ভাষা আন্দোলন রচনা ২০ পয়েন্ট

ভাষা আন্দোলন: এক ঐতিহাসিক সংগ্রাম

ভূমিকা
ভাষা শুধু মানুষের যোগাযোগের এক মাধ্যম নয়, এটি একটি জাতির সংস্কৃতি, পরিচয় এবং ঐতিহ্যের পরিচায়ক। একটি জাতির ভাষা তার স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব এবং সংস্কৃতির মূল ভিত্তি। কিন্তু বাংলাদেশে, ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর ভাষা বিষয়ে এক চরম সংকট সৃষ্টি হয়। পাকিস্তান সরকারের বাংলা ভাষার প্রতি অবজ্ঞা এবং উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেয়ার প্রতিবাদে বাংলার মানুষের বিরুদ্ধে এক বড় অন্যায় সংঘটিত হয়। এ প্রতিবাদেই গড়ে ওঠে ভাষা আন্দোলন, যা শুধু ভাষার অধিকার নয়, স্বাধীনতা, সত্ত্বা ও জাতীয় আত্মমর্যাদার সংগ্রামে পরিণত হয়। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঘটে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, যেখানে পুলিশ গুলি করে প্রাণ লয় করেন ছাত্ররা। এ ঘটনাটি একদিকে যেমন ভাষার অধিকার রক্ষার সংগ্রাম হিসেবে পরিচিত, তেমনি এটি জাতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক।

ভাষা আন্দোলনের পটভূমি

পাকিস্তান গঠনের পর থেকেই পাকিস্তানি শাসকগণ বাংলা ভাষাকে অবজ্ঞা করতে শুরু করেন। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পাকিস্তান সরকারের পক্ষ থেকে উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এটি ছিল বাংলাভাষী জনগণের জন্য এক অবমাননা, কারণ পশ্চিম পাকিস্তান (বর্তমান পাকিস্তান) এবং পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ) এর ভাষাগত ব্যবধান ছিল। পশ্চিম পাকিস্তানে উর্দু এবং পাঞ্জাবি ভাষা প্রধান হলেও, পূর্ব পাকিস্তানে বাংলাই ছিল জনগণের প্রধান ভাষা।

পাকিস্তান সরকার প্রথম থেকেই বাংলা ভাষাকে অবমূল্যায়ন করতে শুরু করে। একদিকে যেখানে বাংলাভাষী জনগণের সংখ্যাধিক্য ছিল, সেখানে সরকার তাদের ভাষার প্রতি কোনো গুরুত্ব দেয়নি। এই পরিস্থিতি এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, উর্দু ভাষার প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করতে তারা বাংলা ভাষায় লেখা বই, পত্রিকা, সরকারী কাজকর্ম বন্ধ করতে শুরু করে।

ভাষা আন্দোলনের সূচনা

১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর, বাংলাভাষী জনগণ তাদের ভাষার অধিকার চাওয়া শুরু করে। ১৯৪৮ সালে, পাকিস্তান সরকার বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকৃতি জানালে, এর বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রতিবাদ শুরু হয়। তখনকার পাকিস্তান সরকারের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করেন, যা বাংলাভাষী জনগণের মধ্যে তীব্র অসন্তোষের সৃষ্টি করে।

বিশেষভাবে, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, সিলেট এবং ঢাকাসহ অন্যান্য অঞ্চলের ছাত্ররা প্রতিবাদে নামেন। ১৯৪৮ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত একটি সভায় ছাত্ররা ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে রাজপথে নামেন, কিন্তু তৎকালীন সরকার তাদের শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদকে সহ্য করতে পারেনি। পরবর্তী কয়েক বছর ধরে এই প্রতিবাদ জোরালো হতে থাকে।

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি: এক ঐতিহাসিক দিন

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি, বাংলা ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন এক চরম পর্যায়ে পৌঁছায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা রাষ্ট্রভাষা বাংলা দাবিতে ঢাকা শহরের রাজপথে অবস্থান নেন। তারা সরকারকে জানিয়ে দেন যে, তারা উর্দু ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মেনে নেবেন না। পাকিস্তান সরকার তখন তাদের আন্দোলনকে শক্তিপ্রয়োগ করে দমন করতে চায়। ছাত্রদের ওপর গুলি চালানো হয়, এবং এই ঘটনায় ভাষা আন্দোলনের প্রথম শহীদ হিসেবে প্রাণ হারান মেহেদী হাসান, সালাম, বরকতসহ আরো অনেক ছাত্র।

এই হত্যাকাণ্ডের পর, পুরো বাংলাদেশের জনগণ শোকাহত এবং ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। ২১ ফেব্রুয়ারি, ভাষা আন্দোলনের এক ঐতিহাসিক দিন হিসেবে চিহ্নিত হয়। জনগণের আন্দোলন এবং ছাত্রদের আত্মত্যাগে, পাকিস্তান সরকার অবশেষে বাংলা ভাষাকে সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়।

ভাষা আন্দোলনের প্রভাব

ভাষা আন্দোলন শুধু ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে সহায়ক হয়নি, বরং এটি একটি বৃহত্তর স্বাধীনতা আন্দোলনে পরিণত হয়। বাংলাভাষী জনগণ, যারা পূর্ব পাকিস্তানের নাগরিক, তাদের সাংস্কৃতিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক অধিকারকে প্রতিষ্ঠিত করতে শুরু করে। ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে তারা বুঝতে পারে যে, তাদের রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব সুরক্ষিত রাখার জন্য ঐক্যবদ্ধভাবে সংগ্রাম করতে হবে।

ভাষা আন্দোলন পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের দমননীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও সংগ্রামের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়ায়। এই আন্দোলন সাধারণ মানুষের মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনা ও আত্মমর্যাদাবোধ সঞ্চারিত করে, যা পরবর্তীকালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের মূল ভিত্তি হিসেবে কাজ করে।

ভাষা আন্দোলনের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি

ভাষা আন্দোলনের পর, এর গুরুত্ব শুধু বাংলাদেশে সীমাবদ্ধ থাকেনি। ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে UNESCO কর্তৃক ঘোষণা করা হয় ১৯৯৯ সালে। এই ঘোষণার মাধ্যমে, পৃথিবীজুড়ে ভাষার অধিকার রক্ষার আন্দোলনের গুরুত্ব আন্তর্জাতিক স্তরে স্বীকৃত হয়। এটি বিশ্বের সকল জনগণের ভাষাগত অধিকার রক্ষার সংগ্রামের প্রতি একটি সম্মান প্রদর্শন।

বাংলাদেশে, ২১ ফেব্রুয়ারি পালন করা হয় মাতৃভাষা দিবস হিসেবে, যেখানে শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয় ভাষা আন্দোলনের শহীদদের। এর মাধ্যমে, বিশ্ববাসীকে মনে করিয়ে দেয়া হয় যে, ভাষা শুধুমাত্র শব্দের সংকলন নয়, এটি একটি জাতির অস্তিত্ব এবং ঐতিহ্যের প্রতীক।

ভাষা আন্দোলনের পরবর্তী প্রভাব

ভাষা আন্দোলন, যা একদিকে ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম ছিল, অন্যদিকে একটি জাতির সংগ্রাম হয়ে ওঠে। এটি বাঙালি জাতির মধ্যে এক নতুন চেতনা সৃষ্টি করে, যা পরবর্তীকালে স্বাধীনতা সংগ্রামের ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে একজাতীয় চেতনা এবং তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রতি সচেতনতা বৃদ্ধি পায়।

পাকিস্তান সরকার তখনও তাদের শাসন ব্যবস্থায় কোন পরিবর্তন আনতে চায়নি, কিন্তু বাংলাভাষী জনগণের এই সংগ্রাম তাদের পরবর্তী রাজনৈতিক সংগ্রামের সূচনা হয়। ১৯৭১ সালে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম, যা ভাষা আন্দোলনের পরবর্তী একটি বড় ধাপ, সাফল্য লাভ করে। ভাষা আন্দোলনের শহীদদের রক্তের বিনিময়ে, বাংলাভাষী জনগণের অধিকার এবং স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠিত হয়।

উপসংহার

ভাষা আন্দোলন ছিল একটি জাতীয় সংগ্রামের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত, যা একদিকে ভাষার অধিকার রক্ষা এবং অন্যদিকে একটি জাতির মুক্তির চেতনা হিসেবে প্রকাশ পায়। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি, ভাষা আন্দোলনের শহীদদের আত্মত্যাগ জাতির ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবে। আজকের মাতৃভাষা দিবস আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, ভাষা শুধু যোগাযোগের উপায় নয়, এটি একটি জাতির সাংস্কৃতিক পরিচয়, তার অস্তিত্বের শক্তি। ভাষা আন্দোলনের মর্মে নিহিত সংগ্রাম আজও আমাদের অন্তরে বেঁচে আছে এবং আমাদের স্বাধীনতা ও আত্মমর্যাদা রক্ষার পথ দেখায়।

Post a Comment