বিজ্ঞান ও কুসংস্কার
ভূমিকা:
বিজ্ঞান মানুষের জ্ঞানভিত্তিক অনুসন্ধান আর কুসংস্কার হলো অজ্ঞতা ও অন্ধবিশ্বাসের ফল। একদিকে বিজ্ঞান মানুষকে যুক্তিবাদী ও বাস্তবভিত্তিক করে তোলে, অন্যদিকে কুসংস্কার তাকে অন্ধকারে নিয়ে যায়। এই দুইয়ের দ্বন্দ্ব মানব সভ্যতার ইতিহাসে দীর্ঘকাল ধরে বিরাজমান। আধুনিক যুগে বিজ্ঞান আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে বিস্ময়কর পরিবর্তন এনেছে, অথচ এখনো বহু মানুষ নানা ধরনের কুসংস্কারে ডুবে আছে।
বিজ্ঞান কী:
বিজ্ঞান হলো পর্যবেক্ষণ, পরীক্ষা ও যুক্তি-নির্ভর জ্ঞানব্যবস্থা। এটি প্রকৃতি ও বিশ্বজগত সম্পর্কে প্রশ্ন তোলে, তার উত্তর খোঁজে এবং বাস্তব প্রমাণের মাধ্যমে সিদ্ধান্তে পৌঁছায়। বিজ্ঞান মানুষকে নতুন আবিষ্কারে উদ্বুদ্ধ করে, অজানাকে জানা ও অন্ধকারকে দূর করার উপায় শেখায়। যেমন: পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘোরে, এই সত্যটি কেবল বিজ্ঞানের মাধ্যমেই জানা সম্ভব হয়েছে।
কুসংস্কার কী:
কুসংস্কার হলো এমন বিশ্বাস বা ধারণা, যার পেছনে কোনো যুক্তি, বৈজ্ঞানিক ভিত্তি বা প্রমাণ নেই। এটি সাধারণত ভয়, ধর্মীয় ভ্রান্ত ধারণা, অথবা দীর্ঘদিনের সামাজিক প্রচলনের ফলাফল। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়—কালো বিড়াল রাস্তা পার হলে অমঙ্গল হবে, শুক্রবার ১৩ তারিখে কিছু করা অনুচিত, গৃহস্থালী কাজের মাঝে হাঁচি দিলে কাজ বন্ধ রাখা উচিত—এইসবই কুসংস্কার।
বিজ্ঞান ও কুসংস্কারের পার্থক্য:
বিষয় ------বিজ্ঞান -----------কুসংস্কার
ভিত্তি - যুক্তি, পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষা -অন্ধবিশ্বাস ও গুজব
ফলাফল ---জ্ঞান ও উন্নতি ---ভয় ও পশ্চাদপদতা
উদ্দেশ্য ---সত্য অনুসন্ধান ---অজানাকে ভয় করা
প্রভাব --সমাজ উন্নয়ন --সমাজে বিভ্রান্তি ও ভীতি
কুসংস্কারের কারণ:
- অশিক্ষা ও অজ্ঞতা: মানুষ যখন শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হয়, তখন তারা সহজেই অন্ধবিশ্বাসে প্রভাবিত হয়।
- ভয় ও নিরাপত্তাহীনতা: প্রাকৃতিক দুর্যোগ, রোগ বা মৃত্যু সম্পর্কে অজানা ভয় মানুষকে কুসংস্কারের দিকে ঠেলে দেয়।
- সামাজিক প্রথা ও ধর্মীয় ভুল ব্যাখ্যা: অনেক সময় ধর্মের ভুল ব্যাখ্যার ফলে কুসংস্কার ছড়ায়।
- পরিবার ও সমাজের প্রভাব: শিশুদের ছোটবেলা থেকে পরিবার ও সমাজ যেসব কুসংস্কার শেখায়, তা বড় হয়েও থেকে যায়।
বিজ্ঞান কীভাবে কুসংস্কার দূর করে:
- বিজ্ঞান মানুষের মনে প্রশ্ন করার ক্ষমতা জাগিয়ে তোলে। যেকোনো ঘটনার পেছনের কারণ খুঁজে বের করার চেষ্টা করে। উদাহরণস্বরূপ:
- অতীতে মনে করা হতো, বজ্রপাত ঈশ্বরের অভিশাপ। বিজ্ঞান জানিয়েছে, এটি প্রকৃতির এক বৈদ্যুতিক প্রতিক্রিয়া।
- মহামারি রোগকে ভগবানের শাস্তি মনে করা হতো। আজ আমরা জানি, এগুলো ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণের ফল।
- যেখানে বিজ্ঞান আলো জ্বালায়, সেখানে কুসংস্কারের অন্ধকার আপনাআপনিই দূর হয়।
কুসংস্কারের ক্ষতিকর দিক:
- স্বাস্থ্যঝুঁকি: অনেকে চিকিৎসকের পরামর্শ না নিয়ে ঝাড়ফুঁক, কবিরাজি বা তাবিজে বিশ্বাস করে, ফলে রোগ জটিল হয়ে যায়।
- নারী নির্যাতন: কুসংস্কারের কারণে বহু নারীকে ডাইনি, অপয়া, বা ‘অলক্ষ্মী’ বলে সমাজ থেকে বর্জিত করা হয়।
- অগ্রগতির বাধা: বিজ্ঞান-ভিত্তিক চিন্তা না থাকলে মানুষ উন্নত জীবনের পথে এগোতে পারে না।
- সামাজিক বৈষম্য ও বিভাজন: জাতপাত, ছোঁয়াছুঁয়ি, জন্মতারিখ বা রাশিচক্রের ওপর ভিত্তি করে বিভেদ কুসংস্কারের ফল।
বাংলাদেশে কুসংস্কারের উদাহরণ:
- বাংলাদেশেও কুসংস্কারের শিকড় গভীর। যেমন:
- সন্তান না হলে স্ত্রীকে দোষারোপ করা।
- রোগ হলে ঝাড়ফুঁক ও ওঝার শরণাপন্ন হওয়া।
- গর্ভবতী নারীর উপর “অশুভ ছায়া” পড়ে বলে মনে করা।
- পরীক্ষার আগে বিশেষ রঙের জামা বা তাবিজ পড়া।
- এইসব কুসংস্কার শুধু হাস্যকর নয়, অনেক সময় বিপজ্জনকও হতে পারে।
বিজ্ঞানমনস্ক সমাজ গঠনের উপায়:
- সার্বজনীন শিক্ষা বিস্তার: শিক্ষাই কুসংস্কার দূর করার প্রধান হাতিয়ার।
- বিজ্ঞান চর্চা ও গবেষণার সুযোগ: স্কুল-কলেজে বিজ্ঞান ক্লাব, প্রদর্শনী, বিজ্ঞান মেলা ইত্যাদি চালু করতে হবে।
- বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি: গণমাধ্যম, নাটক, বই ও সিনেমার মাধ্যমে বিজ্ঞান জনপ্রিয় করতে হবে।
- ধর্ম ও বিজ্ঞানের সহাবস্থান: ধর্মীয় মূল্যবোধ ও বিজ্ঞান-ভিত্তিক যুক্তি একে অপরের পরিপূরক হতে পারে।
উপসংহার:
বিজ্ঞান ও কুসংস্কার—এই দুই শক্তি দুই বিপরীত মেরুতে অবস্থান করে। একটি মানুষকে আলোর পথে নিয়ে যায়, আরেকটি অন্ধকারে ঠেলে দেয়। তাই আমাদের উচিত বিজ্ঞানমনস্ক ও যুক্তিনির্ভর জীবনযাপন গড়ে তোলা। আজকের শিক্ষার্থীরাই আগামী দিনের নেতৃত্ব দেবে; তারা যদি কুসংস্কার দূর করে বিজ্ঞানকে ভালোবাসে, তাহলে সমাজ, জাতি এবং সমগ্র পৃথিবীই হবে আরও সুন্দর, উন্নত ও মানবিক।