জীবনানন্দ দাশের কষ্টের কবিতা

বোধ

আলো-অন্ধকারে যাই—মাথার ভিতরে

স্বপ্ন নয়, কোন্ এক বোধ কাজ করে;

স্বপ্ন নয়—শান্তি নয়—ভালোবাসা নয়,

হৃদয়ের মাঝে এক বোধ জন্ম লয়!

.          আমি তারে পারি না এড়াতে,

সে আমার হাত রাখে হাতে;

.        সব কাজ তুচ্ছ হয়—পণ্ড মনে হয়,

সব চিন্তা—প্রার্থনার সকল সময়

.           শূন্য মনে হয়

শূন্য মনে হয়।



সহজ লোকের মতো কে চলিতে পারে।

কে থামিতে পারে এই আলোয় আঁধারে

সহজ লোকের মতো; তাদের মতন ভাষা কথা

কে বলিতে পারে আর!—কোনো নিশ্চয়তা

কে জানিতে পারে আর? শরীরের স্বাদ

কে বুঝিতে চায় আর?—প্রাণের আহ্লাদ

সকল লোকের মতো কে পাবে আবার!

সকল লোকের মতো বীজ বুনে আর

স্বাদ কই!—ফসলের আকাঙ্ক্ষায় থেকে,

শরীরে মাটির গন্ধ মেখে,

শরীরে জলের গন্ধ মেখে,

উৎসাহে আলোর দিকে চেয়ে

চাষার মতন প্রাণ পেয়ে

কে আর রহিবে জেগে পৃথিবীর ’পরে?

স্বপ্ন নয়—শান্তি নয়—কোন্ এক বোধ কাজ করে

মাথার ভিতরে।


পথে চ’লে পারে—পারাপারে

উপেক্ষা করিতে চাই তারে;

মড়ার খুলির মতো ধ’রে

আছাড় মারিতে চাই, জীবন্ত মাথার মতো ঘোরে

তবু সে মাথার চারিপাশে,

তবু সে চোখের চারিপাশে,

তবু সে বুকের চারিপাশে

আমি চলি, সাথে-সাথে সেও চ’লে আসে।


আমি থামি—

সেও থেমে যায়;


সকল লোকের মাঝে ব’সে

আমার নিজের মুদ্রাদোষে

আমি একা হতেছি আলাদা?

.          আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

.          আমার পথেই শুধু বাধা?

জন্মিয়াছে যারা এই পৃথিবীতে

.             সন্তানের মতো হ’য়ে—

সন্তানের জন্ম দিতে-দিতে

.           যাহাদের কেটে গেছে অনেক সময়,

কিংবা আজ সন্তানের জন্ম দিতে হয়

.          যাহাদের; কিংবা যারা পৃথিবীর বীজখেতে আসিতেছে চ’লে

.           জন্ম দেবে—জন্ম দেবে ব’লে;

.           তাদের হৃদয় আর মাথার মতন

.           আমার হৃদয় না কি? তাহদের মন

.           আমার মনের মতো না কি?

.           —তবু কেন এমন একাকী?

.           তবু আমি এমন একাকী।


হাতে তুলে দেখিনি কি চাষার লাঙল?

বাল্‌টিতে টানিনি কি জল?

কাস্তে হাতে কতোবার যাইনি কি মাঠে?

মেছোদের মতো আমি কতো নদী ঘাটে

ঘুরিয়াছি;

পুকুরের পানা শ্যালা—আঁশ্‌টে গায়ের ঘ্রাণ গায়ে

গিয়েছে জড়ায়ে;

–এই সব স্বাদ;

—এ-সব পেয়েছি আমি; বাতাসের মতন অবাধ

বয়েছে জীবন,

নক্ষত্রের তলে শুয়ে ঘুমায়েছে মন

এক দিন;

এই সব সাধ

জানিয়াছি একদিন—অবাধ—অগাধ;

চ’লে গেছি ইহাদের ছেড়ে

ভালোবেসে দেখিয়াছি মেয়েমানুষেরে,

অবহেলা ক’রে আমি দেখিয়াছি মেয়েমানুষেরে,

ঘৃণা ক’রে দেখিয়াছি মেয়েমানুষেরে;


আমারে সে ভালোবাসিয়াছে,

.                আসিয়াছে কাছে,

উপেক্ষা সে করেছে আমারে,

ঘৃণা ক’রে চ’লে গেছে—যখন ডেকেছি বারে-বারে

.               ভালোবেসে তারে;

তবুও সাধনা ছিলো একদিন–এই ভালোবাসা;

.            আমি তার উপেক্ষার ভাষা

 .           আমি তার ঘৃণার আক্রোশ

অবহেলা ক’রে গেছি; যে-নক্ষত্ৰ—নক্ষত্রের দোষ

আমার প্রেমের পথে বার-বার দিয়ে গেছে বাধা

.              আমি তা’ ভুলিয়া গেছি;

তবু এই ভালোবাসা—ধুলো আর কাদা।


.              মাথার ভিতরে

স্বপ্ন নয়—প্রেম নয়—কোনো এক বোধ কাজ করে।


.           আমি সব দেবতারে ছেড়ে

.           আমার প্রাণের কাছে চ’লে আসি,

.          বলি আমি এই হৃদয়েরে;

.           সে কেন জলের মতো ঘুরে-ঘুরে একা কথা কয়!

.           অবসাদ নাই তার? নাই তার শান্তির সময়?

কোনোদিন ঘুমাবে না? ধীরে শুয়ে থাকিবার স্বাদ

পাবে না কি? পাবে না আহ্লাদ

.         মানুষের মুখ দেখে কোনোদিন!

.         মানুষীর মুখ দেখে কোনোদিন!

.         শিশুদের মুখ দেখে কোনোদিন!


এই বোধ—শুধু এই স্বাদ

.           পায় সে কি অগাধ—অগাধ!

পৃথিবীর পথ ছেড়ে আকাশের নক্ষত্রের পথ

 .          চায় না সে? করেছে শপথ

 .         দেখিবে সে মানুষের মুখ?

 .        দেখিবে সে মানুষীর মুখ?

 .          দেখিবে সে শিশুদের মুখ?

 .          চোখে কালো শিরার অসুখ,

 .         কানে যেই বধিরতা আছে,

যেই কুঁজ—গলগণ্ড মাংসে ফলিয়াছে

.         নষ্ট শসা—পচা চাল্‌কুমড়ার ছাঁচে,

.         যে-সব হৃদয়ে ফলিয়াছে

.                         —সেই সব।


আট বছর আগের একদিন

শোনা গেল লাশকাটা ঘরে

নিয়ে গেছে তারে;

কাল রাতে—ফাল্গুনের রাতের আঁধারে

যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ

মরিবার হল তার সাধ।


বধু শুয়ে ছিলো পাশে—শিশুটিও ছিলো;

প্রেম ছিলো, আশা ছিলো—জ্যোৎস্নায়—তবু সে দেখিল

কোন্‌ ভূত? ঘুম কেন ভেঙে গেল তার?

অথবা হয়নি ঘুম বহুকাল—লাশকাটা ঘরে শুয়ে ঘুমায় এবার।


এই ঘুম চেয়েছিলো বুঝি!

রক্তফেনা মাখা মুখে মড়কের ইঁদুরের মতো ঘাড় গুঁজি

আঁধার ঘুঁজির বুকে ঘুমায় এবার;

কোনোদিন জাগিবে না আর।


‘কোনোদিন জাগিবে না আর

জাগিবার গাঢ় বেদনার

অবিরাম—অবিরাম ভার

সহিবে না আর—’

এই কথা বলেছিলো তারে

চাঁদ ডুবে চলে গেলে—অদ্ভুত আঁধারে

যেন তার জানালার ধারে

উটের গ্রীবার মতো কোনো এক নিস্তব্ধতা এসে।


তবুও তো পেঁচা জাগে;

গলিত স্থবির ব্যাঙ আরো দুই-মুহূর্তের ভিক্ষা মাগে

আরেকটি প্রভাতের ইশারায়—অনুমেয় উষ্ণ অনুরাগে।


টের পাই যূথচারী আঁধারের গাঢ় নিরুদ্দেশে

চারি দিকে মশারির ক্ষমাহীন বিরুদ্ধতা;

মশা তার অন্ধকার সঙ্ঘারামে জেগে থেকে জীবনের স্রোত ভালবেসে।


রক্ত ক্লেদ বসা থেকে রৌদ্রে ফের উড়ে যায় মাছি;

সোনালি রোদের ঢেউয়ে উড়ন্ত কীটের খেলা কত দেখিয়াছি।

ঘনিষ্ঠ আকাশ যেন—যেন কোন্‌ বিকীর্ণ জীবন

অধিকার করে আছে ইহাদের মন;

দুরন্ত শিশুর হাতে ফড়িঙের ঘন শিহরণ

মরণের সাথে লড়িয়াছে;

চাঁদ ডুবে গেলে পর প্রধান আঁধারে তুমি অশ্বত্থের কাছে

একগাছা দড়ি হাতে গিয়েছিলো তবু একা একা;

যে জীবন ফড়িঙের, দোয়েলের—মানুষের সাথে তার হয়নাকো দেখা

এই জেনে।

অশ্বত্থের শাখা

করেনি কি প্রতিবাদ? জোনাকির ভিড় এসে সোনালি

 .           ফুলের স্নিগ্ধ ঝাঁকে

করে নি কি মাখামাখি?

থুরথুরে অন্ধ পেঁচা এসে

বলেনি কি: ‘বুড়ি চাঁদ গেছে বুঝি বেনো জলে ভেসে?

চমৎকার!—

ধরা যাক দু-একটা ইঁদুর এবার।’

জানায় নি পেঁচা এসে এ তুমুল গাঢ় সমাচার?


জীবনের এই স্বাদ—সুপক্ব যবের ঘ্রাণ হেমন্তের বিকেলের—

তোমার অসহ্য রোধ হ’লো;

মর্গে—গুমোটে

থ্যাঁতা ইঁদুরের মতো রক্তমাখা ঠোঁটে!


শোনো

তবু এ মৃতের গল্প;—কোনো

নারীর প্রণয়ে ব্যর্থ হয় নাই;

বিবাহিত জীবনের সাধ

কোথাও রাখে নি কোনো খাদ,

সময়ের উদ্‌বর্তনে উঠে এসে বধূ

মধু–আর মননের মধু

দিয়েছে জানিতে;

হাড়হাভাতের গ্লানি বেদনার শীতে

এ জীবন কোনোদিন কেঁপে ওঠে নাই;

তাই

লাশকাটা ঘরে

চিৎ হয়ে শুয়ে আছে টেবিলের ‘পরে।


জানি—তবু জানি

নারীর হৃদয়—প্রেম—শিশু—গৃহ—নয় সবখানি;

অর্থে নয়, কীর্তি নয়, সচ্ছলতা নয়—

আরো এক বিপন্ন বিস্ময়

আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে

খেলা করে;

আমাদের ক্লান্ত করে

ক্লান্ত- ক্লান্ত করে;

লাশকাটা ঘরে

সেই ক্লান্তি নাই;

তাই

লাশকাটা ঘরে

চিৎ হয়ে শুয়ে আছে টেবিলের ‘পরে।


তবু রোজ রাতে আমি চেয়ে দেখি, আহা,

থুরথুরে অন্ধ পেঁচা অশ্বত্থের ডালে বসে এসে,

চোখ পালটায়ে কয়: ‘বুড়ি চাঁদ গেছে বুঝি বেনো জলে ভেসে?

চমৎকার!—

ধরা যাক দু-একটা ইঁদুর এবার—’

হে প্রগাঢ় পিতামহী, আজও চমৎকার?

আমিও তোমার মতো বুড়ো হব—বুড়ি চাঁদটারে আমি

.       ক’রে দেব কালীদহে বেনো জলে পার;

আমরা দুজনে মিলে শূন্যে চলে যাব জীবনের

.              প্রচুর ভাঁড়ার।

আদিম দেবতারা

আগুন বাতাস জল: আদিম দেবতারা তাদের সর্পিল পারিহাসে

তোমাকে দিল রূপ—

কী ভয়াবহ নির্জণ রূপ তোমাকে দিল তারা ;

তোমার সংস্পর্শের মানুষের রক্তে দিল মাছির মতো কামনা।


আগুন বাতাস জল: আদিম দেবাতারা তাদের বঙ্কিম পরিহাসে

আমাকে দিল লিপি রচনা করবার আবেগ:

যেন আমিও আগুন বাতাস জল,

যেন তোমাকেও সৃষ্টি করছি।


তোমার মুখের রূপ রক্ত নয়, মাংস নয় কামনা নয়,

নিশীথ দেবদারু দ্বীপ;

কোনো দূর নির্জন নীলাভ দ্বীপ;


স্থুল হাতে ব্যবহৃত হয়ে তবু

আমি হারিয়ে যাচ্ছি সুদূর দীপের নক্ষত্রের ছায়ায় ভিতর;


আগুন বাতাস জল: আদিম দেবতারা তাদের বঙ্কিম পরিহাসে

রূপের বীজ ছড়িয়ে চলে পৃথিবীতে,

ছড়িয়ে চলে স্বপ্নের বীজ।


অবাক হযে ভাবি, আজ রাতে কোথায় তুমি?

রূপ কেন নির্জন দেবদারু দ্বীপের নক্ষত্রের ছায়া চেনে না–

পৃথিবীর সেই মানুষীর রূপ?

স্থুল হাতে ব্যবহৃত হ’য়ে—ব্যবহৃত—ব্যবহৃত—ব্যবহৃত—ব্যবহৃত হ’য়ে

ব্যবহৃত–ব্যবহৃত–

আগুন বাতাস জল: আদিম দেবতারা হো হো করে হেসে উঠল;

‘ব্যবহৃত–ব্যবহৃত হয়ে শুয়ারের মাংস হয়ে যায়?’


হো হো করে হেসে উঠলাম আমি!–

চারদিককার অট্টহাসির ভিতর একটা বিরাট তিমির মৃতদেহ নিয়ে

অন্ধকার সমুদ্র স্ফীত হয়ে উঠল যেন;

পৃথিবীর সমস্ত রূপ অমেয় তিমির মৃতদেহের দুর্গন্ধের মতো,

যেখানেই যাই আমি সেই সব সমুদ্রের উল্কায় উল্কায়

কেমন স্বাভাবিক, কী স্বাভাবিক!


ক্যাম্পে

এখানে বনের কাছে ক্যাম্প আমি ফেলিয়াছি;

সারারাত দখিনা বাতাসে

আকাশের চাঁদের আলোয়

এক ঘাইহরিণীর ডাক শুনি—

কাহারে সে ডাকে!


কোথাও হরিণ আজ হতেছে শিকার;

বনের ভিতরে আজ শিকারীবা আসিযাছে,

আমিও তাদের ঘ্রাণ পাই যেন,

এইখানে বিছানায় শুয়ে-শুয়ে

ঘুম আর আসেনাকো

বসন্তের রাতে।


চারিপাশে বনের বিস্ময়,

চৈত্রের বাতাস,

জ্যোৎস্নার শরীরের স্বাদ যেন;

ঘাইমৃগী সারারাত ডাকে;

কোথাও অনেক বনে—যেইখানে জ্যোৎস্না আর নাই

পুরুষহরিণ সব শুনিতেছে শব্দ তার;

তাহারা পেতেছে টের,

আসিতেছে তার দিকে।

আজ এই বিস্ময়ের রাতে

তাহাদের প্রেমের সময় আসিয়াছে;

তাহাদের হৃদয়ের বোন

বনের আড়াল থেকে তাহাদের ডাকিতেছে জ্যোৎস্নায়—

পিপাসার সান্ত্বনায়—আঘ্রাণে—আস্বাদে;

কোথাও বাঘের পাড়া বনে আজ নাই আর যেন;


মৃগদের বুকে আজ কোনো স্পষ্ট ভয় নাই,

সন্দেহের আবছায়া নাই কিছু;

কেবল পিপাসা আছে,

রোমহর্ষ আছে।

মৃগীর মুখের রূপে হয়তো চিতারও বুকে জেগেছে বিস্ময়;

লালসা—আকাঙ্ক্ষা—সাধ—প্রেম—স্বপ্ন স্ফুট হ’য়ে উঠিতেছে সব দিকে

আজ এই বসন্তের রাতে;

এইখানে আমার নকটার্ন।


একে-একে হরিণেরা আসিতেছে গভীর বনের পথ ছেড়ে,

সকল জলের শব্দ পিছে ফেলে অন্য এক আশ্বাসের খোঁজে

দাঁতের—নখের কথা ভুলে গিয়ে তাদের বোনের কাছে ওই

সুন্দরী গাছের নিচে—জ্যোৎস্নায়,

মানুষ যেমন ক’রে ঘ্রাণ পেয়ে আসে তার নোনা মেয়েমানুষের কাছে

হরিণেরা আসিতেছে।

—তাদের পেতেছি আমি টের

অনেক পায়ের শব্দ শোনা যায,

ঘাইমৃগী ডাকিতেছে জ্যোৎস্নায়।

ঘুমাতে পারি না আর;

শুয়ে-শুয়ে থেকে

বন্দুকের শব্দ শুনি;

তারপর বন্দুকের শব্দ শুনি।

চাঁদের আলোষ ঘাইহরিণী আবার ডাকে,

এইখানে প’ড়ে থেকে একা-একা

আমার হৃদয়ে এক অবসাদ জ’মে ওঠে

বন্দুকের শব্দ শুনে-শুনে

হরিণীর ডাক শুনে-শুনে।


কাল মৃগী আসিবে ফিরিয়া;

সকালে—আলোয় তাকে দেখা যাবে—


পাশে তার মৃত সব প্রেমিকেরা প’ড়ে আছে।

মানুষেরা শিখায়ে দিয়েছে তাকে এই সব।


আমার খাবার ডিশে হরিণের মাংসের ঘ্রাণ আমি পাবো,

…মাংস-খাওয়া হ’লো তবু শেষ?

…কেন শেষ হবে?

কেন এই মৃগদের কথা ভেবে ব্যথা পেতে হবে

তাদের মতন নই আমিও কি?

কোনো এক বসন্তের রাতে

জীবনের কোনো এক বিস্ময়ের রাতে

আমাকেও ডাকেনি কি কেউ এসে জ্যোৎস্নায়—দখিনা বাতাসে

ওই ঘাইহরিণীর মতো?


আমার হৃদয়—এক পুরুষহরিণ—

পৃথিবীর সব হিংসা ভুলে গিয়ে

চিতার চোখের ভয়—চমকের কথা সব পিছে ফেলে রেখে

তোমাকে কি চায় নাই ধরা দিতে?

আমার বুকের প্রেম ঐ মৃত মৃগদের মতো

যখন ধূলায রক্তে মিশে গেছে

এই হবিণীব মতো তুমি বেঁচেছিলে নাকি

জীবনের বিস্ময়ের রাতে

কোনো এক বসন্তের রাতে?


তুমিও কাহার কাছে শিখেছিলে।

মৃত পশুদের মতো আমাদের মাংস ল’য়ে আমরাও প’ড়ে থাকি;

বিয়োগের—বিয়োগের—মরণের মুখে এসে পড়ে সব

ঐ মৃত মৃগদের মতো।

প্রেমের সাহস সাধ স্বপ্ন ল’য়ে বেঁচে থেকে ব্যথা পাই, ঘৃণা-মৃত্যু পাই;

পাই না কি?


দোনলার শব্দ শুনি।

ঘাইমৃগী ডেকে যায়,

আমার হৃদয়ে ঘুম আসেনাকো

এক-একা শুয়ে থেকে;

বন্দুকের শব্দ তবু চুপে-চুপে ভুলে যেতে হয়।


ক্যাম্পের বিছানায় রাত তার অন্য এক কথা বলে;

যাহাদের দোনলার মুখে আজ হরিণেরা ম’রে যায়

হরিণের মাংস হাড় স্বাদ তৃপ্তি নিয়ে এলো যাহাদের ডিশে

তাহারাও তোমার মতন;

ক্যাম্পের বিছানায় শুয়ে থেকে শুকাতেছে তাদেরো হৃদয়

কথা ভেবে—কথা ভেবে-ভেবে।

এই ব্যথা—এই প্রেম সব দিকে র’য়ে গেছে—

কোথাও ফড়িঙে-কীটে—মানুষের বুকের ভিতরে,

আমাদের সবের জীবনে।

বসন্তের জ্যোৎস্নায় ওই মৃত মৃগদের মতো

আমরা সবাই।


মৃত্যুর আগে

আমরা হেঁটেছি যারা নির্জন খড়ের মাঠে পউষ সন্ধ্যায়,

দেখেছি মাঠের পারে নরম নদীর নারী ছড়াতেছে ফুল

কুয়াশার; কবেকার পাড়াগাঁর মেয়েদের মতো যেন হায়

তারা সব; আমরা দেখেছি যারা অন্ধকারে আকন্দ ধুন্দুল

জোনাকিতে ভ’রে গেছে; যে-মাঠে ফসল নাই তাহার শিয়রে

চুপে দাঁড়ায়েছে চাঁদ–কোনো সাধ নাই তার ফসলের তরে;


আমরা বেসেছি যারা অন্ধকারে দীর্ঘ শীত রাত্রিটিরে ভালো,

খড়ের চালের পরে শুনিয়াছি মুগ্ধরাতে ডানার সঞ্চার:

পুরোনো পেঁচার ঘ্রাণ; অন্ধকারে আবার সে কোথায় হারালো!

বুঝেছি শীতের রাত অপরূপ, মাঠে-মাঠে ডানা ভাসাবার

গভীর আহ্লাদে ভরা; অশথের ডালে-ডালে ডাকিয়াছে বক;

আমরা বুঝেছি যারা জীবনের এই সব নিভৃত কুহক;


আমরা দেখেছি যারা বুনোহাঁস শিকারীর গুলির আঘাত

এড়ায়ে উড়িয়া যায় দিগন্তের নম্র নীল জ্যোৎস্নার ভিতরে,

আমরা রেখেছি যারা ভালোবেসে ধানের গুচ্ছের ’পরে হাত,

সন্ধ্যার কাকের মতো আকাঙ্ক্ষায় আমরা ফিরেছি যারা ঘরে;

শিশুর মুখের গন্ধ, ঘাস, রোদ, মাছরাঙা, নক্ষত্র, আকাশ

আমরা পেযেছি যারা ঘুরে ফিরে ইহাদের চিহ্ন বারোমাস;


দেখেছি সবুজ পাতা অঘ্রাণের অন্ধকারে হয়েছে হলুদ,

হিজলের জানালায় আলো আর বুলবুলি করিয়াছে খেলা,

ইঁদুর শীতের রাতে রেশমের মতো রোমে মাখিয়াছে খুদ,

চালের ধূসর গন্ধে তরঙ্গেরা রূপ হ’য়ে ঝরেছে দু-বেলা

নির্জন মাছের চোখে; পুকুরের পারে হাঁস সন্ধ্যার আঁধারে

পেয়েছে ঘুমের ঘ্রাণ–মেয়েলি হাতের স্পর্শ ল’য়ে গেছে তারে;


মিনারের মতো মেঘ সোনালি চিলেরে তার জানালায় ডাকে,

বেতের লতার নিচে চড়ুয়ের ডিম যেন নীল হ‘য়ে আছে,

নরম জলের গন্ধ দিয়ে নদী বার বার তীরটিরে মাখে,

খড়ের চালের ছায়া গাঢ় রাতে জ্যোৎস্নার উঠানে পড়িয়াছে;

বাতাসে ঝিঁঝির গন্ধ—বৈশাখের প্রান্তরের সবুজ বাতাসে;

নীলাভ নোনার বুকে ঘন রস গাঢ় আকাঙ্ক্ষায় নেমে আসে;


আমরা দেখেছি যারা নিবিড় বটের নিচে লাল-লাল ফল

পড়ে আছে; নির্জন মাঠের ভিড় মুখ দেখে নদীর ভিতরে;

যত নীল আকাশেরা র’য়ে গেছে খুঁজে ফেরে আরো নীল আকাশের তল;

পথে-পথে দেখিয়াছি মৃদু চোখ ছায়া ফেলে পৃথিবীর ’পরে;

আমরা দেখেছি যারা শুপুরীর সারি বেয়ে সন্ধ্যা আসে রোজ,

প্রতিদিন ভোর আসে ধানের গুচ্ছের মতে সবুজ সহজ;


আমরা বুঝেছি যারা বহুদিন মাস ঋতু শেষ হ’লে পর

পৃথিবীর সেই কন্যা কাছে এসে অন্ধকারে নদীদের কথা

ক’য়ে গেছে; আমরা বুঝেছি যারা পথ ঘাট মাঠের ভিতর

আরো-এক আলো আছে: দেহে তার বিকালবেলার ধূসরতা;

চোখের-দেখার হাত ছেড়ে দিয়ে সেই আলো হ’য়ে আছে স্থির:

পৃথিবীর কঙ্কাবতী ভেসে গিয়ে সেইখানে পায় ম্লান ধূপের শরীর;


আমরা মৃত্যুর আগে কি বুঝিতে চাই আর? জানি না কি আহা,

সব রাঙা কামনার শিয়রে যে দেয়ালের মতো এসে জাগে

ধূসর মৃত্যুর মুখ; একদিন পৃথিবীতে স্বপ্ন ছিলো—সোনা ছিলো যাহা

নিরুত্তর শান্তি পায়; যেন কোন্ মায়াবীর প্রয়োজনে লাগে।

কি বুঝিতে চাই আর?…রৌদ্র নিভে গেলে পাখি পাখালির ডাক

শুনিনি কি? প্রান্তরের কুয়াশায় দেখিনি কি উড়ে গেছে কাক!

বনলতা সেন

হাজার বছর ধ’রে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে,

সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে

অনেক ঘুরেছি আমি; বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে

সেখানে ছিলাম আমি; আরো দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে;

আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,

আমারে দু-দণ্ড শান্তি দিয়েছিলো নাটোরের বনলতা সেন।


চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,

মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য; অতিদূর সমুদ্রের ’পর

হাল ভেঙে যে-নাবিক হারায়েছে দিশা

সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর,

তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে; বলেছে সে, ‘এতদিন কোথায় ছিলেন?’

পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।


সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন

সন্ধ্যা আসে; ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল;

পৃথিবীর সব রং নিভে গেলে পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন

তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল;

সব পাখি ঘরে আসে—সব নদী—ফুরায় এ-জীবনের সব লেনদেন;

থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।

হায় চিল

হায় চিল, সোনালি ডানার চিল, এই ভিজে মেঘের দুপুরে

তুমি আর কেঁদোনাকো উড়ে-উড়ে ধানসিড়ি নদীটির পাশে!

তোমার কান্নার সুরে বেতের ফলের মতো তার ম্লান চোখ মনে আসে;

পৃথিবীর রাঙা রাজকন্যাদের মতো সে যে চ’লে গেছে রূপ নিয়ে দূরে;

আবার তাহারে কেন ডেকে আনো? কে হায় হৃদয় খুঁড়ে

.                           বেদনা জাগাতে ভালোবাসে!

হায় চিল, সোনালি ডানার চিল, এই ভিজে মেঘের দুপুরে

তুমি আর উড়ে-উড়ে কেঁদোনাকো ধানসিড়ি নদীটির পাশে।

কুড়ি বছর পরে

আবার বছর কুড়ি পরে তার সাথে দেখা হয় যদি!

আবার বছর কুড়ি পরে—

হয়তো ধানের ছড়ার পাশে

কার্তিকের মাসে—

তখন সন্ধ্যার কাক ঘরে ফেরে—তখন হলুদ নদী

নরম-নরম হয় শর কাশ হোগলায়—মাঠের ভিতরে।


অথবা নাইকো ধান খেতে আর;

ব্যস্ততা নাইকো আর,

হাঁসের নীড়ের থেকে খড়

পাখির নীড়ের থেকে খড়

ছড়াতেছে; মনিয়ার ঘরে রাত, শীত আর শিশিরের


জীবন গিয়েছে চলে আমাদের কুড়ি-কুড়ি বছরের পার—

তখন হঠাৎ যদি মেঠে পথে পাই আমি তোমারে আবার!


হয়তো এসেছে চাঁদ মাঝরাতে একরাশ পাতার পিছনে

সরু-সরু কালো-কালো ডালপালা মুখে নিয়ে তার,

শিরীষের অথবা জামের,

ঝাউয়ের—আমের;

কুড়ি বছরের পরে তখন তোমারে নাই মনে!


জীবন গিয়েছে চ’লে আমাদের কুড়ি-কুড়ি বছরের পার—

তখন আবার যদি দেখা হয় তোমার আমার!


তখন হয়তো মাঠে হামাগুড়ি দিয়ে পেঁচা নামে—

বাবলার গলির অন্ধকারে

অশথের জানালার ফাঁকে

কোথায় লুকায় আপনাকে!

চোখের পাতার মতো নেমে চুপি কোথায় চিলের ডানা থামে—


সোনালি-সোনালি চিল—শিশির শিকার ক’রে নিয়ে গেছে তারে—

কুড়ি বছরের পরে সেই কুয়াশায় পাই যদি হঠাৎ তোমারে!

ঘাস

কচি লেবুপাতার মতো নরম সবুজ আলোয়

.        পৃথিবী ভ’রে গিয়েছে এই ভোরের বেলা;

কাঁচা বাতাবীর মতো সবুজ ঘাস—তেম্নি সুঘ্রাণ—

.       হরিণেরা দাঁত দিয়ে ছিঁড়ে নিচ্ছে।

আমারো ইচ্ছা করে এই ঘাসের ঘ্রাণ হরিৎ মদের মতো

.        গেলাসে-গেলাসে পান করি,

এই ঘাসের শরীর ছানি– চোখে চোখ ঘষি,

.        ঘাসের পাখনায় আমার পালক,

ঘাসের ভিতর ঘাস হ’য়ে জন্মাই কোনো এক নিবিড় ঘাস-মাতার

.        শরীরের সুস্বাদ অন্ধকার থেকে নেমে।


বুনো হাঁস

পেঁচার ধূসর পাখা উড়ে যায় নক্ষত্রের পানে—

জলা মাঠ ছেড়ে দিয়ে চাঁদের আহ্বানে

বুনো হাঁস পাখা মেলে—সাঁই-সাঁই শব্দ শুনি তার;

এক—দুই—তিন—চার—অজস্র—অপার—


রাত্রির কিনার দিয়ে তাহাদের ক্ষিপ্র ডানা ঝাড়া

এঞ্জিনের মতো শব্দে; ছুটিতেছে—ছুটিতেছে তা’রা।

তারপর প’ড়ে থাকে নক্ষত্রের বিশাল আকাশ,

হাঁসের গায়ের ঘ্রাণ—দু-একটা কল্পনার হাঁস;


মনে পড়ে কবেকার পাড়াগাঁর অরুণিমা সান্যালের মুখ;

উড়ুক উড়ুক তা’রা পউষের জ্যোৎস্নায় নীরবে উড়ুক

কল্পনার হাঁস সব; পৃথিবীর সব ধ্বনি সব রং মুছে গেলে পর

উড়ুক উড়ুক তা’রা হৃদয়ের শব্দহীন জ্যোৎস্নার ভিতর।

বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি

বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই আমি পৃথিবীর রূপ

খুঁজিতে যাই না আর: অন্ধকারে জেগে উঠে ডুমুরের গাছে

চেয়ে দেখি ছাতার মতন বড়ো পাতাটির নিচে ব’সে আছে

ভোরের দোয়েল পাখি- চারিদিকে চেয়ে দেখি পল্লবের স্তূপ

জাম-বট-কাঁঠালের-হিজলের-অশ্বত্থের ক’রে আছে চুপ;

ফণীমনসার ঝোপে শটিবনে তাহাদের ছায়া পড়িয়াছে;

মধুকর ডিঙা থেকে না জানি সে কবে চাঁদ চম্পার কাছে

এমনই হিজল-বট-তমালের নীল ছায়া বাংলার অপরূপ রূপ


দেখেছিলো; বেহুলাও একদিন গাঙুড়ের জলে ভেলা নিয়ে-

কৃষ্ণা দ্বাদশীর জ্যোৎস্না যখন মরিয়া গেছে নদীর চড়ায়-

সোনালি ধানের পাশে অসংখ্য অশ্বত্থ বট দেখেছিল, হায়,

শ্যামার নরম গান শুনেছিলো- একদিন অমরায় গিয়ে

ছিন্ন খঞ্জনার মতো যখন সে নেচেছিল ইন্দ্রের সভায়

বাংলার নদী মাঠ ভাঁটফুল ঘুঙুরের মতো তার কেঁদেছিলো পায়।

Post a Comment