অসহযোগ আন্দোলন কি ব্যাখ্যা কর

অসহযোগ আন্দোলন কী

ভূমিকা

অসহযোগ আন্দোলন ইতিহাসে একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে বিবেচিত। এটি এমন এক আন্দোলন যার মাধ্যমে জনগণ শান্তিপূর্ণভাবে কোনো শাসক, প্রতিষ্ঠান বা শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিরোধ প্রকাশ করে এবং সক্রিয় সহযোগিতা প্রত্যাহার করে নেয়। অহিংস, সংগঠিত ও ব্যাপক জনগণভিত্তিক এই আন্দোলন বহু দেশে গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার ও স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রেখেছে। ভারত ও বাংলাদেশে এই আন্দোলনের ভূমিকা ছিল অসাধারণ এবং ইতিহাস পরিবর্তনের ক্ষেত্রে এর গুরুত্ব অনস্বীকার্য।

অসহযোগ আন্দোলনের সংজ্ঞা

‘অসহযোগ’ শব্দটি মূলত দুটি অংশে বিভক্ত—“অ” অর্থাৎ “না” এবং “সহযোগ” অর্থাৎ “সহযোগিতা”। অর্থাৎ, অসহযোগ অর্থ হচ্ছে—“সহযোগিতা না করা”। একে ইংরেজিতে বলা হয় Non-Cooperation Movement।


অসহযোগ আন্দোলনের মূল ভাবনা হলো:

যে শাসনব্যবস্থা বা প্রশাসন অন্যায়, নিপীড়নমূলক বা অবৈধ, তার প্রতি জনগণ তাদের সমস্ত ধরনের সহযোগিতা প্রত্যাহার করে নেবে। এর মধ্যে রয়েছে—কর না দেওয়া, সরকারি অফিসে কর্মবিরতি, বিদেশি পণ্য বর্জন, সরকারি শিক্ষা-চাকরি ত্যাগ, সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ, ধর্মঘট, বিক্ষোভ, সভা-সমাবেশ ইত্যাদি।

অসহযোগ আন্দোলনের ইতিহাস ও উৎপত্তি

অসহযোগ আন্দোলনের ইতিহাস প্রাচীন হলেও আধুনিক রাজনীতিতে এটি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে ২০শ শতকে। এর প্রবক্তা হিসেবে সর্বাধিক পরিচিত নাম মহাত্মা গান্ধী। তিনি দক্ষিণ আফ্রিকায় ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে প্রথম অসহযোগ কৌশল প্রয়োগ করেন। পরে ভারতবর্ষে তিনি এটিকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দেন।

▶ ভারতবর্ষে অসহযোগ আন্দোলন (১৯২০-১৯২২)

১৯১৯ সালের রাওলাট আইন এবং জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে গান্ধীজী অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। এই আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে তাকে অচল করে দেওয়া।

আন্দোলনের প্রধান কর্মসূচি ছিল:

  • সরকারি চাকরি, আদালত ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বর্জন
  • বিদেশি পণ্য বর্জন ও স্বদেশি পণ্যের ব্যবহার
  • কর না দেওয়া ও আইন অমান্য
  • খদ্দর পরা, চরকা ব্যবহার

▶ বাংলাদেশে অসহযোগ আন্দোলন (১৯৭১)

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল ১৯৭১ সালের অসহযোগ আন্দোলন। এটি ছিল পাকিস্তানি শাসনের বিরুদ্ধে এক সর্বাত্মক গণ-প্রতিরোধ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে পরিচালিত এই আন্দোলনের মাধ্যমে পূর্ববাংলার জনগণ পশ্চিম পাকিস্তানের শাসনকে অস্বীকৃতি জানায় এবং একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অগ্রসর হয়।

আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো ছিল:

  • কর প্রদান ও সরকারি আদেশ মানা থেকে বিরত থাকা
  • শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও আইন-শৃঙ্খলা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বেসরকারি কাঠামো গঠন
  • বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে দেশ পরিচালনা
  • স্বাধীন পতাকা উত্তোলন
  • পশ্চিম পাকিস্তানি প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক বর্জন

অসহযোগ আন্দোলনের উদ্দেশ্য

অসহযোগ আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য সাধারণত ৩টি প্রধান দিক নিয়ে গঠিত হয়:

১. নিপীড়নমূলক শাসনের বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ গড়ে তোলা

২. আত্মনির্ভরশীলতা ও জনগণের শক্তির অভিব্যক্তি ঘটানো

৩. শাসকগোষ্ঠীকে চাপ প্রয়োগ করে ন্যায্য দাবি আদায় বা শাসন পরিবর্তনে বাধ্য করা

এটি একটি অহিংস উপায়, যার মাধ্যমে মানুষ গণতান্ত্রিক ও মানবিক দাবি নিয়ে শাসকের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়।

অসহযোগ আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য

১. অহিংসতা – এই আন্দোলন মূলত শান্তিপূর্ণ পদ্ধতিতে পরিচালিত হয়। কোনোরূপ অস্ত্র বা সহিংসতা এর অংশ নয়।

  • বৃহৎ জনসম্পৃক্ততা – এটি সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণে পরিচালিত হয়। সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ এতে যুক্ত হতে পারে।
  • নৈতিক চাপ সৃষ্টি – শাসকের ওপর একটি শক্তিশালী নৈতিক ও রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি করা হয়।
  • প্রশাসনিক অচলাবস্থা – প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক কাঠামো ভেঙে পড়ার মাধ্যমে শাসনক্ষমতাকে দুর্বল করা হয়।
  • বিকল্প কাঠামো গঠন – অনেক সময় জনগণ নিজেরাই বিকল্প প্রশাসনিক ও সামাজিক ব্যবস্থা তৈরি করে।

অসহযোগ আন্দোলনের উপকারিতা

✅ গণচেতনার উন্মেষ – মানুষ নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয় এবং রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় হয়ে ওঠে।

✅ শাসনব্যবস্থার দুর্বলতা প্রকাশ – প্রশাসনের ওপর জনগণের নির্ভরতা কমে, ফলে শাসকগোষ্ঠীর কর্তৃত্ব দুর্বল হয়।

✅ আত্মনির্ভরশীলতা বৃদ্ধি – স্বদেশি পণ্য, স্থানীয় নেতৃত্ব ও উদ্যোগের বিকাশ ঘটে।

✅ শান্তিপূর্ণ প্রতিরোধ – রক্তপাত ছাড়াই শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তনের পথ তৈরি হয়।

✅ জনগণের একতা – ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে একটি অভিন্ন জাতীয় ঐক্য সৃষ্টি হয়।

অসহযোগ আন্দোলনের চ্যালেঞ্জ

❌ দমন-পীড়নের আশঙ্কা – কর্তৃত্ববাদী শাসকরা আন্দোলন দমন করতে সহিংস পন্থা গ্রহণ করতে পারে।

❌ অর্থনৈতিক ক্ষতি – উৎপাদন, ব্যবসা, পরিবহন ইত্যাদির স্থবিরতা দেখা দিতে পারে।

❌ দীর্ঘমেয়াদী আন্দোলনে ক্লান্তি – দীর্ঘ সময় আন্দোলন চালানো কঠিন হয়ে পড়ে।

❌ সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা – শান্তিপূর্ণ আন্দোলন মাঝেমধ্যে সহিংসতায় রূপ নিতে পারে, যদি তা নিয়ন্ত্রিত না থাকে।

অসহযোগ আন্দোলনের ঐতিহাসিক গুরুত্ব

১. ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন – গান্ধীজীর অসহযোগ আন্দোলন ভারতকে ব্রিটিশবিরোধী বৃহত্তর সংগ্রামের পথে নিয়ে যায়।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা – ১৯৭১ সালের অসহযোগ আন্দোলন স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মের বীজ বপন করে।

বিশ্ব রাজনীতিতে প্রভাব – দক্ষিণ আফ্রিকা, আমেরিকা, বার্মা, ইরান, হংকংসহ বিভিন্ন দেশে অসহযোগ পদ্ধতি অনুসরণ করে সফল গণআন্দোলন হয়েছে।

উপসংহার

অসহযোগ আন্দোলন একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক কৌশল যা অহিংস উপায়ে অন্যায় শাসনের বিরুদ্ধে জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে। এটি কেবল কোনো নির্দিষ্ট সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন নয়, বরং একটি বৃহৎ সামাজিক ও নৈতিক পরিবর্তনের বার্তা বহন করে। ইতিহাসে অসহযোগ আন্দোলন বারবার প্রমাণ করেছে—অস্ত্র নয়, জনগণের ঐক্য ও সচেতনতা সবচেয়ে বড় শক্তি। যেখানে শাসকের অমানবিকতা ও অন্যায় শুরু হয়, সেখানেই অসহযোগ আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা জন্ম নেয়।

Post a Comment