আমার প্রিয় শিক্ষক
ভূমিকা
জীবনে আমরা অনেক শিক্ষক পেয়ে থাকি, যাঁরা আমাদের পড়ালেখা শেখান, চরিত্র গঠনে সহায়তা করেন এবং জীবনের সঠিক পথ দেখান। কিন্তু তাদের মধ্যে কেউ কেউ আমাদের হৃদয়ে গভীর ছাপ রেখে যান। তাদের শিক্ষা শুধু পাঠ্যবইয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না; তারা হয়ে ওঠেন জীবনের দিকনির্দেশক, ব্যক্তিত্ব গঠনের কারিগর। আমি তেমনই একজন শিক্ষককে পেয়েছি, যিনি শুধু আমার শিক্ষক নন, আমার অনুপ্রেরণার উৎসও বটে। তিনি হলেন জনাব মাহবুবুল আলম স্যার—আমার প্রিয় শিক্ষক।
পরিচয় ও ব্যক্তিগত তথ্য
মাহবুবুল আলম স্যার আমাদের বিদ্যালয়ের একজন অভিজ্ঞ ও প্রাজ্ঞ শিক্ষক। তিনি আমাদের বিদ্যালয়ের বাংলা বিষয়ের শ্রেণিশিক্ষক। তিনি প্রায় ২৫ বছর ধরে শিক্ষকতা পেশায় যুক্ত। তাঁর বাসা আমাদের বিদ্যালয়ের কাছেই। ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে তিনি অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় ও প্রিয় একজন মানুষ। তাঁর মুখে সবসময় একটুকরো হাসি লেগে থাকে, যা আমাদের মুগ্ধ করে।
শিক্ষাগত যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা
স্যার বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। পড়ালেখায় তিনি সবসময়ই মেধাবী ছিলেন। শিক্ষকতা তাঁর নেশা ও পেশা—এই দুই-ই। বাংলা সাহিত্যের প্রায় সব বিষয়েই তাঁর অসাধারণ দখল রয়েছে। কবিতা, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ—সব ক্ষেত্রে তাঁর বিশ্লেষণী দৃষ্টিভঙ্গি চমৎকার।
পাঠদানের দক্ষতা
স্যারের পাঠদানের ধরন এতটাই জীবন্ত ও আকর্ষণীয় যে ক্লাসে আমরা সবাই মনোযোগ সহকারে শুনি। তিনি কঠিন ব্যাকরণ বা সাহিত্য পাঠও সহজ করে উপস্থাপন করেন। উদাহরণ, গল্প, কবিতার আবৃত্তি এবং প্রাসঙ্গিক তথ্যের মাধ্যমে বিষয়গুলো প্রাণবন্ত করে তোলেন।
উদাহরণস্বরূপ, যখন তিনি রবীন্দ্রনাথের "ছুটি" গল্পটি পড়ান, তখন আমাদের মনে সত্যিকারের আবেগ সৃষ্টি হয়। চরিত্রের মনস্তত্ত্ব, সমাজের প্রেক্ষাপট এবং লেখকের বক্তব্য স্যার এত সুন্দরভাবে বিশ্লেষণ করেন যে আমরা শুধু পড়া মুখস্থ না করে তা অনুধাবন করতে পারি।
নৈতিক শিক্ষায় ভূমিকা
স্যার শুধু পাঠ্যপুস্তক শেখান না, শেখান জীবনের পাঠ। তিনি আমাদের সততা, শৃঙ্খলা, দায়িত্ববোধ ও সময়ানুবর্তিতার শিক্ষা দেন। প্রতিদিন ক্লাস শুরুর আগে তিনি আমাদের সঙ্গে ২-৩ মিনিট কথা বলেন নৈতিকতা, সমাজের সমস্যা, সমাধান, ইতিহাস বা সমসাময়িক ঘটনাবলির উপর।
একদিন তিনি আমাদের বলেছিলেন—
"জীবনে শুধু ভালো রেজাল্ট করলে চলবে না; ভালো মানুষ না হতে পারলে সব মূল্যহীন হয়ে যাবে।"
এই কথা এখনো আমার হৃদয়ে গেঁথে আছে।
ব্যক্তিত্ব ও আচরণ
স্যার অত্যন্ত নম্র, শান্ত ও মার্জিত। কোনো ছাত্র যদি ভুল করেও ফেলে, তিনি কখনো রূঢ় ভাষা ব্যবহার করেন না। বরং তিনি ধৈর্য নিয়ে বুঝিয়ে বলেন। স্যারের আচরণ আমাদের কাছে সবসময় একজন অভিভাবকের মতো মনে হয়।
তিনি সব ছাত্রকে সমানভাবে গুরুত্ব দেন—দলিত, সুবিধাবঞ্চিত, মেধাবী কিংবা পিছিয়ে পড়া—সবাই তাঁর কাছে প্রিয়।
সহপাঠ কার্যক্রমে উৎসাহ
স্যার আমাদের শুধু একাডেমিক পড়াশোনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখেন না। তিনি সাহিত্য সভা, বিতর্ক প্রতিযোগিতা, আবৃত্তি, রচনা প্রতিযোগিতা, দেয়াল পত্রিকা প্রকাশ ইত্যাদিতে অংশ নিতে উৎসাহ দেন। তার অনুপ্রেরণায় আমি প্রথম একটি প্রবন্ধ প্রতিযোগিতায় অংশ নিই এবং পুরস্কারও পাই।
তিনি নিজেও একজন ভালো লেখক। তাঁর লেখা প্রবন্ধ ও কবিতা আমরা স্কুল ম্যাগাজিনে পড়েছি। এমনকি তিনি আমাদের স্কুলের বার্ষিক ম্যাগাজিনের সম্পাদকও।
জীবনে তার প্রভাব
স্যারের কাছ থেকে আমি শিখেছি—
- কিভাবে একজন দায়িত্বশীল মানুষ হতে হয়,
- সত্য কথা বলতে কখনো দ্বিধা না করতে,
- নিজের কাজ নিজে করতে,
- মনোযোগ দিয়ে শিখতে ও শোনার গুরুত্ব।
আমি যখন মনমরা হয়ে থাকি, কোনো কারণে হতাশ হই, তখন স্যারের একটি বাক্য আমাকে অনুপ্রাণিত করে—
"যে নিজেকে বিশ্বাস করে, তাকে কেউ থামাতে পারে না।"
এই বাক্য আমার জীবনের প্রেরণাসূত্র হয়ে উঠেছে।
অন্য শিক্ষার্থীদের কাছে তাঁর জনপ্রিয়তা
শুধু আমি নই, আমাদের পুরো স্কুলের শিক্ষার্থীরাই স্যারকে খুব ভালোবাসে। ক্লাসের বাইরে তাঁকে ঘিরে থাকে অনেক ছাত্রছাত্রী, কেউ জিজ্ঞাসা করছে পড়া, কেউ ব্যক্তিগত সমস্যার সমাধান চাইছে। তিনি সবার কথা মনোযোগ দিয়ে শোনেন এবং সাহায্য করার চেষ্টা করেন।
অনেক প্রাক্তন ছাত্রছাত্রী এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে বা চাকরি করে—তারা এখনো স্যারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখে, উৎসব উপলক্ষে তাঁকে শুভেচ্ছা জানায়। এটা প্রমাণ করে স্যার কতটা প্রভাব ফেলেছেন আমাদের জীবনে।
তিনি কেন আমার প্রিয় শিক্ষক
স্যার আমার প্রিয় শিক্ষক কারণ—
- তিনি জ্ঞানী, বিনয়ী ও উদার হৃদয়ের মানুষ;
- তাঁর পাঠদানের ধরণ আকর্ষণীয় ও সহজবোধ্য;
- তিনি চরিত্র গঠনে সহায়ক;
- সব ছাত্রের ভালো চান এবং পাশে থাকেন;
- তার মতো শিক্ষক খুব কমই পাওয়া যায়।
তিনি আমার জীবনের আদর্শ হয়ে উঠেছেন। আমি চাই, ভবিষ্যতে আমি যদি শিক্ষক হই, তাহলে তাঁর মতো একজন হতে পারি।
ভবিষ্যতের প্রত্যাশা ও প্রার্থনা
আমি কামনা করি, স্যার দীর্ঘজীবী হোন এবং ভবিষ্যতে আরও অনেক শিক্ষার্থী তাঁর হাত ধরে আলোকিত হোক। আজকের সমাজে এমন আদর্শ শিক্ষকের খুব প্রয়োজন—যিনি শুধু পুঁথিগত বিদ্যা শেখাবেন না, শেখাবেন মানবতা, দেশপ্রেম, নৈতিকতা ও সহানুভূতি।
উপসংহার
আমার প্রিয় শিক্ষক জনাব মাহবুবুল আলম স্যার একজন আদর্শ, বিবেকবান এবং সমাজ সচেতন মানুষ। তিনি আমাদের শুধু শিক্ষা দেন না, মানুষ হতে সাহায্য করেন। জীবনের বহু বাঁকে আমি তাঁর শিক্ষার আলো খুঁজে পাই।
একজন শিক্ষক যেমন হওয়া উচিত, তিনি তেমনই। তার মতো একজন শিক্ষক পেয়ে আমি ধন্য, কৃতজ্ঞ এবং গর্বিত।