রোহিঙ্গা সংকট
ভূমিকা
বিশ্বের অন্যতম মানবিক সংকটগুলোর একটি হলো রোহিঙ্গা সংকট। এটি শুধু একটি জাতিগোষ্ঠীর ওপর নিপীড়নের গল্প নয়, বরং একটি রাষ্ট্রবিহীন জনগোষ্ঠীর শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চলমান বঞ্চনা, নির্যাতন এবং অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই। রোহিঙ্গারা মূলত মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মুসলিম জনগোষ্ঠী। তারা সেই দেশের নাগরিক হিসেবে পরিচিত না হলেও শত শত বছর ধরে সেখানে বাস করে আসছে। কিন্তু রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি, মানবাধিকার, ও নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত এই জনগোষ্ঠী বারবার সহিংসতা, নিপীড়ন এবং গণহত্যার শিকার হয়েছে। এর ফলে লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে, যার ফলে বাংলাদেশ একটি গুরুতর মানবিক ও কূটনৈতিক সংকটের সম্মুখীন হয়েছে।
রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর পরিচয় ও ইতিহাস
রোহিঙ্গারা একটি জাতিগত সংখ্যালঘু মুসলিম জনগোষ্ঠী যারা মূলত মিয়ানমারের পশ্চিমাঞ্চলের রাখাইন রাজ্যে বাস করে। ইতিহাস অনুযায়ী, রোহিঙ্গাদের পূর্বপুরুষরা কয়েক শতাব্দী ধরে রাখাইনে বসবাস করছে। তারা আরাকান রাজ্যের অধীনে ছিল, যা এক সময় একটি স্বাধীন অঞ্চল ছিল। পরবর্তীতে ব্রিটিশরা বার্মা (বর্তমান মিয়ানমার) দখল করলে আরাকানও ব্রিটিশ শাসনের আওতায় আসে। ব্রিটিশ আমলে ভারতের বাংলা, বিহার, ও ওড়িশা অঞ্চল থেকে মুসলিম কৃষক ও শ্রমিকদের রাখাইনে নিয়ে যাওয়া হয়। এতে স্থানীয় বৌদ্ধ রাখাইনদের সঙ্গে মুসলিমদের দ্বন্দ্ব শুরু হয়।
১৯৪৮ সালে ব্রিটিশদের কাছ থেকে বার্মা স্বাধীনতা লাভ করলে নতুন বার্মিজ সরকার রোহিঙ্গাদের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি না দিয়ে "বিদেশি" ঘোষণা করে। এরপর থেকে শুরু হয় রোহিঙ্গাদের আইনি, সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকার হরণের এক দীর্ঘ প্রক্রিয়া। সবচেয়ে ভয়াবহভাবে ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইন রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়। এই আইন অনুসারে রোহিঙ্গারা "জাতিগত জনগোষ্ঠী" হিসেবে স্বীকৃত নয়।
রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের চিত্র
রোহিঙ্গাদের প্রতি সহিংসতা নতুন নয়। ১৯৭৮ সালে “নাগরিক যাচাই অভিযান” চালানোর নামে লক্ষাধিক রোহিঙ্গা মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। পরবর্তী বছরগুলোতে ১৯৯১-৯২, ২০১২ ও সবচেয়ে ভয়াবহভাবে ২০১৭ সালে সামরিক অভিযান চালিয়ে রোহিঙ্গাদের হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ ও গৃহচ্যুত করা হয়।
২০১৭ সালের আগস্ট মাসে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী "ক্লিয়ারেন্স অপারেশন" এর নামে এক ভয়াবহ জাতিগত নিধন অভিযান চালায়। এই অভিযানে হাজার হাজার রোহিঙ্গা নিহত হয়, নারীদের গণধর্ষণ করা হয় এবং শত শত গ্রাম পুড়িয়ে ধ্বংস করে দেওয়া হয়। জাতিসংঘ এই ঘটনাকে "জাতিগত নির্মূল অভিযান" (Ethnic Cleansing) এবং পরবর্তীতে "গণহত্যা" (Genocide) হিসেবে আখ্যা দেয়।
বাংলাদেশে রোহিঙ্গা আগমন
২০১৭ সালের আগস্টের পরবর্তী কয়েক মাসে প্রায় ৭ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে, যা পূর্বের বিভিন্ন দফার আগতদের সঙ্গে মিলে মোট সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ১২ লাখ। কক্সবাজার জেলার উখিয়া ও টেকনাফে তাদের জন্য অস্থায়ী আশ্রয় শিবির তৈরি করা হয়। এখন এটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থী শিবির।
বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গাদের মানবিক বিবেচনায় আশ্রয় দেয়, তাদের খাদ্য, চিকিৎসা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার চেষ্টা করে। জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা (UNHCR), আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (IOM), বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (WFP) সহ নানা আন্তর্জাতিক সংস্থা এই সংকটে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ায়।
রোহিঙ্গা সংকটে বাংলাদেশের অবস্থান ও ভূমিকা
বাংলাদেশ একটি শান্তিপ্রিয় ও মানবিক দেশ হিসেবে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে বিশ্ববাসীর প্রশংসা অর্জন করেছে। তবে এত বিপুলসংখ্যক শরণার্থীকে দীর্ঘ সময় ধরে আশ্রয় দেওয়ার ফলে দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও পরিবেশগত চাপও বেড়েছে।
বাংলাদেশের গৃহীত পদক্ষেপসমূহঃ
- কক্সবাজারে শতাধিক শিবির স্থাপন
- মানবিক সহায়তা ও চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা
- বায়োমেট্রিক রেজিস্ট্রেশন
- রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তরের উদ্যোগ
- আন্তর্জাতিক মহলের সহানুভূতি আদায়ের প্রচেষ্টা
- জাতিসংঘ ও ওআইসি-র মাধ্যমে কূটনৈতিক চাপ প্রয়োগ
বাংলাদেশ বারবার বলেছে যে, রোহিঙ্গারা যেন নিরাপদ, মর্যাদাপূর্ণ ও টেকসই উপায়ে মিয়ানমারে ফিরে যেতে পারে, সেটাই চূড়ান্ত লক্ষ্য। কিন্তু মিয়ানমারের অসহযোগিতা এবং আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক জটিলতা এই প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত করেছে।
রোহিঙ্গা সংকটের বহুমাত্রিক প্রভাব
১. সামাজিক প্রভাব:
রোহিঙ্গাদের দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশে অবস্থান দেশের স্থানীয় জনগণের জীবনে ব্যাপক প্রভাব ফেলছে। জনসংখ্যার চাপ, মাদক, চোরাচালান, অস্ত্র ব্যবসা, নারী ও শিশু পাচারের মতো অপরাধ বেড়েছে। স্থানীয়দের মধ্যে কর্মসংস্থানের সুযোগ কমে গেছে।
২. অর্থনৈতিক প্রভাব:
প্রতিদিন রোহিঙ্গাদের খাদ্য, চিকিৎসা, নিরাপত্তা ইত্যাদি বাবদ প্রচুর অর্থ ব্যয় হচ্ছে। যদিও কিছু আন্তর্জাতিক সাহায্য আসছে, তবে তা প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট নয়। পর্যটন নগরী কক্সবাজারেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
৩. পরিবেশগত প্রভাব:
রোহিঙ্গা শিবির গঠনের জন্য কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়ার পাহাড় কেটে বন উজাড় করা হয়েছে। এর ফলে জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়েছে, বন্য হাতির চলাচলের পথ বন্ধ হয়েছে।
৪. নিরাপত্তা হুমকি:
রোহিঙ্গাদের মধ্যে জঙ্গি সংগঠনের প্রভাব, অস্ত্র ব্যবসা, ক্যাম্পে সংঘর্ষ – এসব ঘটনায় দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উদ্বেগজনক হয়ে উঠছে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও উদ্যোগ
জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, আমেরিকা ও অন্যান্য দেশ রোহিঙ্গা সংকটে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে এবং মিয়ানমারের ওপর বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। ২০২0 সালে গাম্বিয়া আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (ICJ) মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ দায়ের করে। আদালত মিয়ানমারকে কিছু অন্তর্বর্তীকালীন নির্দেশনা দেয়, তবে এখনো স্থায়ী রায় হয়নি।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় মিয়ানমারের সেনাবাহিনীকে দায়ী করলেও বাস্তবে চাপ প্রয়োগ বা কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। চীন, রাশিয়া ও ভারতের ভূরাজনৈতিক স্বার্থের কারণে রোহিঙ্গা সংকটে আন্তর্জাতিক ঐক্যও দুর্বল।
সম্ভাব্য সমাধান ও করণীয়
১. রাজনৈতিক সমাধান:
রোহিঙ্গা সংকটের মূল উৎস মিয়ানমারের অভ্যন্তরীন সমস্যা। তাই সেখানে রাজনৈতিক সমাধান, গণতন্ত্রের পুনরুদ্ধার এবং নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠা অপরিহার্য।
২. আন্তর্জাতিক চাপ বৃদ্ধি:
জাতিসংঘ, ওআইসি, সার্ক, আসিয়ানসহ বিভিন্ন আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সংস্থার মাধ্যমে মিয়ানমারের ওপর কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক চাপ বৃদ্ধি করতে হবে।
স্বেচ্ছা ও নিরাপদ প্রত্যাবাসন:
রোহিঙ্গারা যেন ইচ্ছাকৃতভাবে এবং নিরাপদভাবে নিজ দেশে ফিরে যেতে পারে, তার জন্য আন্তর্জাতিক পর্যায়ে একটি নির্ভরযোগ্য পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।
৪. আন্তর্জাতিক অপরাধ বিচার:
গণহত্যা, ধর্ষণ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে বিচার নিশ্চিত করতে হবে।
৫. অস্থায়ী ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন:
রোহিঙ্গাদের মধ্যে শিক্ষা, দক্ষতা ও সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে যাতে তারা সমাজবিরোধী কার্যক্রমে জড়িত না হয়।
৬. বাংলাদেশে দীর্ঘমেয়াদি চাপ লাঘব:
বিশ্ব সম্প্রদায়কে বাংলাদেশের বোঝা হালকা করার জন্য আর্থিক সহায়তা এবং রোহিঙ্গা পুনর্বাসনে কার্যকর ভূমিকা নিতে হবে।
উপসংহার
রোহিঙ্গা সংকট একটি আন্তর্জাতিক মানবিক ও ন্যায়বিচারের পরীক্ষা। একটি নির্যাতিত জাতিগোষ্ঠী তাদের অধিকার, মর্যাদা ও অস্তিত্ব রক্ষার জন্য লড়ছে, আর একটি মানবিক রাষ্ট্র বাংলাদেশ তাদের আশ্রয় দিয়ে উদাহরণ স্থাপন করেছে। কিন্তু এই সংকটের স্থায়ী সমাধান তখনই সম্ভব, যখন মিয়ানমার তাদের নাগরিক অধিকার ফিরিয়ে দেবে এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কার্যকরভাবে এগিয়ে আসবে।
বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশ দীর্ঘমেয়াদে এত বড় শরণার্থী জনগোষ্ঠী বহন করতে পারে না। তাই রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে বিশ্ব সম্প্রদায়ের আরও সুদৃঢ়, ঐক্যবদ্ধ ও মানবিক উদ্যোগ এখন সময়ের দাবি।