বাংলাদেশের নদ নদী রচনা।বাংলাদেশের নদ নদী রচনা class 7,8,9,10

বাংলাদেশের নদ-নদী

বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যতম নদীমাতৃক দেশ। এ দেশের ভূ-প্রকৃতি, পরিবেশ, জনজীবন ও অর্থনীতি—সবকিছুর সঙ্গে নদ-নদীর রয়েছে অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক। নদী যেমন এই দেশের জনজীবনে আশীর্বাদ, তেমনি কখনো কখনো অভিশাপ হিসেবেও আবির্ভূত হয়। তবে বাংলাদেশের ইতিহাস, সভ্যতা, সংস্কৃতি এবং অর্থনৈতিক কাঠামো গঠনে নদ-নদীর ভূমিকা অতুলনীয়।

নদ-নদীর পরিচয় ও প্রকারভেদ

বাংলাদেশে প্রধানত তিনটি বড় নদী প্রবাহিত হয়েছে—গঙ্গা (পদ্মা), ব্রহ্মপুত্র (যমুনা) এবং মেঘনা। এদের উপনদী ও শাখানদীসহ প্রায় ৭০০-৮০০ নদ-নদী রয়েছে। বর্ষাকালে এই সংখ্যা আরও বাড়ে, আবার শুষ্ক মৌসুমে অনেক নদী শুকিয়ে যায়। নদীগুলোকে গঠন ও প্রবাহের ভিত্তিতে প্রধানত দুই ভাগে ভাগ করা যায়:


  1. প্রবাহমান নদী – যেমন: পদ্মা, যমুনা, মেঘনা, তিস্তা ইত্যাদি।
  2. মরু নদী বা মৌসুমী নদী – যেমন: ভৈরব, আড়িয়াল খাঁ, ধলেশ্বরী, করতোয়া ইত্যাদি।

প্রধান নদীগুলোর পরিচিতি

১. পদ্মা নদী: গঙ্গা নদী ভারতের পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রবাহিত হয়ে বাংলাদেশের রাজশাহীর কাছে প্রবেশ করে এবং পদ্মা নামে পরিচিত হয়। এটি বাংলাদেশের অন্যতম প্রাচীন ও বৃহৎ নদী। পদ্মা নদী কৃষি, যোগাযোগ এবং মৎস্য আহরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

২. যমুনা নদী: ব্রহ্মপুত্র নদ ভারতের আসাম রাজ্য থেকে নেমে বাংলাদেশে যমুনা নামে প্রবাহিত হয়। এটি বাংলাদেশের অন্যতম প্রস্থ নদী এবং দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

৩. মেঘনা নদী: এই নদী বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলে প্রবাহিত প্রধান নদী। এটি সুরমা, কুশিয়ারা, গোমতী ও টিটাস নদীর সম্মিলিত রূপ। মেঘনা নদী দিয়ে বহুসংখ্যক নৌপথ চলে এবং এটি দেশের দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরে মিশেছে।

৪. তিস্তা নদী: এটি বাংলাদেশের উত্তরের একটি গুরুত্বপূর্ণ নদী, যা হিমালয় থেকে নেমে আসে। কৃষিকাজে সেচের জন্য এই নদীর ওপর ব্যাপক নির্ভরতা রয়েছে।

৫. কর্ণফুলি নদী: এটি চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের প্রধান নদী। কর্ণফুলী নদীর উপর অবস্থিত "কাপ্তাই বাঁধ" বাংলাদেশের একমাত্র জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে।

নদ-নদীর ভূমিকা

‌১. কৃষি

বাংলাদেশের অর্থনীতি প্রধানত কৃষিনির্ভর। কৃষির জন্য প্রয়োজন সেচ ব্যবস্থা, যা প্রধানত নদ-নদীর জল থেকে আসে। তিস্তা, মেঘনা, পদ্মা, যমুনা প্রভৃতি নদীর পানি ব্যবহার করে কৃষকেরা ধান, পাট, গমসহ নানা ধরনের ফসল উৎপাদন করে। নদীর পলিমাটি অত্যন্ত উর্বর, যা কৃষিকাজে সহায়ক।

২. যোগাযোগ ও পরিবহন

নদীগুলো দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে মাল ও যাত্রী পরিবহনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বর্ষাকালে দেশের অনেক দূর্গম এলাকায় যাতায়াতের প্রধান মাধ্যম হয়ে দাঁড়ায় নদীপথ। নৌযান, ট্রলার, স্টিমার, লঞ্চ ও ফেরি ব্যবহৃত হয় যাত্রী ও পণ্য পরিবহনে।

৩. মৎস্য আহরণ

নদী বাংলাদেশের মৎস্যসম্পদের প্রধান উৎস। পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা নদী ইলিশ মাছের জন্য বিখ্যাত। হাজার হাজার জেলে নদীতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে। এদেশে মৎস্য চাষ ও নদীকেন্দ্রিক অর্থনীতি গড়ে উঠেছে।

৪. জলবিদ্যুৎ উৎপাদন

কর্ণফুলী নদীর উপর নির্মিত কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্প দেশের একমাত্র জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র। নদীভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের সুযোগ আরও বাড়ানো গেলে দেশের বিদ্যুৎ ঘাটতি অনেকাংশে পূরণ করা সম্ভব।

৫. বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ

নদীগুলো জলজ জীব, পাখি, কচ্ছপ, কুমির ও অন্যান্য বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল। বাংলাদেশের সুন্দরবনের নদীগুলোতে রয়েল বেঙ্গল টাইগারসহ নানা প্রজাতির প্রাণী বাস করে। নদীজীব বৈচিত্র্য সংরক্ষণে নদ-নদী গুরুত্বপূর্ণ।

নদী ও জনজীবন

বাংলাদেশের সংস্কৃতি, জীবনধারা, উৎসব-অনুষ্ঠান, লোকগান, লোককাহিনি—সবকিছুতেই নদ-নদীর প্রভাব লক্ষণীয়। নদীর তীরে গড়ে উঠেছে অনেক জনপদ, শহর ও বন্দর। ‘নদীমাতৃক বাংলাদেশ’ কথাটি শুধু ভৌগোলিক নয়; এটি একটি সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক পরিচয়ও বটে।

নদীভাঙন ও বন্যা

নদ-নদীর উপকারিতার পাশাপাশি কিছু সমস্যা রয়েছে, যার মধ্যে নদীভাঙন ও বন্যা অন্যতম। বর্ষাকালে নদীর পানির প্রবাহ বেড়ে গেলে তীরবর্তী এলাকা প্লাবিত হয় এবং বসতভিটা, কৃষিজমি, রাস্তা-ঘাট, স্কুল-কলেজ নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। প্রতি বছর হাজার হাজার পরিবার গৃহহীন হয়। বিশেষ করে যমুনা, তিস্তা ও মেঘনা নদীর তীরে নদীভাঙন ভয়াবহ রূপ ধারণ করে।

নদ-নদীর দখল ও দূষণ

বর্তমানে বাংলাদেশের অনেক নদীই অবৈধভাবে দখল ও দূষণের শিকার। নদীর পাড়ে বসতবাড়ি, দোকান, কারখানা নির্মাণ করে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ ব্যাহত করা হচ্ছে। শিল্পবর্জ্য, আবর্জনা ও পলিথিন ফেলে নদীর পানি দূষিত করা হচ্ছে। এতে নদীর গভীরতা কমে যাচ্ছে, জৈবপ্রবাহ ব্যাহত হচ্ছে এবং মাছসহ নানা জলজ প্রাণী বিলুপ্ত হচ্ছে।

নদী রক্ষা ও পরিকল্পনা

নদ-নদী রক্ষা ও উন্নয়নে সরকার ও বিভিন্ন সংগঠন ইতোমধ্যে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। যেমন:

  • নদী খনন ও পুনর্খনন প্রকল্প
  • বাঁধ নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণ
  • নদী দখল ও দূষণ রোধে আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ
  • নদী রক্ষা কমিশন গঠন
  • সচেতনতা বৃদ্ধি ও জনসম্পৃক্ততা

এসব উদ্যোগ সফল হলে দেশের নদ-নদীগুলোর পুনরুজ্জীবন সম্ভব।

জলবায়ু পরিবর্তন ও নদ-নদী

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে গ্লেসিয়ার গলে যাওয়ার কারণে নদীর পানির প্রবাহে পরিবর্তন ঘটছে। কখনো অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত বা পাহাড়ি ঢলে আকস্মিক বন্যা হয়, আবার শুষ্ক মৌসুমে পানিশূন্য হয়ে পড়ে অনেক নদী। ফলে কৃষি, জীববৈচিত্র্য এবং মানুষের জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে।

উপসংহার

নদ-নদী বাংলাদেশের প্রাণ। এর প্রবাহে গড়ে উঠেছে আমাদের সভ্যতা, ইতিহাস ও অর্থনীতি। তবে আজকের দিনে নদী রক্ষায় আমাদের সচেতন হওয়া অত্যন্ত জরুরি। অবৈধ দখল ও দূষণ রোধ করতে হবে, নদীভিত্তিক টেকসই উন্নয়ন পরিকল্পনা নিতে হবে এবং নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ বজায় রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে, নদী বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে।

Post a Comment