গর্ভাবস্থায় জরায়ু (Uterus) নিচে নেমে আসা বা জরায়ু পতন (uterine prolapse) খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। সাধারণত গর্ভাবস্থায় জরায়ু স্বাভাবিকভাবেই বড় হয় এবং ওপরের দিকে উঠে যায়। কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে বিভিন্ন কারণে জরায়ু নিচের দিকে নেমে যেতে পারে।
এটি গর্ভাবস্থার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ, তাই লক্ষণগুলো জানা জরুরি:
গর্ভাবস্থায় জরায়ু নিচে নামার লক্ষণ
১. পেটের বা তলপেটের চাপ অনুভব হওয়া
- তলপেট বা যোনিপথে ভারী অনুভূত হওয়া।
- মনে হতে পারে কিছু একটা নিচে পড়ে যাচ্ছে বা টেনে নামানো হচ্ছে।
২. পিঠে ব্যথা (Lower back pain)
- বিশেষ করে কোমরের নিচের অংশে ক্রমাগত ব্যথা।
- বসে থাকলে বা ভারী কিছু তুললে ব্যথা বাড়তে পারে।
৩. যোনিপথে কিছু বেরিয়ে আসার অনুভূতি
- অনেকে বলেন, মনে হয় যোনি দিয়ে কিছু বেরিয়ে আসছে বা আটকে আছে।
- আয়নায় দেখতে পারেন জরায়ুর অংশ যোনির বাইরে চলে এসেছে।
৪. মূত্রথলির সমস্যাসমূহ
- ঘন ঘন প্রস্রাবের বেগ।
- প্রস্রাব ধরে রাখতে না পারা (Urinary incontinence)।
- মূত্রত্যাগে অসুবিধা বা অসম্পূর্ণ প্রস্রাবের অনুভূতি।
৫. মলত্যাগের সমস্যা
- কোষ্ঠকাঠিন্য।
- মলত্যাগে চাপ পড়া বা অসম্পূর্ণ অনুভূতি।
৬. যোনিপথে অস্বস্তি বা চাপ অনুভূতি
- হাঁটাহাঁটি বা শারীরিক পরিশ্রম করলে অস্বস্তি বেড়ে যায়।
- বসা অবস্থায় কম মনে হলেও দাঁড়ালে বা হাঁটলে বাড়তে পারে।
৭. যৌন মিলনে অস্বস্তি বা ব্যথা (Dyspareunia)
- সহবাসের সময় ব্যথা বা অস্বস্তি।
- কিছু ক্ষেত্রে মিলনের প্রতি অনীহা তৈরি হতে পারে।
৮. স্রাব বা যোনিপথ থেকে অস্বাভাবিক স্রাব
- স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি স্রাব হওয়া।
- স্রাবে দুর্গন্ধ বা রঙ পরিবর্তন দেখা দিতে পারে।
ঝুঁকিপূর্ণ কারণসমূহ (কারণগুলো জেনে রাখা ভালো)
- একাধিক সন্তান জন্ম দেওয়া
- গর্ভাবস্থায় অতিরিক্ত ওজন বৃদ্ধি
- জন্মগত বা হরমোনের কারণে পেলভিক পেশি দুর্বল থাকা
- অতিরিক্ত কাশি বা ক্রনিক কফ
- অতিরিক্ত ভারী জিনিস তোলা বা পরিশ্রম করা
করণীয়
- যদি উপরোক্ত লক্ষণগুলোর মধ্যে কোনওটি দেখা যায়, অবহেলা করা উচিত নয়।
- অবিলম্বে গাইনোকোলজিস্টের সঙ্গে যোগাযোগ করুন।
- পেশি শক্তিশালী করার জন্য বিশেষ ব্যায়াম (যেমন কেগেল ব্যায়াম) শুরু করা যায়, তবে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে।
- পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিন এবং ভারী জিনিস তোলা এড়িয়ে চলুন।
- চিকিৎসক প্রয়োজনে pessary বা অন্যান্য চিকিৎসা পদ্ধতি নিতে বলতে পারেন।
জরায়ু ইনফেকশনের লক্ষণ
জরায়ু ইনফেকশন, চিকিৎসা পরিভাষায় যাকে বলা হয় এন্ডোমেট্রাইটিস (Endometritis), সেটি হলো জরায়ুর অভ্যন্তরীণ আস্তরণ বা এন্ডোমেট্রিয়ামের সংক্রমণ। এটি সাধারণত ব্যাকটেরিয়ার কারণে হয়ে থাকে। সময়মতো চিকিৎসা না করলে এটি মারাত্মক জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে। তাই এর লক্ষণগুলো বিস্তারিতভাবে জানা জরুরি।
জরায়ু ইনফেকশনের সাধারণ লক্ষণ
১. পেট বা তলপেটে ব্যথা
- বিশেষ করে তলপেটে স্থায়ী বা টান টান ব্যথা অনুভূত হয়।
- ব্যথা মাঝেমধ্যে তীব্রও হতে পারে।
২. জরায়ুর সংবেদনশীলতা
- চাপ দিলে বা স্পর্শ করলে তীব্র ব্যথা অনুভূত হয়।
- প্রসব পরবর্তী সময়ে জরায়ু নাড়ালে ব্যথা বাড়ে।
৩. অস্বাভাবিক যোনি স্রাব (Vaginal discharge)
- হলদে, সবুজাভ, বা দুর্গন্ধযুক্ত স্রাব।
- স্রাবের পরিমাণ স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশি হতে পারে।
৪. জ্বর ও ঠাণ্ডা লাগা (Fever and chills)
- শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়া (৩৮°C বা তার বেশি)।
- কাঁপুনি বা ঠাণ্ডা অনুভব করা।
৫. যৌন মিলনের সময় বা পরবর্তী সময়ে ব্যথা (Dyspareunia)
- যৌন মিলনের সময় অস্বস্তি বা ব্যথা অনুভব হওয়া।
৬. মূত্রজনিত সমস্যা
- প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া বা ব্যথা।
- ঘন ঘন প্রস্রাবের বেগ।
৭. অতিরিক্ত ক্লান্তি বা দুর্বলতা
- শরীরে অস্বাভাবিক দুর্বলতা বা অবসাদ।
- কাজকর্মে আগ্রহ কমে যাওয়া।
৮. অনিয়মিত মাসিক বা মাসিক চলাকালীন সমস্যা
- সময়ের আগে বা পরে মাসিক হওয়া।
- অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ বা অনিয়মিত রক্তপাত।
৯. বাতাস জমে থাকা বা পেট ফাঁপা (Bloating)
- পেটে ভারী ভাব বা অস্বস্তি অনুভূত হওয়া।
গুরুতর লক্ষণ (জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসা দরকার)
- উচ্চ মাত্রার জ্বর (১০৩°F বা তার বেশি)
- শরীর কাঁপানো (শীতলতা সহ)
- দ্রুত হার্টবিট
- মাথা ঘোরানো বা অজ্ঞান হওয়ার অনুভূতি
- তীব্র তলপেটের ব্যথা
এ ধরনের লক্ষণ দেখা গেলে অবিলম্বে হাসপাতালে যোগাযোগ করতে হবে। কারণ সংক্রমণ রক্তে ছড়িয়ে পড়লে সেপসিস (Sepsis) হতে পারে, যা জীবনঘাতী।
ঝুঁকির কারণসমূহ
- প্রসব বা গর্ভপাতের পর অপরিষ্কার অবস্থায় থাকা
- প্রসবকালীন বা গাইনোকোলজিক সার্জারির সময় সংক্রমণ হওয়া
- যৌনবাহিত রোগ (যেমন ক্ল্যামিডিয়া, গনোরিয়া)
- বহুবিচিত্র যৌন সম্পর্ক থাকা
- দীর্ঘদিন ধরে পিল বা আইইউডি ব্যবহারের পরে পরিচর্যার ঘাটতি
করণীয়
- চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ।
- বিশ্রাম নেওয়া ও শরীরের পানির চাহিদা পূরণ করা।
- সম্পূর্ণ ওষুধের কোর্স শেষ করা, মাঝপথে বন্ধ না করা।
- সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়লে হাসপাতালভিত্তিক চিকিৎসা প্রয়োজন হতে পারে।
উপসংহার
জরায়ু ইনফেকশন এমন একটি সমস্যা, যা সময়মতো চিকিৎসা না নিলে মারাত্মক হতে পারে। তবে ভালো খবর হলো, দ্রুত চিকিৎসা নিলে এটি সম্পূর্ণ সেরে ওঠে। লক্ষণগুলো সম্পর্কে সচেতন থাকলে সমস্যা গুরুতর হওয়ার আগেই ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব।