রাজা রামমোহন রায়: বাংলার নবজাগরণের অগ্রদূত
ভূমিকা
রাজা রামমোহন রায় ছিলেন বাংলা তথা ভারতবর্ষের নবজাগরণ যুগের একজন মহান পুরুষ। তিনি ছিলেন সমাজসংস্কারক, শিক্ষাবিদ, ধর্মতাত্ত্বিক এবং রাজনৈতিক চিন্তাবিদ। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে যখন ভারত অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার ও সামাজিক কূপমণ্ডূকতায় আচ্ছন্ন ছিল, তখন রামমোহন জ্ঞান, যুক্তি ও মানবতাবাদকে সামনে এনে আধুনিক ভারতের ভিত্তি স্থাপন করেন। তিনি নারী-শিক্ষা, সতীদাহ প্রথা-নিষিদ্ধকরণ, ব্রাহ্ম ধর্ম প্রতিষ্ঠা, সংবাদপত্র প্রচলন, ইংরেজি শিক্ষার প্রসারসহ নানা ক্ষেত্রে পথপ্রদর্শক ভূমিকা পালন করেন।
জন্ম ও শৈশব
রামমোহন রায় ১৭৭২ সালের ২২ মে বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার রাধানগর গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা রামকান্ত রায় ছিলেন একজন ধর্মপরায়ণ ও ধনী জমিদার। মাতার নাম তারিণী দেবী। শৈশবে রামমোহন তৎকালীন প্রথানুযায়ী সংস্কৃত শিক্ষা গ্রহণ করেন এবং পরবর্তীতে ফারসি ও আরবি ভাষায় দক্ষতা অর্জন করেন। কাশীতে গিয়ে তিনি হিন্দু দর্শনের গভীরে প্রবেশ করেন এবং পরে পাটনায় ফারসি-আরবি শিখে ইসলাম ধর্ম ও গ্রিক দর্শনের সঙ্গে পরিচিত হন। এই বহুভাষা ও বহুদর্শনের জ্ঞানই তাঁকে যুক্তিবাদী ও সর্বধর্মসমন্বয়বাদী দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণে সহায়তা করে।
ধর্মচিন্তা ও আত্মিক অভিযাত্রা
রামমোহনের ধর্মচিন্তা ছিল অদ্বৈতবাদী ও যুক্তিনির্ভর। তিনি পল্লিবাসীদের কুসংস্কারাচ্ছন্ন পৌরাণিক দেবতা উপাসনার বিরোধিতা করে ‘একেশ্বরবাদ’ প্রচার করেন। তিনি মনে করতেন, ঈশ্বর এক ও সর্বশক্তিমান এবং মানুষের মধ্যে বিবেকবোধ আছে বলেই সে ঈশ্বরের সৃষ্ট শ্রেষ্ঠ জীব। তিনি ১৮০৯ সালে রচনা করেন Tuhfat-ul-Muwahhiddin (একেশ্বরবাদের উপহার) এবং পরে ১৮১৫-তে আত্মীয় ও বন্ধুদের নিয়ে গঠন করেন আত্মীয় সভা। এখান থেকেই তাঁর ধর্মীয় ও সামাজিক সংস্কার আন্দোলনের সূচনা হয়।
১৮২৮ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ব্রাহ্ম সমাজ, যার মাধ্যমে তিনি হিন্দুধর্মের পুনর্জাগরণ, একেশ্বরবাদ ও সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ শুরু করেন। ব্রাহ্ম সমাজ ছিল হিন্দুধর্মের ভিতরে থেকে সংস্কার-আন্দোলনের প্রথম সংগঠিত প্রয়াস।
সামাজিক সংস্কারক হিসেবে রামমোহন
রামমোহনের সমাজ সংস্কারমূলক কর্মকাণ্ড তাঁকে বিশেষভাবে স্মরণীয় করে তুলেছে। তিনি সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রচলিত নানা কুসংস্কার ও অমানবিক প্রথার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য সামাজিক সংস্কার কাজগুলো হলো:
১. সতীদাহ প্রথা রোধ:
এটি ছিল তাঁর জীবনের অন্যতম প্রধান সংগ্রাম। হিন্দু সমাজে বিধবা স্ত্রীকে স্বামীর চিতায় আত্মবিসর্জনের যে নিষ্ঠুর প্রথা প্রচলিত ছিল, তা বন্ধ করতে রামমোহন সাহসী ভূমিকা গ্রহণ করেন। দীর্ঘ আন্দোলনের পর ১৮২৯ সালে গভর্নর জেনারেল লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক সতীদাহ প্রথা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন, এবং এতে রামমোহনের ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য।
২. নারী-শিক্ষার প্রচার:
রামমোহন নারীশিক্ষার প্রবক্তা ছিলেন। তিনি মনে করতেন, সমাজের উন্নয়নের জন্য নারী-পুরুষের সমান অংশগ্রহণ দরকার। তিনি বিধবাবিবাহকে সমর্থন করেন এবং বহুবিবাহের বিরোধিতা করেন।
৩. বর্ণপ্রথা ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে অবস্থান:
তিনি জন্মভিত্তিক জাতিভেদের বিরোধিতা করেন। তাঁর মতে, মনুষ্যত্বই আসল পরিচয়, জাতি নয়। তিনি হিন্দু ধর্মের নামে প্রচলিত অনেক প্রথাকে যুক্তিহীন ও অমানবিক বলে প্রত্যাখ্যান করেন।
শিক্ষা প্রসারে অবদান
রামমোহন ছিলেন আধুনিক শিক্ষার প্রবক্তা। তিনি বুঝেছিলেন, ভারতীয় সমাজের পুনর্গঠন করতে হলে ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে পাশ্চাত্য বিজ্ঞান ও দর্শনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে। তিনি ১৮১৭ সালে ডেভিড হেয়ারের সঙ্গে যৌথভাবে কলকাতা হিন্দু কলেজ (বর্তমানে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়) প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করেন।
১৮২৫ সালে তিনি নিজ উদ্যোগে স্থাপন করেন Vedanta College, যেখানে পাশ্চাত্য দর্শন ও প্রাচ্য জ্ঞান পাশাপাশি শেখানো হতো। তিনি বিশ্বাস করতেন, এভাবে শিক্ষিত প্রজন্ম তৈরি হলে জাতি উন্নতির দিকে এগোবে।
সংবাদপত্র ও গণমাধ্যমে ভূমিকা
রামমোহন সংবাদপত্রকে গণচেতনার জাগরণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন। তিনি বাংলায় সমবাদ কৌমুদী এবং ফারসিতে মিরাত-উল-আখবার নামক পত্রিকা প্রকাশ করেন। তাঁর পত্রিকাগুলো সমাজ-সংস্কার, শিক্ষা, ধর্মীয় সহিষ্ণুতা ও প্রশাসনিক স্বচ্ছতার পক্ষে জোরালো কণ্ঠস্বর ছিল।
এজন্য তৎকালীন ইংরেজ শাসকরা তাকে সন্দেহের চোখে দেখত। ১৮২৩ সালে সংবাদপত্রের ওপর সেন্সর নীতির বিরোধিতা করে তিনি প্রতিবাদ জানান।
রাজনৈতিক চিন্তা ও প্রশাসনিক সংস্কার
রামমোহন রায় ব্রিটিশ শাসনের অন্ধ সমর্থক ছিলেন না, বরং একজন চিন্তাশীল সংস্কারক হিসেবে প্রশাসনিক স্বচ্ছতা, ভারতীয়দের অধিক অধিকার এবং স্থানীয় স্বশাসনের পক্ষপাতী ছিলেন। তিনি প্রশাসনিক দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলেন এবং বিচার বিভাগের সংস্কার ও ন্যায়বিচারের পক্ষে আওয়াজ তোলেন।
তিনি দাবি করেছিলেন, ইংরেজি ভাষার শিক্ষা জনগণের উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য। সেই সঙ্গে তিনি কৃষকদের উপর অমানবিক কর প্রয়োগের বিরোধিতা করেছিলেন। তিনি মনে করতেন, অর্থনৈতিক শোষণ বন্ধ না হলে সমাজের উন্নয়ন সম্ভব নয়।
ইংল্যান্ড যাত্রা ও আন্তর্জাতিক পরিচিতি
রামমোহন রায় ১৮৩০ সালে ইংল্যান্ড যান আকবর-দ্বিতীয়ের তরফ থেকে তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে, নবাবকে "রাজা" উপাধি দেওয়ার জন্য ইংরেজ সরকারকে অনুরোধ করতে। সেখানে গিয়েও তিনি ভারতের সংস্কৃতি, অধিকার এবং ধর্মীয় সহিষ্ণুতার পক্ষে বক্তব্য রাখেন।
তাঁর যুক্তিবাদী চিন্তা ও সাহিত্যচর্চা ইউরোপীয় বুদ্ধিজীবীদের মনোযোগ আকর্ষণ করে। তিনি ইংল্যান্ডে ব্রাহ্ম ধর্ম, সতীদাহ বিলুপ্তি, শিক্ষা ও নারী-অধিকার ইত্যাদি বিষয়ে বক্তৃতা দেন এবং পাশ্চাত্যের কাছে ভারতীয় সংস্কৃতির গৌরবময় দিক তুলে ধরেন।
মৃত্যু
রামমোহন রায় ১৮৩৩ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর ইংল্যান্ডের ব্রিস্টলে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁকে ব্রিস্টলের আরনস ভেল কবরস্থানে সমাধিস্থ করা হয়। ভারতে ফিরে আসার ইচ্ছা পূর্ণ হলো না, কিন্তু তাঁর চিন্তা ও আদর্শ আজও ভারতীয় সমাজে প্রজ্বলিত।
উপসংহার
রাজা রামমোহন রায় শুধু এক জন ব্যক্তি নন, তিনি এক আন্দোলন, এক যুগের প্রতিনিধি। তিনি আধুনিক ভারতের পথপ্রদর্শক, যিনি ধর্মীয় সহিষ্ণুতা, নারী-অধিকার, শিক্ষা, মানবতা এবং যুক্তির আলোয় সমাজকে আলোকিত করেছিলেন। তাঁর জীবন ও কর্ম ভারতীয় সমাজে মুক্তচিন্তার এক অমর উদাহরণ। আজ যখন সমাজে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা, নারীর প্রতি বৈষম্য এবং কুসংস্কার দেখা যায়, তখন রামমোহনের চিন্তাধারাই আমাদের ভবিষ্যতের পথ দেখাতে পারে।
তিনি প্রমাণ করেছিলেন, সামাজিক পরিবর্তন কেবল কথায় নয়—কর্মে, সংগ্রামে এবং মানবতার প্রতি অটুট বিশ্বাসে সম্ভব। তাই তিনি আজও প্রাসঙ্গিক, যুগান্তকারী এবং অনুপ্রেরণার উৎস।
শেষকথা
রাজা রামমোহন রায় বাংলার আকাশে এক দীপ্তিমান নক্ষত্র, যাঁর আলো আজও নিভে যায়নি। তাঁর চিন্তা ও আদর্শ কালের সীমা ছাড়িয়ে আজও আমাদের ভাবায়, প্রেরণা জোগায়। তিনি ছিলেন ভারতীয় নবজাগরণের অন্যতম প্রধান নির্মাতা, এবং আধুনিক ভারতের আত্মার রূপকার।