১৯৭১ সালের অসহযোগ আন্দোলন বলতে কি বুঝায়

১৯৭১ সালের অসহযোগ আন্দোলন

—এক জাতির জাগরণ, এক ইতিহাসের সূচনা

ভূমিকা

বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে ১৯৭১ সালের অসহযোগ আন্দোলন একটি মাইলফলক অধ্যায়। এই আন্দোলন ছিল পাকিস্তানের শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে বাঙালিদের গণআন্দোলনের সর্বাত্মক রূপ, যার সূত্র ধরে শুরু হয়েছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে পরিচালিত এই অসহযোগ আন্দোলন শুধু পাকিস্তান সরকারের প্রশাসনিক কাঠামোকেই অচল করে দেয়নি, বরং বাঙালি জাতির রাজনৈতিক চেতনাকে তীব্রতর করে তুলেছিল এবং স্বাধীনতার পথে দৃঢ় পদক্ষেপ রাখে।

আন্দোলনের পটভূমি

১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির মাধ্যমে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হলেও, পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ) বরাবরই ছিল বঞ্চনার শিকার। আর্থিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও প্রশাসনিক সব ক্ষেত্রেই পশ্চিম পাকিস্তান আধিপত্য বজায় রাখে। ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ বাঙালি জাতিসত্তার চেতনায় জাগ্রত হলেও, রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থায় তারা চিরকালই অবহেলিত ছিল।


১৯৭০ সালের জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ১৬০টির মধ্যে ১৬৭টি আসন পেয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান ও পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো ষড়যন্ত্র করে ক্ষমতা হস্তান্তরে বিলম্ব ঘটাতে থাকে। এর প্রতিবাদেই শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন।

অসহযোগ আন্দোলনের সূত্রপাত

১৯৭১ সালের ১ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান হঠাৎ করে ৩ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করার ঘোষণা দেন। এই ঘোষণায় বাঙালির মধ্যে তীব্র ক্ষোভ ও প্রতিরোধের সঞ্চার হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১ মার্চ রাতেই এক বিবৃতিতে ২ মার্চ সারাদেশে হরতালের ডাক দেন এবং ৩ মার্চ ঢাকায় বিশাল প্রতিবাদ সমাবেশে বক্তব্য রাখেন।

৪ মার্চ থেকে শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলনের আনুষ্ঠানিক রূপ, যা পরে সমগ্র বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) তার ঐতিহাসিক ভাষণ দেন, যা ছিল স্বাধীনতা যুদ্ধের ঘোষণার চূড়ান্ত প্রস্তুতি।

বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ

৭ মার্চ ১৯৭১, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক লক্ষাধিক মানুষের সামনে দাঁড়িয়ে যে ভাষণ দেন, তা ছিল এক যুগান্তকারী ঘোষণা। তিনি বলেন:

“এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।”

যদিও তিনি সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা দেননি, কিন্তু তার বক্তব্যের মাধ্যমে দেশবাসী বুঝে নেয়—এটাই স্বাধীনতার ডাক। তিনি আরও ঘোষণা দেন:

  • কর প্রদান বন্ধ
  • সরকারি অফিস-আদালতে অন poslu
  • পাকিস্তানি সরকারের সব আদেশ-নির্দেশ বর্জন
  • আওয়ামী লীগের নির্দেশ অনুযায়ী দেশ পরিচালনা

এই ভাষণই হয়ে ওঠে অসহযোগ আন্দোলনের ম্যানিফেস্টো এবং স্বাধীনতার চূড়ান্ত বার্তা।

আন্দোলনের কার্যক্রম

১৯৭১ সালের মার্চ মাসজুড়ে আন্দোলনের কিছু প্রধান কার্যক্রম ছিল:

সরকারি অফিসে কর্মবিরতি:

প্রশাসনিক স্তরে বাঙালি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কাজ বন্ধ করে দেয়। অনেক জায়গায় অফিস খোলা হলেও কার্যক্রম ছিল স্থবির।

বিচার বিভাগ ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ:

আদালত ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কার্যত অচল হয়ে পড়ে। ছাত্র-জনতা রাস্তা দখল করে নেয়।

ট্যাক্স-ভাড়া না দেওয়া:

জনগণ সরকারের নির্দেশ উপেক্ষা করে কর ও ভাড়া প্রদান থেকে বিরত থাকে।

স্বাধীন প্রশাসনের গঠন:

আওয়ামী লীগের নির্দেশে গঠিত হয় বিভিন্ন গণকমিটি, যারা এলাকার প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা ও খাদ্য সরবরাহ দেখাশোনা করে।

স্বাধীন পতাকা উত্তোলন:

মার্চের প্রথম সপ্তাহ থেকেই পূর্ব বাংলার সর্বত্র বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত পতাকা উত্তোলন করা হয়।

পশ্চিম পাকিস্তানি পণ্য বর্জন:

পাকিস্তানের পণ্য ও প্রতীকী জিনিস বর্জন করা শুরু হয়। হোটেল-রেস্তোরাঁয় পাকিস্তানি খাবার পরিবেশন বন্ধ হয়ে যায়।

সাংবাদিক ও শিল্পীদের ভূমিকা:

গণমাধ্যম, কবি-সাহিত্যিক, নাট্যকার, শিল্পীরা অসহযোগ আন্দোলনের পক্ষে জনমত গড়ে তোলেন। গণসংগীত, পোস্টার, লিফলেট, পথনাটক—সবই হয়ে ওঠে প্রতিবাদের হাতিয়ার।

আন্দোলনের পরিণতি

সারাদেশ যখন কার্যত বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে চলছিল, তখন পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী তা সহ্য করতে না পেরে গোপনে প্রস্তুতি নিতে থাকে। অবশেষে ২৫ মার্চ রাতে “অপারেশন সার্চলাইট” নামে বর্বর সেনা অভিযান চালিয়ে পাকিস্তানি বাহিনী ঢাকাসহ দেশের বড় বড় শহরে হত্যাযজ্ঞ শুরু করে।

এই গণহত্যার প্রতিক্রিয়ায় ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। এই ঘোষণার মাধ্যমে অসহযোগ আন্দোলন রূপ নেয় পূর্ণ মুক্তিযুদ্ধে।

অসহযোগ আন্দোলনের তাৎপর্য

১. জাতীয় ঐক্যের প্রতীক:

সমগ্র বাঙালি জাতি এই আন্দোলনে একত্রিত হয়। রাজনৈতিক দল, ছাত্রসমাজ, শ্রমিক, কৃষক, নারী—সবাই সক্রিয় ভূমিকা পালন করে।

আত্মনির্ভরতার প্রমাণ:

পাকিস্তান সরকার যখন অচল হয়ে পড়ে, তখন বাঙালিরা নিজেদের প্রশাসন নিজেরাই চালিয়েছে। এটি ছিল একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রাথমিক রূপরেখা।

আন্তর্জাতিক মনোযোগ:

বিশ্ব গণমাধ্যম ও আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশের সংকট তুলে ধরা হয়। অসহযোগ আন্দোলনের শান্তিপূর্ণ অথচ দৃঢ় অবস্থান বিদেশেও সমর্থন আদায় করে নেয়।

স্বাধীনতার প্রস্তুতি:

এই আন্দোলন ছিল সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাভাস। মানুষের মন-মননে স্বাধীনতার ইচ্ছা দৃঢ় হয়ে ওঠে।

উপসংহার

১৯৭১ সালের অসহযোগ আন্দোলন ছিল বাঙালি জাতির সর্ববৃহৎ অহিংস গণআন্দোলন, যা একটি জাতিকে স্বাধীনতার পথে এগিয়ে দেয়। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব, জনতার অংশগ্রহণ, ও রাজনৈতিক সচেতনতায় এই আন্দোলন শুধু প্রশাসনিক কাঠামোকেই ভেঙে দেয়নি, বরং একটি জাতিকে নতুন রাষ্ট্র গঠনের দিশা দেখায়। এই আন্দোলনের চূড়ান্ত পরিণতি ছিল মহান মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়।

Post a Comment