করোনা ভাইরাস রচনা ২০ পয়েন্ট। করোনা ভাইরাস রচনা বাংলা class 7,8,910

করোনা ভাইরাস

ভূমিকা:

বিশ্বব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করা এক ভয়ংকর ভাইরাসের নাম করোনা ভাইরাস বা কোভিড-১৯। এটি ২০১৯ সালের শেষদিকে চীনের উহান শহর থেকে ছড়িয়ে পড়ে এবং কিছু সময়ের মধ্যেই মহামারিতে রূপ নেয়। এ ভাইরাসের কারণে পুরো পৃথিবী এক সময় স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। মানবসভ্যতা এক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছিল, যা ইতিহাসে নজিরবিহীন। করোনা ভাইরাস আমাদের স্বাস্থ্য, অর্থনীতি, শিক্ষা, সামাজিক জীবনসহ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে গভীর প্রভাব ফেলেছে।

করোনা ভাইরাস কী:

করোনা ভাইরাস একটি সংক্রামক ভাইরাস যা মানবদেহে শ্বাসতন্ত্রে আক্রমণ করে। এটি “Severe Acute Respiratory Syndrome Coronavirus 2” (SARS-CoV-2) নামক ভাইরাস দ্বারা সৃষ্ট হয়। মূলত এটি একটি “RNA ভাইরাস” যা মানুষের শরীরের কোষে ঢুকে সংক্রমণ ঘটায়। করোনা শব্দটি এসেছে ল্যাটিন “Corona” থেকে যার অর্থ মুকুট। কারণ এই ভাইরাসের গায়ে মুকুটের মতো স্পাইক থাকে।


উৎপত্তি ও বিস্তার:

২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহরে প্রথম এই ভাইরাস শনাক্ত হয়। বিজ্ঞানীরা ধারণা করেন যে এই ভাইরাসের উৎপত্তি বাদুড় থেকে হলেও এটি হয়তো অন্য কোনো প্রাণীর (যেমন প্যাংগোলিন) মাধ্যমে মানুষের দেহে প্রবেশ করেছে। চীনের একটি সামুদ্রিক বাজার থেকে এটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে ভাইরাসটি পৃথিবীর প্রায় সব দেশে ছড়িয়ে পড়ে। ২০২০ সালের মার্চ মাসে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) একে বৈশ্বিক মহামারি হিসেবে ঘোষণা করে।

সংক্রমণ পদ্ধতি:

করোনা ভাইরাস ছোঁয়াচে রোগ। এটি প্রধানত একজন আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি-কাশি, নিঃশ্বাস, সংস্পর্শ এবং ব্যবহার্য জিনিসপত্রের মাধ্যমে অন্য মানুষের শরীরে প্রবেশ করে। এছাড়া ঘন জনবসতিপূর্ণ এলাকায় মাস্ক ছাড়া চলাফেরা, হাত না ধোয়া, নাকে-মুখে হাত দেওয়া ইত্যাদি কারণে এটি সহজেই ছড়িয়ে পড়ে।

লক্ষণসমূহ:

করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তির মাঝে সাধারণত নিম্নোক্ত লক্ষণগুলো দেখা যায়:

  • জ্বর
  • শুকনো কাশি
  • শ্বাসকষ্ট
  • গলা ব্যথা
  • স্বাদ ও গন্ধ না পাওয়া
  • মাথাব্যথা ও শরীর ব্যথা
  • দুর্বলতা
  • মাঝে মাঝে ডায়রিয়া বা বমি

তবে অনেক ক্ষেত্রে লক্ষণহীন সংক্রমণও হয়, যা ভাইরাস ছড়ানোর ক্ষেত্রে আরও বিপজ্জনক।

করোনা ও মৃত্যুহার:

এই ভাইরাসে সংক্রমিত অনেকেই সুস্থ হয়ে ওঠেন, তবে কিছু ক্ষেত্রে এটি গুরুতর অবস্থার সৃষ্টি করে যেমন- নিউমোনিয়া, শ্বাসকষ্ট, হৃদযন্ত্রে জটিলতা এবং মৃত্যুও ঘটায়। বয়স্ক মানুষ এবং যাদের আগে থেকেই নানা রোগ রয়েছে (ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ) তারা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ।

বাংলাদেশে করোনা:

বাংলাদেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয় ২০২০ সালের মার্চ মাসে। এরপর ধীরে ধীরে এটি দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে। সরকার সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে, স্কুল-কলেজ বন্ধ করে দেওয়া হয়, লকডাউন আরোপ করা হয়। স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উপর ব্যাপক চাপ পড়ে। বহু মানুষ আক্রান্ত হন এবং বহু মানুষ প্রাণ হারান। পরবর্তীতে ধাপে ধাপে ব্যবস্থা নেওয়া হয়, যেমন- হাসপাতাল প্রস্তুত, আইসোলেশন কেন্দ্র স্থাপন, মাস্ক বাধ্যতামূলক করা, টিকা প্রদান ইত্যাদি।

করোনার প্রভাব:

করোনা ভাইরাসের প্রভাব আমাদের জীবনের সব খাতে অনুভূত হয়েছে। নিম্নে কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব তুলে ধরা হলো:

১. স্বাস্থ্যখাতে বিপর্যয়: হাসপাতালে রোগীর চাপ, চিকিৎসাসেবা ব্যাহত, চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা ঝুঁকির সম্মুখীন হন।

২. অর্থনৈতিক মন্দা: ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যায়, হাজার হাজার মানুষ চাকরি হারায়, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও দিনমজুররা মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হন।

৩. শিক্ষাখাত: স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যায়, অনলাইন শিক্ষা চালু হলেও তা সবাই গ্রহণ করতে পারেনি।

৪. মানসিক স্বাস্থ্য: গৃহবন্দিত্ব, অনিশ্চয়তা ও আতঙ্ক মানুষকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে তোলে।

৫. সামাজিক পরিবর্তন: মানুষ একে অপরের থেকে দূরত্ব বজায় রাখতে শুরু করে, সামাজিক সম্পর্ক দুর্বল হয়।

করোনা মোকাবিলায় করণীয়:

করোনা মোকাবিলায় সরকারের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের সচেতনতা অত্যন্ত জরুরি। নিচে কিছু করণীয় দেওয়া হলো:

  • নিয়মিত হাত ধোয়া ও স্যানিটাইজার ব্যবহার করা
  • মাস্ক পরিধান করা
  • ভিড় এড়িয়ে চলা ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা
  • টিকা গ্রহণ করা
  • স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা
  • উপসর্গ দেখা দিলে পরীক্ষা ও আইসোলেশন গ্রহণ করা

টিকা ও প্রতিরোধ:

বিজ্ঞানীরা অক্লান্ত পরিশ্রম করে করোনা ভাইরাসের টিকা উদ্ভাবন করেছেন। ফাইজার, মডার্না, অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা, সিনোফার্ম ইত্যাদি টিকা বিশ্বজুড়ে ব্যবহৃত হয়েছে। বাংলাদেশেও কোটি কোটি মানুষ এই টিকা গ্রহণ করেছে। টিকার মাধ্যমে সংক্রমণ ও মৃত্যুহার অনেকটাই কমে এসেছে।

কোভিড-১৯ পরবর্তী বাস্তবতা:

করোনা আমাদের শিখিয়েছে কীভাবে একটি ছোট্ট ভাইরাস পুরো মানবসভ্যতাকে বিপর্যস্ত করে দিতে পারে। এটি আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দুর্বলতা, তথ্যপ্রযুক্তির গুরুত্ব, দূরশিক্ষা পদ্ধতির সম্ভাবনা এবং জীবনের অনিশ্চয়তা সম্পর্কে শিক্ষা দিয়েছে। করোনা-পরবর্তী সময়েও আমাদের সতর্ক থাকতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে এ ধরনের মহামারি আর বিস্তার লাভ না করতে পারে।

ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা:

করোনাকালে অনেক মানুষ একে ঈশ্বরের পক্ষ থেকে সতর্কবার্তা হিসেবে দেখেছেন। মানবজাতি যেভাবে প্রকৃতির অপব্যবহার করেছে, পরিবেশ ধ্বংস করেছে, পশু-পাখির অধিকার কেড়ে নিয়েছে, তারই ফল হতে পারে এই মহামারি। এটি আমাদেরকে আরও বিনয়ী, মানবিক এবং নৈতিক হওয়ার শিক্ষা দিয়েছে।

উপসংহার:

করোনা ভাইরাস একটি বিশ্বব্যাপী বিপর্যয় সৃষ্টি করলেও এটি আমাদের অনেক শিক্ষা দিয়েছে। আমাদের স্বাস্থ্য সচেতনতা, পারিবারিক মূল্যবোধ, প্রযুক্তি নির্ভরতা ও পরিবেশের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দিয়েছে। এ মহামারি আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছে যে, পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় সম্পদ হলো মানবিকতা, স্বাস্থ্য ও সচেতনতা। তাই ভবিষ্যতে এই শিক্ষা কাজে লাগিয়ে আমাদের একটি সুন্দর, নিরাপদ ও সুষ্ঠু পৃথিবী গড়ে তুলতে হবে।

Post a Comment