✦ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও বাংলাদেশ
— বহুত্ববাদী ঐতিহ্যের এক অসাধারণ নিদর্শন
ভূমিকা:
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি একটি দেশের সামাজিক স্থিতিশীলতা, মানবিকতা ও ঐক্যের প্রধান ভিত্তি। এটি একটি সমাজকে সুদৃঢ় করে, মানুষের মধ্যে সৌহার্দ্য ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ তৈরি করে। বাংলাদেশ, এক সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় বৈচিত্র্যপূর্ণ দেশ হিসেবে, যুগ যুগ ধরে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক উজ্জ্বল উদাহরণ। তবে এই সম্প্রীতির পরিবেশ সব সময় বজায় রাখা সহজ নয়; নানা সময়ে চ্যালেঞ্জ এসেছে, কিন্তু আমাদের জাতি আবারও প্রমাণ করেছে—সহাবস্থান, সহনশীলতা ও ঐক্যই আমাদের প্রকৃত শক্তি।
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি: ধারণা ও তাৎপর্য
‘সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি’ বলতে বোঝায়—একটি সমাজে বিভিন্ন ধর্ম, মত, জাতি ও সম্প্রদায়ের মানুষ পারস্পরিক শ্রদ্ধা, সহনশীলতা ও সহাবস্থানের ভিত্তিতে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করা। এটি কেবল ধর্মীয় গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ নয়; বরং সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং মানবিক ক্ষেত্রেও এটির প্রসার রয়েছে।
বাংলাদেশে মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষ যুগ যুগ ধরে একত্রে বাস করছে। একে অপরের ধর্ম ও সংস্কৃতিকে সম্মান জানিয়ে গড়ে তুলেছে এক ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সমাজব্যবস্থা।
বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ঐতিহাসিক পটভূমি
- বাংলার ইতিহাসে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক সুদীর্ঘ ঐতিহ্য রয়েছে। প্রাচীনকাল থেকেই এ অঞ্চলে বৈচিত্র্যময় ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মানুষ শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থান করে আসছে।
- চৈতন্যদেব, লালন ফকির, ভক্তি আন্দোলন ও সুফিবাদ—এসবই ধর্মীয় সহনশীলতা ও সম্প্রীতির ভিত্তি গড়ে তুলেছিল।
- বাউল সংস্কৃতি, পীর-আউলিয়াদের মাজার, মঠ-মন্দির ও চর্চা কেন্দ্রগুলো—সবখানে দেখা যায় মিলনের প্রবণতা।
- বাংলার গ্রামীণ সমাজে উৎসব যেমন দুর্গাপূজা, ঈদ, বড়দিন, বুদ্ধ পূর্ণিমা—সব জাতি ও ধর্মের মানুষ অংশগ্রহণ করে।
- এটাই ছিল বাংলার আসল শক্তি—“ধর্ম যার যার, উৎসব সবার”।
স্বাধীনতা আন্দোলনে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ভূমিকা
- বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামেও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক অসাধারণ দৃষ্টান্ত গড়ে উঠেছিল। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে সব ধর্ম, জাতি ও সম্প্রদায়ের মানুষ এক হয়ে অংশগ্রহণ করে।
- হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান—সকল ধর্মাবলম্বী মুক্তিযোদ্ধা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করে;
- ধর্মভিত্তিক নয়, জাতিসত্তা ও ভাষার ভিত্তিতে ঐক্য গড়ে উঠে;
- ‘সকল মানুষের জন্য সমান অধিকার’—এই দর্শনের ভিত্তিতেই গঠিত হয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশ।
- এভাবে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির চেতনাই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম প্রেরণা ছিল।
বাংলাদেশের সংবিধানে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির গুরুত্ব
বাংলাদেশের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা এবং সকল ধর্মাবলম্বীর সমান অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে।
৪(ক) ধারায় বলা হয়েছে:
"ধর্ম, গোত্র, বর্ণ, লিঙ্গ বা জন্মস্থান নির্বিশেষে সকল নাগরিক আইনসম্মুখে সমান এবং সমান সুরক্ষার অধিকারী।"
এর মাধ্যমে রাষ্ট্র নিশ্চিত করেছে:
- ধর্মীয় স্বাধীনতা;
- সমান অধিকার;
- জাতিগত বা ধর্মীয় বৈষম্যের বিরুদ্ধে রক্ষা।
রাষ্ট্রের এই অবস্থানই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ভিত্তি।
বর্তমান বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক চিত্র
বর্তমান বাংলাদেশে বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মানুষ একত্রে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করছে।
- ইদ, পূজা, বড়দিন, বুদ্ধ পূর্ণিমা—সব ধর্মীয় উৎসবেই পারস্পরিক অংশগ্রহণ লক্ষ করা যায়।
- অনেক এলাকা বিশেষ করে গ্রামে মুসলমানরা পূজার নিরাপত্তায় দাঁড়িয়ে থাকেন, হিন্দুরা ঈদে মুসলমান প্রতিবেশীর বাড়িতে যান।
- শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কর্মক্ষেত্র, অফিস-আদালত—সবখানে মানুষ ধর্মীয় বিভেদ ভুলে একত্রে কাজ করে।
- বিভিন্ন ধর্মীয় সংগঠন, সামাজিক প্রতিষ্ঠান এবং প্রশাসনের সচেতনতা এই সহাবস্থানে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে।
সাম্প্রতিক চ্যালেঞ্জ ও সমস্যাসমূহ
তবে কিছু দুঃখজনক ঘটনা এ সম্প্রীতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। যেমন:
- ধর্মীয় অনুভূতিকে উসকে দিয়ে গুজব ছড়ানো;
- সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অপপ্রচার;
- সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর sporadic হামলা বা ভাঙচুর;
- রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মকে ব্যবহার করা।
এসব ঘটনা দেশের সাম্প্রদায়িক শান্তি বিনষ্টের পাঁয়তারা হলেও সাধারণ জনগণ সবসময়ই একত্রে দাঁড়িয়ে প্রতিহত করেছে।
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখার উপায়
১. শিক্ষা ও সচেতনতা বৃদ্ধি
- পাঠ্যপুস্তকে ধর্মীয় সহনশীলতা, মানবতা ও সম্প্রীতির বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করা;
- ছাত্রছাত্রীদের ভিন্ন ধর্ম ও সংস্কৃতি সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা দেওয়া।
২. গুজব ও অপপ্রচার রোধ
- সোশ্যাল মিডিয়ার অপব্যবহার রোধে দ্রুত প্রতিক্রিয়া ও কঠোর আইন প্রয়োগ;
- ভুয়া খবর যাচাই করে প্রচার রোধ করা।
৩. আইনের সঠিক প্রয়োগ
- সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তায় কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ;
- সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় জড়িতদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনা।
৪. ধর্মীয় নেতাদের ইতিবাচক ভূমিকা
- ইমাম, পুরোহিত, পাদ্রী ও ভিক্ষুদের একসঙ্গে সম্প্রীতির বার্তা প্রচার;
- মসজিদ, মন্দির, গির্জা ও বিহারে সম্প্রীতির কথা বলা।
৫. সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যমের দায়িত্ব
- গণমাধ্যম যেন ভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভাজন না তৈরি করে;
- বরং বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে পারস্পরিক ভালোবাসা ও সহাবস্থানের গল্প তুলে ধরে।
বাংলাদেশে সম্প্রীতির কিছু উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত
- শারদীয় দুর্গাপূজায় মুসলিম প্রতিবেশীরা নিরাপত্তা রক্ষা করেন, মণ্ডপে পূজার উপকরণ সরবরাহ করেন।
- ইদের দিন হিন্দু বন্ধুরা মুসলিমদের সঙ্গে দেখা করতে যান, মিষ্টিমুখ করেন।
- চট্টগ্রামের বৌদ্ধ সম্প্রদায় মুসলমানদের রোজার সময় ফলমূল পাঠান।
- রাজশাহীতে বড়দিন উপলক্ষে মুসলিম ছাত্ররা গির্জায় অংশ নেন শুভেচ্ছা জানাতে।
এসব ঘটনা প্রমাণ করে, সাধারণ মানুষ সব ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং সম্প্রীতির পক্ষে।
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির গুরুত্ব
একটি রাষ্ট্রে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির গুরুত্ব অপরিসীম:
- এটি জাতীয় ঐক্য ও সমাজের স্থিতিশীলতা বজায় রাখে;
- অর্থনৈতিক উন্নয়নে সহায়ক পরিবেশ তৈরি করে;
- বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়ায়;
- মানবিক সমাজ গঠনে সহায়তা করে;
- বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে বোঝাপড়া ও সহনশীলতা বাড়ায়।
‘স্মার্ট বাংলাদেশ ২০৪১’ ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি
বাংলাদেশ এখন স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনের লক্ষ্যে কাজ করছে। এই লক্ষ্য বাস্তবায়নে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, প্রযুক্তিনির্ভর, উদ্ভাবনী ও মানবিক রাষ্ট্র গঠনের জন্য সমাজে শান্তি, স্থিতি ও পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ অপরিহার্য।
উপসংহার:
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বাংলাদেশের অন্যতম মূল ভিত্তি। আমরা ধর্ম, বর্ণ, জাতি, সংস্কৃতির দিক থেকে বৈচিত্র্যময় হলেও একই মাতৃভাষা, একই সংস্কৃতি এবং একই ইতিহাস আমাদের ঐক্যবদ্ধ করেছে। আমাদের উচিত—সব ভেদাভেদ ভুলে একটি মানবিক, শান্তিপূর্ণ, সহনশীল ও উন্নত বাংলাদেশ গড়ে তোলা।
আমরা যদি সবাই সচেতন হই, অন্যের ধর্ম ও বিশ্বাসের প্রতি শ্রদ্ধা রাখি, তাহলে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির আলোয় বাংলাদেশ হবে শান্তি, সৌহার্দ্য ও সম্মিলনের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।