জাতীয় বীমা দিবস রচনা

জাতীয় বীমা দিবস

ভূমিকা:

সমাজের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় বীমার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বিভিন্ন ধরনের অনিশ্চয়তা ও ক্ষতির ঝুঁকি থেকে মানুষকে রক্ষা করে বীমা। এই গুরুত্বপূর্ণ খাত সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধি, বীমার গুরুত্ব তুলে ধরা এবং এ খাতের উন্নয়নে অবদান রাখার উদ্দেশ্যে প্রতিবছর বাংলাদেশে “জাতীয় বীমা দিবস” পালিত হয়। এটি বীমা সংশ্লিষ্টদের সম্মাননা প্রদান এবং সাধারণ জনগণকে বীমার প্রতি আগ্রহী করে তোলে।

জাতীয় বীমা দিবসের পটভূমি:

বাংলাদেশ সরকার ২০২০ সালে ১ মার্চকে “জাতীয় বীমা দিবস” হিসেবে ঘোষণা করে। দিনটি বাছাই করার পেছনে একটি বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে—১৮৯৫ সালের ১ মার্চ জন্মগ্রহণ করেন বাংলাদেশে বীমা খাতের পথিকৃৎ ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি ১৯৬০-এর দশকে তৎকালীন ‘গ্রেট ইস্টার্ন ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি’তে কাজ করতেন এবং সে সময় বীমা খাতের উন্নয়নে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন। তাঁর স্মৃতিকে সম্মান জানিয়ে ১ মার্চকেই বীমা দিবস হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে।


বীমার সংজ্ঞা ও গুরুত্ব:

‘বীমা’ শব্দটি এসেছে ইংরেজি শব্দ “Insurance” থেকে, যার অর্থ হলো অনিশ্চয়তা বা ক্ষতির ঝুঁকি থেকে আর্থিক সুরক্ষা প্রদান। এটি একটি আর্থিক ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি, যার মাধ্যমে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান নির্দিষ্ট প্রিমিয়ামের বিনিময়ে বিভিন্ন ধরনের ক্ষতি বা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার আর্থিক ক্ষতিপূরণ পায়। জীবনের অনিশ্চয়তা, রোগব্যাধি, দুর্ঘটনা, ব্যবসায়িক ক্ষতি, অগ্নিকাণ্ড, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ইত্যাদি ক্ষেত্রে বীমা এক ধরনের সুরক্ষা দেয়।

বীমার কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা হলোঃ

  • আর্থিক নিরাপত্তা প্রদান
  • ঝুঁকি হ্রাস
  • সঞ্চয় ও বিনিয়োগের সুযোগ সৃষ্টি
  • ব্যবসায়িক স্থিতিশীলতা
  • অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে অবদান

জাতীয় বীমা দিবস পালনের উদ্দেশ্য:

জাতীয় বীমা দিবস পালনের মূল লক্ষ্য হলো জনগণকে বীমার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সচেতন করা এবং বীমা খাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা। এ দিবসটি উদযাপনের মাধ্যমে নিচের উদ্দেশ্যগুলো পূরণ করা হয়:

বীমা খাতের প্রতি আস্থা সৃষ্টি:

মানুষের মাঝে অনেক সময় বীমা নিয়ে বিভ্রান্তি বা অনাস্থা কাজ করে। দিবসটির মাধ্যমে এই খাতের প্রতি আস্থা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হয়।

বীমার প্রসার ও অংশগ্রহণ বৃদ্ধি:

বেশি সংখ্যক মানুষ যেন বীমার আওতায় আসে, সে লক্ষ্যে জনসচেতনতা গড়ে তোলা হয়।

বীমা কোম্পানির জবাবদিহিতা ও উন্নয়ন:

বীমা প্রতিষ্ঠানগুলোকে নৈতিকতা, স্বচ্ছতা ও দায়িত্ববোধের সাথে পরিচালনার আহ্বান জানানো হয়।

প্রযুক্তিনির্ভর বীমা খাত গড়ে তোলা:

ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনের অংশ হিসেবে বীমা খাতে প্রযুক্তির ব্যবহার ও আধুনিকীকরণে গুরুত্ব দেওয়া হয়।

দিবসটি পালনের উপায়:

জাতীয় বীমা দিবসে সরকার, বেসরকারি বীমা কোম্পানি ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো নানা ধরনের কর্মসূচি গ্রহণ করে। যেমন:

  • বর্ণাঢ্য র‍্যালি ও শোভাযাত্রা
  • আলোচনা সভা ও সেমিনার
  • টিভি-রেডিওতে বিশেষ অনুষ্ঠান
  • পত্র-পত্রিকায় বিশেষ ক্রোড়পত্র
  • অনলাইন ক্যাম্পেইন ও সচেতনতামূলক ভিডিও
  • সম্মাননা প্রদান অনুষ্ঠান (বীমা খাতে অবদান রাখা ব্যক্তিদের)

এছাড়া বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের মাঝে বীমার গুরুত্ব নিয়ে বক্তৃতা, রচনা প্রতিযোগিতা ও কুইজ প্রতিযোগিতা আয়োজন করা হয়।

বীমা খাতের বর্তমান অবস্থা বাংলাদেশে:

বাংলাদেশে বর্তমানে সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে ৭৮টিরও বেশি জীবন ও সাধারণ বীমা কোম্পানি রয়েছে। এর মধ্যে সরকারি দুটি প্রতিষ্ঠান হলো:

  • জীবন বীমা কর্পোরেশন
  • সাধারণ বীমা কর্পোরেশন


বাকি প্রতিষ্ঠানগুলো বেসরকারি মালিকানাধীন। তবে, এখনো দেশের অধিকাংশ মানুষ বীমার আওতার বাইরে রয়েছে। গ্রামাঞ্চলে বীমা সম্পর্কে ধারণা অত্যন্ত কম এবং অনেকের মধ্যেই বীমা নিয়ে নানা ভুল ধারণা রয়েছে।

বীমা খাতের সমস্যা ও চ্যালেঞ্জ:

১. সচেতনতার অভাব:

দেশের বেশিরভাগ মানুষ এখনো বীমার গুরুত্ব ও কার্যকারিতা সম্পর্কে সচেতন নয়।

২. দ্রুত সেবা না পাওয়া:

অনেক সময় গ্রাহকরা ক্ষতিপূরণ পেতে বিলম্বের শিকার হন, যা বীমার উপর আস্থা কমিয়ে দেয়।

৩. প্রতারণামূলক কর্মকাণ্ড:

কিছু অসাধু ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান বীমার নামে প্রতারণা করে, যা খাতটির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করে।

৪. প্রযুক্তির ঘাটতি:

অনেক প্রতিষ্ঠান এখনো পর্যাপ্তভাবে প্রযুক্তিনির্ভর নয়, ফলে সেবা ব্যবস্থায় জটিলতা দেখা দেয়।

উন্নয়নের সম্ভাবনা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা:

বীমা খাতের সুষ্ঠু বিকাশের জন্য সরকার ইতোমধ্যেই বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড রেগুলেটরি অথরিটি (IDRA) বীমা খাতকে আরও গতিশীল, স্বচ্ছ ও আধুনিক করার লক্ষ্যে কাজ করছে। পাশাপাশি সরকার নিম্নোক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে:

  • ডিজিটাল বীমা ব্যবস্থার প্রসার
  • সকল বীমা নীতিমালার বাস্তবায়ন
  • গ্রামীণ পর্যায়ে বীমা সেবা পৌঁছানো
  • বীমা শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ বৃদ্ধি
  • বীমা কোম্পানির কার্যক্রম মনিটরিং

উপসংহার:

জাতীয় বীমা দিবস শুধু একটি আনুষ্ঠানিকতা নয়, এটি একটি দৃষ্টিভঙ্গি বদলানোর প্রয়াস। এই দিবস আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, ঝুঁকিমুক্ত ও নিরাপদ ভবিষ্যতের জন্য বীমা একটি অপরিহার্য মাধ্যম। ব্যক্তিগত ও জাতীয় উন্নয়নে বীমা খাতের অবদান অনস্বীকার্য। তাই আমাদের সকলের উচিত বীমার গুরুত্ব অনুধাবন করে এই খাতে সক্রিয় অংশগ্রহণ করা। বীমা খাত যত শক্তিশালী ও স্বচ্ছ হবে, দেশের অর্থনীতি ততই নিরাপদ ও মজবুত ভিত্তির ওপর দাঁড়াবে।

Post a Comment