বাংলাদেশের কুটির শিল্প রচনা ২০ পয়েন্ট

বাংলাদেশের কুটির শিল্প

ভূমিকা

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে কুটির শিল্প একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। এই শিল্প দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর আয় বৃদ্ধির একটি অন্যতম প্রধান উপায় হল এই কুটির শিল্প। এটি শুধুমাত্র অর্থনৈতিক উপার্জনের উৎস নয়, বরং এটি আমাদের সংস্কৃতি, ইতিহাস এবং জীবনধারার এক জীবন্ত দলিল।

কুটির শিল্পের ধারণা

কুটির শিল্প বলতে বোঝানো হয় এমন শিল্প যা ছোট আকারে, পারিবারিক পরিবেশে, স্বল্প মূলধন, স্বল্প যন্ত্রপাতি এবং সাধারণত হাতে তৈরি পণ্য উৎপাদনের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। এটি মূলত গ্রামীণ জনগণের দ্বারা গৃহভিত্তিকভাবে পরিচালিত হয়। এই শিল্পে পুঁজি ও যন্ত্রপাতির ব্যবহার সীমিত হলেও শ্রম ও দক্ষতার প্রয়োগ সর্বোচ্চ মাত্রায় হয়ে থাকে।


কুটির শিল্পের ইতিহাস

বাংলাদেশের কুটির শিল্পের ইতিহাস বহু পুরনো। প্রাচীন বাংলার সভ্যতায় বিভিন্ন কুটির শিল্প যেমন তাঁতশিল্প, মৃৎশিল্প, ধাতব শিল্প ইত্যাদি ব্যাপকভাবে প্রসার লাভ করেছিল। মুঘল ও ব্রিটিশ আমলেও এই শিল্পগুলো সমৃদ্ধ ছিল। বিশেষ করে ঢাকার মসলিন কাপড় তার সূক্ষ্মতা ও গুণমানে সারা বিশ্বে খ্যাতি অর্জন করেছিল। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলে এই শিল্প অনেকটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তবে স্বাধীনতার পর থেকে তা আবার নতুন করে গতি লাভ করতে শুরু করে।

কুটির শিল্পের ধরন

বাংলাদেশে কুটির শিল্পের বিভিন্ন ধরন রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো:

১. তাঁত শিল্প

তাঁত শিল্প বাংলাদেশের অন্যতম প্রাচীন এবং বিস্তৃত কুটির শিল্প। এটি মূলত নারায়ণগঞ্জ, টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জ, জামালপুর ও নওগাঁ অঞ্চলে ব্যাপকভাবে প্রচলিত। টাঙ্গাইল ও জামদানি শাড়ি এ শিল্পের উৎকৃষ্ট নিদর্শন।

২. মৃৎশিল্প

মাটির তৈরি পাত্র, খেলনা, প্রতিমা ইত্যাদি নির্মাণ এই শিল্পের অন্তর্ভুক্ত। কুমার সম্প্রদায় এই শিল্পের সাথে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে যুক্ত। রাজশাহী, কুমিল্লা, সিলেট অঞ্চলে এটি প্রচলিত।

৩. কাঠ ও বাঁশের শিল্প

বাঁশ, বেত ও কাঠ দিয়ে তৈরি করা ঝুড়ি, চেয়ার, হাতপাখা, ঘরের সাজসজ্জার সামগ্রী এই শিল্পের মধ্যে পড়ে। এটি মূলত পাহাড়ি অঞ্চল এবং উত্তরবঙ্গের গ্রামীণ এলাকাগুলোতে বেশি প্রচলিত।

৪. ধাতব ও চামড়াজাত শিল্প

পিতল, তামা, লোহা, রুপা ইত্যাদি ধাতু দিয়ে তৈরি বাসনপত্র, অলংকার এবং চামড়া দিয়ে তৈরি জুতা, ব্যাগ, বেল্ট ইত্যাদি এই শিল্পের অন্তর্গত।

৫. কাঁথা শিল্প

পুরাতন কাপড় ও সুতা দিয়ে তৈরি কারুশিল্পের অনন্য নিদর্শন হলো কাঁথা। এটি একটি বিশেষ ধরনের হস্তশিল্প যা নানান রঙ ও নকশায় অলংকৃত হয়।

৬. হস্তশিল্প ও কারুশিল্প

মণিপুরী তাঁত, নকশিকাঁথা, সিল্ক কাজ, রেশম শিল্প ইত্যাদি বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রসারিত কুটির শিল্পের অংশ।

কুটির শিল্পের অর্থনৈতিক গুরুত্ব

বাংলাদেশের কুটির শিল্প অর্থনীতির এক গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। এটি দেশের মোট কর্মসংস্থানের একটি বড় অংশ সরবরাহ করে থাকে। বিশেষ করে নারী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য এটি একটি কার্যকর জীবন-জীবিকার উপায়।

১. কর্মসংস্থান সৃষ্টি

কুটির শিল্প পুঁজির তুলনায় বেশি শ্রমনির্ভর হওয়ায় গ্রামীণ জনগণের মধ্যে ব্যাপক হারে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে। নারী ও গৃহিণীরা ঘরে বসে এই শিল্পে যুক্ত হয়ে নিজেদের অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করতে পারছেন।

২. আয় বৃদ্ধির উৎস

কুটির শিল্প গ্রামের মানুষের জন্য একটি নির্ভরযোগ্য আয়ের উৎস। কৃষির ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে বিকল্প পেশার সৃষ্টি করছে কুটির শিল্প।

৩. বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন

বাংলাদেশের কুটির শিল্পজাত পণ্য যেমন জামদানি, নকশিকাঁথা, হস্তশিল্প, চামড়াজাত পণ্য আন্তর্জাতিক বাজারে ব্যাপক চাহিদা সৃষ্টি করেছে। এর ফলে দেশের রপ্তানি আয় বাড়ছে এবং বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয়ন হচ্ছে।

সামাজিক ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব

কুটির শিল্প শুধু অর্থনৈতিক নয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ। এটি মানুষের সংস্কৃতি, রুচি ও ঐতিহ্যের পরিচায়ক।

১. নারীর ক্ষমতায়ন

কুটির শিল্পে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়ায় তারা পরিবারে ও সমাজে সম্মান ও গুরুত্ব পাচ্ছেন। এটি তাদের আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি করছে।

২. ঐতিহ্য সংরক্ষণ

কুটির শিল্প আমাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক। প্রাচীন নকশা ও শৈলীর সংরক্ষণে এই শিল্প গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

৩. গ্রামীণ জীবনের উন্নয়ন

গ্রামের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে কুটির শিল্প গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। এটি শহরমুখী প্রবণতা কমিয়ে গ্রামে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করছে।

কুটির শিল্পের সমস্যা

তবে সম্ভাবনাময় এই শিল্প নানা সমস্যার সম্মুখীন:

১. পুঁজির অভাব

বেশিরভাগ কুটির শিল্পী স্বল্প পুঁজির কারণে বড় পরিসরে উৎপাদন করতে পারেন না।

২. আধুনিক প্রযুক্তির অভাব

আধুনিক যন্ত্রপাতি, প্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণের অভাবে উৎপাদনের গুণগত মান ও দক্ষতা বাড়ানো সম্ভব হচ্ছে না।

৩. বিপণন সমস্যা

পণ্য তৈরি হলেও যথাযথ বিপণনের অভাবে অনেক শিল্পী ন্যায্য মূল্য পান না। মধ্যস্বত্বভোগীরা অধিকাংশ লাভ নিয়ে নেন।

৪. সরকারি সহায়তার সীমাবদ্ধতা

যথাযথ সরকারি তদারকি, ঋণ সুবিধা ও প্রশিক্ষণের অভাবে অনেক সম্ভাবনাময় উদ্যোগ টিকে থাকতে পারে না।

৫. কাঁচামালের সংকট

অনেক ক্ষেত্রেই মানসম্মত কাঁচামাল পাওয়া যায় না, ফলে উৎপাদনে বিঘ্ন ঘটে।

কুটির শিল্পের উন্নয়নে করণীয়

বাংলাদেশের কুটির শিল্পকে টিকিয়ে রাখা এবং সমৃদ্ধ করার জন্য কিছু বাস্তবভিত্তিক পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন:

১. সহজ শর্তে ঋণ সুবিধা

কুটির শিল্প উদ্যোক্তাদের জন্য সহজ শর্তে ও স্বল্পসুদে ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে।

২. প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তির ব্যবহার

সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালু করে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।

৩. বিপণন ও প্রদর্শনী

দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রদর্শনী, ফেস্টিভ্যাল ও অনলাইন প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে পণ্যের বাজার সম্প্রসারণ করা যেতে পারে।

৪. কাঁচামাল সরবরাহ নিশ্চিতকরণ

স্থানীয়ভাবে কাঁচামালের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে হলে বিশেষ অঞ্চলভিত্তিক কাঁচামাল উৎপাদনে সহায়তা করা প্রয়োজন।

৫. কুটির শিল্প নীতিমালা প্রণয়ন

কুটির শিল্পের সার্বিক উন্নয়নের জন্য আলাদা একটি কার্যকর জাতীয় কুটির শিল্প নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে।

উপসংহার

বাংলাদেশের কুটির শিল্প আমাদের ঐতিহ্যের ধারক, অর্থনীতির চালিকাশক্তি এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য একটি ভরসার নাম। এটি শুধু গ্রামীণ উন্নয়ন নয়, নারীর ক্ষমতায়ন, সংস্কৃতি সংরক্ষণ এবং জাতীয় অর্থনৈতিক অগ্রগতির সাথেও জড়িত। যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতা, আধুনিক ব্যবস্থাপনা ও প্রযুক্তির সহায়তায় কুটির শিল্প আরও এগিয়ে যেতে পারে। এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে হলে ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের সমন্বিত প্রচেষ্টার বিকল্প নেই।

Post a Comment