঘমেয়াদী প্রকল্প, যা পরবর্তীতে বহু খণ্ডে এবং বিভিন্ন সংস্করণে প্রকাশিত হয়েছে।
১৯ শতক ও ২০ শতকে ফ্রান্সের Larousse, জার্মানির Brockhaus, এবং রাশিয়ার Great Soviet Encyclopedia-সহ অনেক দেশ নিজস্ব ভাষায় বিশ্বকোষ রচনা করে।
বাংলা ভাষায় বিশ্বকোষ
- বাংলা ভাষায় বিশ্বকোষ রচনার ইতিহাসও বেশ পুরোনো। বাংলা সাহিত্যের নানা ক্ষেত্রে বিশ্বকোষীয় রচনার প্রচেষ্টা দেখা যায়। উল্লেখযোগ্য কিছু বাংলা বিশ্বকোষ:
- বাংলা বিশ্বকোষ – রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী সম্পাদিত এই বিশ্বকোষ ১৯১১ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়। এতে সাহিত্য, বিজ্ঞান, ইতিহাস, ভূগোলসহ নানা বিষয়ে প্রাঞ্জল ভাষায় তথ্য সংকলন করা হয়েছিল।
- বঙ্গীয় বিশ্বকোষ – হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় কর্তৃক সংকলিত, যা ভাষা ও সাহিত্যভিত্তিক।
- জাতীয় বিশ্বকোষ – বাংলা একাডেমি কর্তৃক প্রকাশিত একটি বৃহৎ প্রকল্প, যাতে বাংলাদেশের ইতিহাস, ভূগোল, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান ও আন্তর্জাতিক বিষয়সমূহ স্থান পেয়েছে।
বাংলাপিডিয়া – বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত এটি বাংলা ভাষার প্রথম পূর্ণাঙ্গ জাতীয় বিশ্বকোষ। অনলাইন সংস্করণও রয়েছে, যা এখন সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত।
বিশ্বকোষের প্রকারভেদ
বিশ্বকোষ সাধারণত দুইভাবে শ্রেণিবদ্ধ করা যায়:
১. সাধারণ বিশ্বকোষ
যেখানে সকল বিষয়ে সংক্ষিপ্ত তথ্য থাকে – যেমন বাংলা বিশ্বকোষ, ব্রিটানিকা, উইকিপিডিয়া।
২. বিশেষায়িত বিশ্বকোষ
যেখানে নির্দিষ্ট বিষয় – যেমন চিকিৎসা, আইন, জীববিজ্ঞান, সাহিত্য ইত্যাদির উপর তথ্য থাকে। উদাহরণ: চিকিৎসাবিজ্ঞান বিশ্বকোষ, আইন বিশ্বকোষ।
প্রযুক্তির ছোঁয়ায় বিশ্বকোষ
বিশ্বকোষের সবচেয়ে বড় রূপান্তর ঘটে ডিজিটাল যুগে। বই আকারে থাকা বিশাল বিশ্বকোষ এখন ইন্টারনেটভিত্তিক হয়ে গেছে। এর সবচেয়ে জনপ্রিয় উদাহরণ হলো উইকিপিডিয়া (Wikipedia)। এটি একটি মুক্ত বিশ্বকোষ, যেখানে ব্যবহারকারীরা নিজেরাই তথ্য সংযোজন ও সম্পাদনা করতে পারেন।
ডিজিটাল বিশ্বকোষের সুবিধাসমূহ:
- তথ্য সহজে খোঁজার সুবিধা।
- দ্রুত আপডেট।
- বহুভাষায় রূপান্তর।
- ইন্টারলিংকিং ও রেফারেন্স ব্যবস্থার মাধ্যমে গভীরতর অনুসন্ধান।
- তবে এর কিছু সীমাবদ্ধতাও রয়েছে, যেমন: ভুল তথ্য প্রবেশের সম্ভাবনা, তথ্যের সত্যতা যাচাইয়ের অভাব ইত্যাদি।
বিশ্বকোষের উপযোগিতা
বিশ্বকোষ শিক্ষার্থী, গবেষক, শিক্ষক, সাংবাদিক, পেশাজীবী এবং সাধারণ জ্ঞানপিপাসু মানুষের জন্য অত্যন্ত উপকারী। এর কয়েকটি ব্যবহারিক দিক হলো:
- পাঠ্যপুস্তকের বাইরের জ্ঞান লাভ
- পরীক্ষার প্রস্তুতিতে সহায়তা
- গবেষণা ও রেফারেন্স কাজে ব্যবহার
- ভাষা ও শব্দভাণ্ডার সমৃদ্ধকরণ
- শিশুরা নিজ উদ্যোগে জানার আগ্রহ তৈরি করে
বিশ্বকোষ জাতীয় উন্নয়নে অবদান রাখে, কারণ একটি জাতির বৌদ্ধিক ও সাংস্কৃতিক অগ্রগতি নির্ভর করে তার তথ্যভিত্তিক সচেতনতার উপর।
চ্যালেঞ্জ ও ভবিষ্যৎ
বিশ্বকোষ রচনার কাজ সহজ নয়। সঠিক তথ্য সংগ্রহ, যাচাই, সম্পাদনা ও উপস্থাপন – প্রতিটি ধাপে দক্ষতা ও নিষ্ঠা প্রয়োজন। বর্তমানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) এবং মেশিন লার্নিং প্রযুক্তির মাধ্যমে বিশ্বকোষ আরও বেশি স্বয়ংক্রিয় ও কার্যকর হয়ে উঠছে।
ভবিষ্যতে বিশ্বকোষ শুধু তথ্যভাণ্ডার নয়, বরং শিক্ষা সহায়ক ইন্টারঅ্যাকটিভ প্ল্যাটফর্ম হয়ে উঠবে। ভিজ্যুয়াল, অডিও এবং ভার্চুয়াল রিয়েলিটির মাধ্যমে শেখা আরও সহজ হবে।
উপসংহার
বিশ্বকোষ একটি সভ্যতার দর্পণস্বরূপ। এটি শুধু বই নয়, একটি জাতির চিন্তা, চেতনা ও বুদ্ধিবৃত্তিক ইতিহাসের দলিল। যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বকোষের রূপ ও ধরন পাল্টালেও এর গুরুত্ব অপরিবর্তিত থেকে গেছে। একবিংশ শতাব্দীর দ্রুতগামী তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর সমাজে বিশ্বকোষ নতুন করে আমাদের জ্ঞানের পথ দেখায় এবং একটি যুক্তিবোধসম্পন্ন, বিজ্ঞানমনস্ক প্রজন্ম গঠনে সহায়তা করে। তাই বিশ্বকোষ শুধু পড়ার বই নয়, বরং একটি সভ্য সমাজ নির্মাণের হাতিয়ার।