মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস
ভূমিকা
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ইতিহাসের এক গৌরবময় অধ্যায়। হাজার বছরের বাঙালির জাতিগত আত্মপরিচয়ের সংগ্রামের সর্বোচ্চ রূপই ছিল ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ। এই যুদ্ধ ছিল একদিকে পাকিস্তানি শাসকদের দীর্ঘদিনের শোষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে, অন্যদিকে ছিল ভাষা, সংস্কৃতি ও জাতিসত্ত্বার মুক্তির সংগ্রাম। ২৬ মার্চ ১৯৭১ থেকে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ পর্যন্ত এই নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম অবশেষে এনে দেয় স্বাধীন বাংলাদেশের সূচনা।
পটভূমি ও কারণ
১৯৪৭ সালে উপমহাদেশ বিভক্ত হয়ে ভারত ও পাকিস্তান দুটি রাষ্ট্র গঠিত হয়। পাকিস্তান দুটি অংশ নিয়ে গঠিত হলেও – পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ) ও পশ্চিম পাকিস্তান – রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা ছিল কেবল পশ্চিম পাকিস্তানের হাতে। পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যা বেশি হলেও সাংবিধানিক, প্রশাসনিক এবং সামরিক দিক থেকে তারা ছিল বৈষম্যের শিকার।
১৯৪৮ সালে উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা ঘোষণার চেষ্টা হয়, যার ফলে শুরু হয় ভাষা আন্দোলন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন ছিল বাঙালি জাতিসত্ত্বার আত্মপ্রকাশের প্রথম প্রতিবাদ। এর পরবর্তী ধাপগুলোতে একের পর এক আন্দোলন – ১৯৬৬ সালের ছয় দফা, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান – মুক্তিযুদ্ধের ভিত্তি গড়ে দেয়।
বিশেষ করে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ছয় দফা আন্দোলন বাঙালির রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির রূপরেখা নির্ধারণ করে দেয়। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করলেও পাকিস্তানি শাসকরা ক্ষমতা হস্তান্তর করেনি। এই অগণতান্ত্রিক আচরণই সরাসরি সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের দিকে দেশকে ঠেলে দেয়।
মুক্তিযুদ্ধের সূচনা
১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঐতিহাসিক ভাষণে বলেন, "এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।" এই ভাষণ ছিল মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাভাস।
২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামক বর্বর অভিযান চালায়। ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরে সাধারণ জনগণ, ছাত্র, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী – কাউকেই রেহাই দেওয়া হয়নি। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়।
২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়। এই দিন থেকেই শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। সারা দেশজুড়ে গড়ে ওঠে প্রতিরোধ সংগ্রাম, গঠিত হয় মুক্তিবাহিনী।
মুক্তিযুদ্ধের ধারা
মুক্তিযুদ্ধ প্রধানত তিনটি ধাপে বিভক্ত করা যায়:
১. প্রতিরোধ পর্ব (মার্চ - মে):
প্রথম দিকে সাধারণ মানুষ, ছাত্র, যুবকরা নিজেদের অস্ত্র দিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। সেনাবাহিনী, পুলিশ, ইপিআর, আনসার – যারা পাকিস্তানিদের পক্ষে ছিলেন না – তারা বিদ্রোহ করেন। অসংগঠিতভাবে হলেও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে ওঠে।
২. গঠন ও প্রশিক্ষণ পর্ব (জুন - আগস্ট):
ভারতের সহায়তায় সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে প্রশিক্ষণ ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। সেখান থেকে গড়ে ওঠে মুক্তিবাহিনী। গঠন হয় বাংলাদেশ সরকার, যা ১০ এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে গঠিত হয় এবং ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় শপথ নেয় – এটি মুজিবনগর সরকার নামে পরিচিত।
৩. সামরিক বিজয় ও মুক্তির পর্ব (সেপ্টেম্বর - ডিসেম্বর):
এই পর্যায়ে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সেনাবাহিনী যৌথভাবে ‘মুক্তিযোদ্ধা-সমন্বিত বাহিনী’ গঠন করে। ডিসেম্বর মাসে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হলে বাংলাদেশ যুদ্ধ আন্তর্জাতিক রূপ লাভ করে। ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনী ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে আত্মসমর্পণ করে। জন্ম নেয় স্বাধীন বাংলাদেশ।
মুক্তিযুদ্ধে আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
মুক্তিযুদ্ধের সময় বিশ্বরাজনীতিতে নানা প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন ছিল পাকিস্তানের পক্ষে, আর সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল ভারতের ও পরোক্ষভাবে বাংলাদেশের পক্ষে। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের পক্ষে কূটনৈতিক সমর্থন আদায়ে সফল হন।
ভারতের জনগণ ও সরকার প্রায় এক কোটি শরণার্থীর ভার বহন করে এবং মানবিক সহায়তা দেয়। জাতিসংঘে তখনো আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি না মিললেও বিশ্বের বহু দেশের মানুষ এই যুদ্ধকে মানবতার পক্ষে মনে করে সমর্থন জানিয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধে শহিদ ও বীরদের ত্যাগ
মুক্তিযুদ্ধে প্রায় ৩০ লাখ মানুষ শহিদ হন, ২ লাখ নারী নির্যাতনের শিকার হন, ১ কোটি মানুষ শরণার্থী হন ভারতে। অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা প্রাণ দিয়েছেন এই দেশের জন্য। বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য রাষ্ট্র ৭ জনকে ‘বীর শ্রেষ্ঠ’ খেতাব দেয়:
১. মোস্তফা কামাল
২. মতিউর রহমান
৩. মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর
৪. রুহুল আমিন
৫. হামিদুর রহমান
৬. মোহাম্মদ রফিক
৭. মুন্সী আবদুর রউফ
তাদের সাহসিকতা প্রজন্মের পর প্রজন্মকে প্রেরণা জুগিয়ে যাচ্ছে।
বিজয়ের দিন
১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ – এই দিনটি বাংলাদেশের ইতিহাসে চিরস্মরণীয়। এই দিনে পাকিস্তানের লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজি ঢাকায় মিত্রবাহিনীর কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করেন। প্রায় ৯৩,০০০ পাকিস্তানি সৈন্য আত্মসমর্পণ করে। বিশ্বের ইতিহাসে এটি ছিল সবচেয়ে বড় আত্মসমর্পণের ঘটনা।
মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী বাংলাদেশ
স্বাধীনতা অর্জনের পর বাংলাদেশ একটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও জনগণ সম্মিলিতভাবে পুনর্গঠনের কাজ শুরু করে। যদিও পরবর্তী বছরগুলোতে নানা রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সামরিক শাসন দেশকে পেছনে ফেলে, তবুও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বারবার মানুষকে উজ্জীবিত করেছে।
বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের পথে এগিয়ে চলেছে। শিক্ষা, প্রযুক্তি, অর্থনীতি ও সংস্কৃতিতে বাংলাদেশের অগ্রগতি চোখে পড়ার মতো।
মুক্তিযুদ্ধের শিক্ষা ও প্রভাব
মুক্তিযুদ্ধ আমাদের শিখিয়েছে স্বাধীনতা কোনো দয়ার দান নয়; তা অর্জন করতে হয় আত্মত্যাগের মাধ্যমে। আমাদের ভাষা, সংস্কৃতি, জাতিসত্ত্বা রক্ষায় আমরা জীবন দিতে প্রস্তুত – এ বিশ্বাস জাতিকে শক্তি দিয়েছে।
এটি ছিল বাঙালি জাতির জাগরণের যুদ্ধ, একটি ঐক্যবদ্ধ জাতির বিজয়ের ইতিহাস। মুক্তিযুদ্ধ আজ শুধু ইতিহাস নয়, এটি আমাদের আত্মপরিচয়ের ভিত্তি।
উপসংহার
মুক্তিযুদ্ধ শুধু একটি দেশের স্বাধীনতার কাহিনি নয়, এটি একটি জাতির আত্মমর্যাদা অর্জনের মহাকাব্য। এই ইতিহাস আমাদের গর্ব, আমাদের অনুপ্রেরণা। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে এই ইতিহাস জানাতে হবে, বোঝাতে হবে, এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশ গঠনের কাজ চালিয়ে যেতে হবে।
সকল শহিদদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানিয়ে আমরা বলতে পারি—
"তাদের ত্যাগ বৃথা যেতে পারে না, এ দেশ হবে শান্তি, সমতা ও ন্যায়ের দেশ – এটাই আমাদের অঙ্গীকার।"