বৃক্ষরোপণ
ভূমিকা
মানবজীবনের অস্তিত্ব টিকে থাকার পেছনে প্রকৃতির অবদান অপরিসীম। আর এই প্রকৃতির অন্যতম প্রধান উপাদান হলো বৃক্ষ। গাছ আমাদের অক্সিজেন প্রদান করে, পরিবেশ রক্ষা করে, খাদ্য ও আশ্রয় দেয় এবং জীববৈচিত্র্যকে বাঁচিয়ে রাখে। বর্তমান বিশ্বের এক বড় সংকট হলো জলবায়ু পরিবর্তন, যা অনেকাংশেই ঘটেছে বৃক্ষ নিধনের কারণে। এই অবস্থায় পরিবেশ রক্ষায়, প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রাখতে ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি বাসযোগ্য পৃথিবী গড়ে তুলতে বৃক্ষরোপণের কোনো বিকল্প নেই।
বৃক্ষরোপণের সংজ্ঞা
বৃক্ষরোপণ অর্থ হলো গাছ লাগানো বা নতুনভাবে বৃক্ষের চারা রোপণ করা। এটি শুধুমাত্র একটি পরিবেশগত কর্মসূচি নয়, বরং একটি সামাজিক, অর্থনৈতিক ও নৈতিক দায়িত্ব। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্র—সবাই মিলে বৃক্ষরোপণে অংশগ্রহণ করলেই প্রকৃত উপকার পাওয়া সম্ভব।
বৃক্ষের উপকারিতা
গাছের উপকারের কথা বলে শেষ করা যাবে না। এর মধ্যে কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক তুলে ধরা হলো:
১. পরিবেশ রক্ষা
গাছ বাতাস থেকে কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করে এবং অক্সিজেন ছাড়ে। এটি বায়ুদূষণ হ্রাস করে এবং জলবায়ু পরিবর্তন রোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
২. প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রতিরোধ
গাছ মাটি আঁকড়ে ধরে রাখে, যার ফলে ভূমিক্ষয় কমে এবং বন্যা, ঝড়, খরা ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রভাব হ্রাস পায়।
৩. খাদ্য ও ওষুধ
ফলজ গাছ থেকে আমরা পেয়ারা, আম, কাঁঠাল, লিচু ইত্যাদি নানা ফল পাই। অনেক গাছ থেকে ওষুধও তৈরি হয়, যেমন তুলসী, নিম, আরগানিক হের্বস ইত্যাদি।
৪. অর্থনৈতিক উপকার
বাণিজ্যিকভাবে কাঠ, কাগজ, রজন, রং, সুগন্ধি প্রভৃতি গাছপণ্য আমাদের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। অনেক মানুষের জীবিকার উৎসও গাছ।
৫. জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ
গাছপালা পাখি, পোকামাকড় ও নানা বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল। একটি গাছ মানে একটি ক্ষুদ্র বাস্তুতন্ত্র।
বৃক্ষরোপণের প্রয়োজনীয়তা
বর্তমান বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহ হুমকির মুখে দাঁড়িয়ে আছে। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন, খরা, বন্যা, বরফ গলার হার বৃদ্ধি, মরুকরণ ইত্যাদি এর ফল। বাংলাদেশেও এর প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। নদীভাঙন, তাপমাত্রা বৃদ্ধি, বৃষ্টিপাতের অনিয়মিত ধরণ, কৃষিজ উৎপাদন হ্রাস—এসবের পেছনে পরিবেশ দূষণ ও বনভূমি ধ্বংস অন্যতম কারণ।
একটি দেশের মোট ভূভাগের অন্তত ২৫% বনাঞ্চল থাকা উচিত, কিন্তু বাংলাদেশে তা মাত্র ১৬-১৭%। এই পরিস্থিতি উত্তরণে ব্যাপক বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি প্রয়োজন।
বৃক্ষরোপণের সময় ও পদ্ধতি
সঠিক সময়ে ও উপযুক্ত পদ্ধতিতে বৃক্ষরোপণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সাধারণত বর্ষাকাল বৃক্ষরোপণের জন্য সবচেয়ে উপযোগী, কারণ তখন মাটি নরম থাকে এবং পর্যাপ্ত পানি থাকে।
বৃক্ষরোপণের সঠিক পদ্ধতি হলো:
- সঠিক স্থান নির্বাচন করা
- গর্ত খুঁড়ে আগেই সার মেশানো
- উপযুক্ত প্রজাতির চারা বেছে নেওয়া
- চারা রোপণের পর নিয়মিত পানি দেওয়া ও আগাছা পরিষ্কার
- প্রয়োজনে বেড়া দিয়ে চারা রক্ষা করা
- কোন ধরণের গাছ লাগানো উচিত?
- বৃক্ষরোপণের সময় অঞ্চলভিত্তিক ও প্রয়োজন অনুযায়ী গাছ বেছে নেওয়া উচিত। যেমন:
- ফলজ গাছ: আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু, পেয়ারা, নারিকেল ইত্যাদি।
- বনজ গাছ: শাল, সেগুন, গামারি, আকাশমণি ইত্যাদি।
- ঔষধি গাছ: তুলসী, অশ্বগন্ধা, নিম, অর্জুন, বহেরা ইত্যাদি।
- শোভাময় গাছ: কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া, জারুল, গোলাপ ইত্যাদি।
- নগর এলাকায় ছায়া দেয় এমন ছোট আকৃতির ও দূষণ সহনশীল গাছ যেমন কাঞ্চন, কড়ই ইত্যাদি লাগানো বাঞ্ছনীয়।
ব্যক্তি ও সমাজের ভূমিকা
বৃক্ষরোপণ শুধু সরকারের দায়িত্ব নয়, এটি প্রতিটি নাগরিকের কর্তব্য। একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে আমরা নিজের বাড়ির আঙিনায়, ছাদে, গ্রামের পরিত্যক্ত জমিতে, রাস্তার পাশে, স্কুল-কলেজের প্রাঙ্গণে গাছ লাগাতে পারি।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের মধ্যে পরিবেশ সচেতনতা গড়ে তোলার জন্য বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি অত্যন্ত কার্যকর। শিক্ষার্থীরা একদিকে গাছ লাগিয়ে প্রকৃতির সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলে, অন্যদিকে তা ভবিষ্যৎ জীবনে পরিবেশবান্ধব নাগরিক গঠনে সহায়ক হয়।
সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ
বাংলাদেশ সরকার প্রতি বছর জাতীয় বৃক্ষরোপণ অভিযান পালন করে। বন অধিদপ্তর, কৃষি বিভাগ, পরিবেশ মন্ত্রণালয় এই কাজের সঙ্গে যুক্ত। পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থা, পরিবেশবাদী সংগঠন ও নাগরিক সমাজের অংশগ্রহণও বেড়েছে।
আন্তর্জাতিক সংস্থা, যেমন ইউএনডিপি, আইইউসিএন প্রভৃতিও পরিবেশ সংরক্ষণে কাজ করে যাচ্ছে। মিডিয়া, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমও এখন বৃক্ষরোপণের পক্ষে সচেতনতা তৈরির প্ল্যাটফর্ম হয়ে উঠেছে।
চ্যালেঞ্জ ও করণীয়
- বৃক্ষরোপণের ক্ষেত্রে কিছু সমস্যা রয়েছে, যেমন:
- লাগানোর পর পরিচর্যার অভাব
- চোরাচালান ও বৃক্ষ নিধন
- নগরায়ন ও শিল্পায়নের জন্য গাছ কাটা
- সচেতনতার অভাব
- এই সমস্যা দূর করতে চাই—
- নিয়মিত তদারকি ও নজরদারি
- পরিবেশ শিক্ষার প্রসার
- বৃক্ষ নিধনের বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রয়োগ
- পরিবেশবান্ধব উন্নয়ন পরিকল্পনা
উপসংহার
প্রকৃতি আমাদের জীবনের অংশ নয়, বরং আমরা প্রকৃতির অংশ। গাছ হলো এই জীবনের ছায়া, প্রশ্বাস, শক্তি ও আশ্রয়। আজ যে শিশুটি একটি বৃক্ষরোপণ করছে, সে শুধু একটি গাছ নয়—একটি জীবন, একটি ভবিষ্যৎ, একটি পৃথিবী লাগাচ্ছে। তাই আসুন, আমরা সবাই একসঙ্গে হাতে হাত রেখে পরিবেশ রক্ষায় বৃক্ষরোপণ করি, আর একটি সবুজ, সুস্থ ও বাসযোগ্য পৃথিবী গড়ে তুলি।