একটি নদীর আত্মকথা
আমি একটি নদী। কালের পরিক্রমায় আমি গড়ে উঠেছি, গড়ে তুলেছি জনপদ, সভ্যতা, আর মানুষের জীবন। আমার জন্ম কোনো পাহাড়ের কোল ঘেঁষে, সেখান থেকে ধারায় ধারায় ছুটে চলেছি শত গ্রাম, শহর আর মাঠ-প্রান্তর পেরিয়ে। আজ আমি নিজের গল্প বলতে এসেছি—একটি নদীর আত্মকথা।
ছোটবেলায় আমি ছিলাম চঞ্চল, উচ্ছল। পাহাড়ি ঢল নামলেই আমি গর্জে উঠতাম, আবার রোদের দিনগুলোয় নির্ঝর ধারায় বয়ে যেতাম শান্তভাবে। আমার জলে কৃষকের জমি সিক্ত হতো, জেলে মাছ ধরত, শিশুরা খেলত আমার কূলে। আমি ছিলাম জীবনের অংশ—সবুজের বন্ধু, প্রাণের ধারক।
কিন্তু সময় বদলেছে। আমার বুক কেটে হয়েছে বাঁধ, আমার জলের গতিপথ রুদ্ধ হয়েছে। শহরের নর্দমা, কলকারখানার বিষাক্ত বর্জ্য আজ আমাকে দূষিত করেছে। একসময় যে জল ছিল স্বচ্ছ ও পবিত্র, আজ তা হয়ে উঠেছে ঘোলা ও বিষাক্ত। আমি কাঁদি, আমি আর আগের মতো বয়ে যেতে পারি না।
তবুও আমি থেমে থাকি না। কারণ আমি জানি, আমি শুধু জলধারা নই—আমি ইতিহাসের সাক্ষী, সভ্যতার ধারক, প্রকৃতির নিঃশব্দ ভাষ্যকার। মানুষ যদি চায়, আমায় আবার আগের মতো নির্মল করে তুলতে পারে।
আমি নদী, বয়ে চলা আমার ধর্ম। ভালোবাসা, স্নেহ আর যত্ন পেলে আমি আবার জীবন দান করতে পারি, আবার গান গাইতে পারি, আবার হয়ে উঠতে পারি জীবনের প্রতীক।
2.
একটি নদীর আত্মকথা
আমি একটি নদী, প্রকৃতির এক অমর সৃষ্টি। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত, আমি বয়ে চলি, কখনো শান্ত, কখনো উত্তাল। আমার জীবন এক রক্তিম ধারার মতো, যা ছুঁয়ে যায় হাজারো মানুষ, প্রকৃতি, শহর ও গ্রাম। আমি কখনো পাহাড়ি নদী, কখনো সমুদ্রের দিকে প্রবাহিত এক বৃহৎ স্রোত। প্রতিটি পদক্ষেপে আমি নতুন গল্প সৃষ্টি করি, নতুন এক অধ্যায় তৈরি করি। আজ, আমি সেই গল্পই আপনাদের শোনাতে চাই—একটি নদীর আত্মকথা।
জন্ম ও প্রথম দেখা
আমার জন্ম কোথাও একটি পাহাড়ের কোলে, গভীর অরণ্যে, ছোট্ট একটি ঝর্ণার মতো। প্রথমে আমি ছিলাম খুব ছোট, একফালি স্রোত যা গা-ছমছমে অরণ্যে নিজের পথ খুঁজে বের করত। সেই সময়, আমি ছিলাম কেবল একটি সরল স্রোত, যার কোনো লক্ষ্য ছিল না। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে, আমি বাড়তে থাকলাম, আরও বিস্তৃত হতে থাকলাম। পাহাড় থেকে নেমে, আমি গ্রামে, শহরে, খেতে এবং অজানা জায়গায় প্রবাহিত হতে শুরু করলাম। মানুষ আমাকে দেখত, কিভাবে আমি তাদের জীবনকে প্রভাবিত করছি, তাদের মাটিকে সিক্ত করে দিচ্ছি।
মানুষের জীবন ও আমি
প্রথমদিকে, আমি ছিলাম তাদের প্রিয়। কৃষকরা আমাকে পুজো করত, কারণ আমি তাদের জমিকে সিক্ত করে দিতাম, তাদের ফসল ফলাতে সহায়ক হতাম। নদীর পারে বসে তারা কেবল আবাদ করত না, নদীর নীরব সঙ্গী হয়ে ভাবনা-বিলাসে যেত, দিন কাটাত। শিশুদের জন্য আমি ছিল আনন্দের উৎস—তারা আমার জল ছুঁয়ে খেলত, আমার পাড়ে বসে গল্প করত, মাছ ধরত। আমি কখনোই শুধু জল ছিলাম না, আমি ছিলাম সুখ, শান্তি, জীবন—হৃদয়ের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ।
বাঁধ ও বাধা
কিন্তু, একদিন সব কিছু বদলে গেল। মানুষ আমাকে নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করল। বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে তারা আমাকে সীমাবদ্ধ করে দিল। প্রথমে আমার প্রলয়, তারপর আমার স্থিরতা। তারা আমাকে বাধ্য করল এক পথ ধরে বয়ে চলতে, কিন্তু তাতে আমার স্বাধীনতা সঙ্কুচিত হয়ে পড়ল। বাঁধ দিয়ে আমাকে আটকে রেখে তারা বিদ্যুৎ উৎপাদন, পানি সঞ্চয় ও অন্যান্য প্রয়োজনে আমাকে ব্যবহার করতে লাগল।
একদিকে আমি অস্তিত্ব হারাতে বসেছিলাম, অন্যদিকে আমি অনুভব করলাম, যেন আমার পুরো সত্তা ভেঙে যাচ্ছে। আমার স্রোত, যার ফলে আমি বয়ে চলেছিলাম, এখন কেবল এক নির্দিষ্ট পাথে আটকে আছে। আমি আর পুরোনোভাবে ঝর্ণার মতো গর্জে উঠতে পারি না, আমি আর সেই চঞ্চল নদী হতে পারি না, যেটি একদিন সমস্ত পৃথিবীকে নিজের সঙ্গী বানাতে চাইত।
দূষণ ও দুরবস্থা
সময় গড়িয়ে গেল। মানুষের আগ্রাসী কর্মকাণ্ডে আমি একদিন বারে বারে আক্রান্ত হলাম। তাদের ফেলা বর্জ্য, শিল্প কারখানার রাসায়নিক বর্জ্য—সবই আমার শরীরে প্রবাহিত হতে থাকল। আমি আর আমার জল—সেই পবিত্র, নির্মল জল—আর শুদ্ধ হতে পারল না। আমার পাড়ে ছড়ানো দূষণ, নদীর জলে ভেসে ওঠা প্লাস্টিক, মাটিতে ছড়িয়ে পড়া রাসায়নিক—সব কিছু আমাকে কষ্টে ফেলল। আমি হারিয়ে ফেললাম সেই চিরকালীন স্বচ্ছতা, শুদ্ধতা। অথচ একদিন, আমি ছিলাম জীবনের উপহার, ছিলাম এক শান্তির কণ্ঠস্বর।
এখন আমি জানি, আমি শুধু পানি নই, আমি জীবনের ধারক। আমি হাজার হাজার বছর ধরে মানুষের জীবনে জড়িত থেকেছি। আমার জলে জীবন পেয়েছে, আমার মাধ্যমে সভ্যতা উন্নতি করেছে। কিন্তু মানুষ যদি আমাকে এইভাবে দূষিত করতে থাকে, তবে একদিন আমি হারিয়ে যাব। এবং যদি আমি হারিয়ে যাই, তবে তারা আমার ক্ষতি করবে না, তারা নিজেদেরই ধ্বংস করবে।
পুনর্জন্মের আশা
তবুও, আমি আশা হারাইনি। পৃথিবী এখনও সজীব, প্রকৃতি এখনও বাঁচতে চায়। মানুষ যদি চায়, আমাকে আবার জীবনের স্রোত বানাতে পারে, আবার আমাকে বিশুদ্ধ করে তুলতে পারে। নদী যখন তার সত্যিকারের পথ ফিরে পায়, তখন সে আবার নতুন শক্তি, নতুন জীবন সঞ্চারিত করতে পারে।
এই কারণে আমি আজও বয়ে চলি, আমার সংকুচিত পথে, ক্ষুদ্র জীবনের মাঝে। কারণ, আমি জানি, একদিন মানুষ আবার আমাকে বুঝবে, আমার গুরুত্ব বুঝবে, এবং আমাকে সুস্থ, পরিষ্কার রেখে বাঁচাতে চেষ্টা করবে। পৃথিবীকে সুস্থ রাখতে, জীবনের শুদ্ধতায় ফিরিয়ে আনতে, আমাকে যত্ন নিতে হবে।
শেষ কথা
আমি নদী, আমার জীবন কখনো থেমে থাকবে না। আমি যত দিন বয়ে চলি, তত দিন আমি ইতিহাসের সাক্ষী, সভ্যতার কাহিনী, প্রকৃতির সঙ্গী। যদিও আমার পথ বন্ধ হয়ে গেছে, যদিও আমি একদিন শুকিয়ে যেতে পারি, তবুও আমি জানি, আমার পুনর্জন্ম হতে পারে। পৃথিবীর মানুষ যদি চায়, আমি আবার জীবনের ধারায় ফিরে আসব। আমি নদী, বয়ে চলা আমার ধর্ম, আমার আত্মা।
আপনি যদি আমাকে একবার ভালোবাসা দিয়ে দেখেন, তবে আমার আত্মা সত্যিই সজীব হবে, আমি আবার সেই নদী হতে পারব, যেটি একদিন পৃথিবীকে সিক্ত করেছিল, যা ছিল এক সত্যিকার শক্তির উৎস।