অসহযোগ আন্দোলন কি

অসহযোগ আন্দোলন ছিল ব্রিটিশবিরোধী ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এটি মূলত ১৯২০ সালে মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে শুরু হয়েছিল এবং ব্রিটিশ সরকারের প্রতি ভারতের জনগণের অসহযোগিতা বা স্বতঃস্ফূর্ত বর্জনের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্য ছিল। এই আন্দোলন ভারতীয় উপমহাদেশে স্বাধীনতা আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড় ঘুরিয়ে দেয়।

নিচে অসহযোগ আন্দোলনের বিস্তারিত আলোচনা করা হলো:

🔶 অসহযোগ আন্দোলনের পটভূমি:

১. রাওলাট আইন (Rowlatt Act), ১৯১৯:

এই আইন অনুসারে কোনো ব্যক্তিকে বিচার ছাড়াই গ্রেপ্তার ও আটক রাখা যেত। ভারতীয় জনগণের মধ্যে এই আইন প্রবল ক্ষোভের সৃষ্টি করে।

২. জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড (১৩ এপ্রিল ১৯১৯):

ব্রিটিশ ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডায়ারের নেতৃত্বে পাঞ্জাবের অমৃতসরে নিরস্ত্র ভারতীয়দের ওপর গুলি চালানো হয়, যাতে শত শত মানুষ প্রাণ হারায়। এই ঘটনাটি ভারতীয়দের মনে তীব্র ক্ষোভের জন্ম দেয়।

৩. খিলাফত আন্দোলন:

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর খিলাফতের বিলুপ্তি মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করে। গান্ধীজী হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের স্বার্থে খিলাফত আন্দোলনের সাথে অসহযোগ আন্দোলনকে একত্রিত করেন।

🔶 আন্দোলনের প্রধান লক্ষ্য:

  • ব্রিটিশ সরকারের প্রতি সহযোগিতা বন্ধ করা।
  • ভারতীয়দের রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ব্রিটিশ প্রভাব বর্জন।
  • আত্মনির্ভরশীলতা এবং স্বদেশী আন্দোলনের প্রসার।

🔶 অসহযোগ আন্দোলনের মূল কর্মসূচি:

১. সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও আদালত বর্জন

২. সরকারি চাকরি ও সম্মাননা বর্জন

৩. বিদেশি পোশাক, জিনিসপত্র ও ব্রিটিশ পণ্য বর্জন

৪. স্বদেশি শিল্পের প্রচলন ও চাষ

৫. হিংসাহীন প্রতিবাদ ও সত্যাগ্রহ (Satyagraha)

৬. বিদেশি শিক্ষা ও আইনব্যবস্থার প্রতি অনাস্থা প্রকাশ

৭. জাতীয় বিদ্যালয়, কলেজ ও প্রতিষ্ঠান স্থাপন

৮. চরকা ও খদ্দর ব্যবহারের প্রসার

🔶 অসহযোগ আন্দোলনের প্রভাব:

✅ সাধারণ জনগণের ব্যাপক অংশগ্রহণ।

✅ হিন্দু-মুসলিম ঐক্য বৃদ্ধি পায়।

✅ ব্রিটিশ শাসনের প্রতি জনগণের শ্রদ্ধাবোধ হ্রাস পায়।

✅ স্বদেশী শিল্প ও জাতীয় শিক্ষা বিস্তৃত হয়।

✅ গান্ধীজীর জনপ্রিয়তা সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে যায়।

✅ ব্রিটিশ সরকারের দমননীতির পরিপ্রেক্ষিতে ভারতীয়দের রাজনৈতিক চেতনা আরও জোরদার হয়।

🔶 আন্দোলনের পরিসমাপ্তি:

১৯২২ সালে চৌরিচৌরা কাণ্ডে (উত্তরপ্রদেশে) আন্দোলনকারীরা একটি পুলিশ স্টেশনে আগুন ধরিয়ে দিলে ২২ জন পুলিশ নিহত হন। হিংসার এই ঘটনা গান্ধীজীকে গভীরভাবে বিচলিত করে তোলে, কারণ তিনি আন্দোলনকে সম্পূর্ণ অহিংস রাখার পক্ষপাতী ছিলেন। ফলে তিনি ১৯২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে আন্দোলন প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন।

🔶 অসহযোগ আন্দোলনের গুরুত্ব:

  • এটি ছিল ভারতীয় জনগণের প্রথম বৃহৎ ও সংগঠিত গণআন্দোলন।
  • সাধারণ মানুষ প্রথমবারের মতো রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে।
  • অহিংস আন্দোলনের দর্শনের বাস্তব প্রয়োগ ঘটে।
  • স্বাধীনতা আন্দোলনের ভিত্তিপ্রস্তর মজবুত হয়।
  • পরে সিভিল নিস্বার্থতা ও কংগ্রেসের আরও বৃহৎ আন্দোলনের ভিত্তি গড়ে ওঠে।

🔶 উপসংহার:

অসহযোগ আন্দোলন ভারতের জাতীয় আন্দোলনের ইতিহাসে এক ঐতিহাসিক অধ্যায়। এটি শুধু রাজনৈতিক সংগ্রাম নয়, সামাজিক ও অর্থনৈতিক জাগরণও বয়ে এনেছিল। যদিও এটি স্বল্প সময়েই স্থগিত হয়, তবে এটি পরবর্তীকালে স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুপ্রেরণা হয়ে ওঠে।

Post a Comment