বাংলাদেশের পাখি রচনা ক্লাস 4।পাখির জগৎ রচনা ৪র্থ শ্রেণি

বাংলাদেশের পাখি

ভূমিকা:

পাখি প্রকৃতির এক অনন্য সৃষ্টি। এরা আমাদের পরিবেশের সৌন্দর্য ও ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশ একটি নদীমাতৃক, সবুজ-শ্যামল ও উর্বর দেশ হওয়ায় এখানে পাখির বসবাসের জন্য রয়েছে অনুকূল পরিবেশ। এদেশে রয়েছে নানা প্রজাতির দেশি ও অতিথি পাখি। এরা আমাদের জীবনের সৌন্দর্য ও প্রকৃতির ছন্দকে সমৃদ্ধ করে তোলে।

বাংলাদেশে পাখির বৈচিত্র্য:

বাংলাদেশে প্রায় ৭০০ প্রজাতির পাখি রয়েছে, যার মধ্যে অনেক প্রজাতি স্থায়ীভাবে বসবাস করে এবং অনেক প্রজাতি শীতকালে বিভিন্ন দেশ থেকে অতিথি হয়ে আসে। আমাদের দেশের গ্রামাঞ্চল, বন-জঙ্গল, জলাশয়, নদী-নালা, হাওর-বাওড়, পাহাড় ও সমতল ভূমিতে এদের বিচরণ দেখা যায়। এদের মধ্যে আছে গান গাওয়া পাখি, শিকারি পাখি, জলচর পাখি, গৃহস্থালির আশপাশে দেখা যাওয়া পাখি এবং দূর্লভ পাখিও।


জনপ্রিয় দেশি পাখি:

বাংলাদেশের গ্রামে-গঞ্জে, শহরের পার্কে কিংবা ঝোপ-জঙ্গলে নানা ধরনের দেশি পাখি দেখা যায়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো:

১. দোয়েল: বাংলাদেশের জাতীয় পাখি। ছোট আকৃতির হলেও এটি অত্যন্ত চঞ্চল ও সুন্দর গানে পরিপূর্ণ। দোয়েলের পুচ্ছ বা লেজ সব সময় নাড়াচাড়া করে এবং এরা মাটিতে খাবার খুঁজে বেড়ায়।

২. শ্যামা: একে বনের গানরাজ বলা হয়। শ্যামা সুন্দর গলায় গান গায়, যা গ্রামবাংলার সকালের সৌন্দর্যকে বাড়িয়ে তোলে।

৩. ময়না: কথা বলার অনুকরণ ক্ষমতা এদেরকে বিশেষভাবে আকর্ষণীয় করে তোলে। এরা মানুষের সান্নিধ্যে থাকতে পছন্দ করে।

৪. বুলবুলি: সবুজ গাছের ফাঁকে লুকিয়ে গলা ছেড়ে গান গায় এই পাখিটি। এর কণ্ঠস্বর মধুর ও সুরেলা।

৫. কোকিল: বসন্তের আগমনে কোকিলের কুহুতান আমাদের মনে প্রেম আর প্রকৃতির ঘ্রাণ এনে দেয়।

৬. ঘুঘু, শালিক, টিয়া, বাবুই, ফিঙে, চড়ুই প্রভৃতি পাখিরাও দেশি পাখির তালিকায় অত্যন্ত পরিচিত।

অতিথি পাখি:

শীতকাল এলে বাংলাদেশের হাওর-বাঁওড়, জলাশয় ও নদীতীরে বিভিন্ন দেশের হাজার হাজার পাখি অতিথি হয়ে আসে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো:

১. বাঁশপাতি,

২. পানকৌড়ি,

৩. রাজসরালি,

৪. গাংচিল,

৫. চখাচখি,

৬. ম্যাজেন্টা হাঁস,

৭. বেগুনিপিঠু ইত্যাদি।

এই পাখিগুলি মূলত সাইবেরিয়া, চীন, হিমালয় ও মঙ্গোলিয়া থেকে আসে। বাংলাদেশে এরা নিরাপদে আশ্রয়, খাদ্য ও বিশ্রাম পায় বলেই প্রতিবছর শীতকালে এদের আগমন ঘটে। এরা বাংলাদেশের পরিবেশকে বৈচিত্র্যময় করে তোলে।

পাখির বাসস্থান ও খাদ্যাভ্যাস:

পাখিরা মূলত গাছের ডালে, বাঁশঝাড়ে, ঝোপঝাড়ে বা কুঁড়ে ঘরের ধারে বাসা তৈরি করে। বাবুই পাখির বাসা সবচেয়ে বিখ্যাত এবং শিল্পসুলভ। কিছু পাখি মাটিতে বাসা করে, যেমন- তিতির, টিয়া। আবার পানির ওপরে বাসা করে এমন পাখিও রয়েছে।

খাদ্যের দিক থেকে পাখিদের মধ্যে বৈচিত্র্য রয়েছে। কেউ ফলমূল খায় (টিয়া), কেউ কীট-পতঙ্গ খায় (দোয়েল, চড়ুই), কেউ শিকার করে (বাজপাখি), আবার কেউ মাছ খায় (পানকৌড়ি)।

পরিবেশে পাখির গুরুত্ব:

পাখিরা পরিবেশ রক্ষায় বিশেষ ভূমিকা রাখে। এরা কীটপতঙ্গ খেয়ে কৃষির ক্ষতি কমায়, ফলে কৃষক উপকৃত হয়। আবার কিছু পাখি ফুলের পরাগায়নে সাহায্য করে। পাখিদের বিষ্ঠা মাটির উর্বরতা বাড়ায়। তাছাড়া পাখি পরিবেশকে সজীব ও প্রাণবন্ত রাখে, প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা করে।

পাখি ও আমাদের সংস্কৃতি:

বাংলা সাহিত্য, কবিতা, গান ও লোকসংস্কৃতিতে পাখির গুরুত্ব অপরিসীম। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “আমার সোনার বাংলা” গানেও পাখির উল্লেখ আছে। লালন, নজরুল, জসীমউদ্দীনসহ বহু কবি ও সাহিত্যিক তাদের রচনায় পাখিকে স্থান দিয়েছেন। লোকগানে দোয়েল, কোকিল, টিয়া, ময়না প্রভৃতি পাখি প্রেম, বিরহ ও প্রকৃতির প্রতীক হয়ে উঠেছে।

পাখির প্রতি হুমকি:

বর্তমানে মানুষের লোভ ও অসচেতনতার কারণে পাখির অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়েছে। বনজঙ্গল ধ্বংস, জলাশয় ভরাট, কীটনাশকের ব্যবহার, শিকার ও পাচারের কারণে অনেক প্রজাতির পাখি আজ বিলুপ্তপ্রায়। অতিথি পাখিদের অনেক সময় শিকার করে বাজারে বিক্রি করা হয়, যা পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।

পাখি সংরক্ষণে করণীয়:

পাখিদের বাঁচিয়ে রাখতে হলে আমাদের সচেতন হতে হবে। বনজঙ্গল সংরক্ষণ, জলাশয় রক্ষা, পাখি শিকারের বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রয়োগ, স্কুল-কলেজে পাখি বিষয়ক সচেতনতা কার্যক্রম চালু করা, পাখির আবাসস্থল রক্ষা ও কৃত্রিম বাসা স্থাপন ইত্যাদি উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। তাছাড়া জনসচেতনতা বৃদ্ধি ও পরিবেশবান্ধব চিন্তাধারা গড়ে তুলতে হবে।

উপসংহার:

পাখি শুধু প্রকৃতির সৌন্দর্য নয়, আমাদের পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষাকারী এক অপরিহার্য উপাদান। এদের কলতান আমাদের মনকে প্রশান্ত করে তোলে, আবার কৃষিক্ষেত্রেও উপকার করে। তাই আমাদের উচিত এদের ভালোবাসা, সংরক্ষণ ও নিরাপদ আশ্রয় নিশ্চিত করা। যদি আমরা এখনই সচেতন না হই, তাহলে ভবিষ্যতে আমরা পাখিহীন এক নীরস প্রকৃতির মুখোমুখি হবো।

Post a Comment