শৈশব স্মৃতি রচনা ।শৈশব স্মৃতি রচনা ২০ পয়েন্ট

শৈশব স্মৃতি

ভূমিকা:

মানুষের জীবনের সবচেয়ে সুন্দর, নির্মল এবং আনন্দঘন সময় হলো শৈশব। এটি জীবনের সেই পর্যায়, যেখানে নেই কোনো দায়িত্বের বোঝা, নেই কোনো জটিলতা কিংবা শঠতার স্পর্শ। শৈশব হলো এক উজ্জ্বল সকাল, যেখানে রঙিন স্বপ্ন, নিষ্পাপ হাসি, খেলার সাথী আর মা-বাবার নিরন্তর আদরে গড়ে ওঠে আমাদের জীবনের ভিত্তি। তাই শৈশবের স্মৃতি সব সময় মনের এক কোণে বাস করে, মাঝে মাঝে ফিরে এসে মনকে ভরে তোলে আনন্দে, আবেগে আর নস্টালজিয়ায়।

শৈশবের সংজ্ঞা ও তাৎপর্য:

‘শৈশব’ শব্দটি শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে গ্রামের সেই কাচার ঘর, উঠানে খেলা করা, খালি পায়ে হেঁটে স্কুলে যাওয়া কিংবা পুকুরে ডুবে ডুবে সাঁতার কাটা। এই সময়ে মানুষ গড়ে তোলে তার চারিত্রিক ভিত্তি, শিখে ভালো-মন্দ, ভালোবাসে প্রকৃতিকে, শেখে মায়া-মমতা। শৈশবের অভিজ্ঞতাগুলো আমাদের জীবনের এমন এক ভীত গঠন করে যা সারাজীবন আমাদের আচরণে প্রতিফলিত হয়।


আমার শৈশবের পরিপ্রেক্ষিত:

আমার শৈশব কেটেছে একটি গ্রামে—প্রকৃতির কোল ঘেঁষে, নদীর ধারে, মাঠের প্রান্তে। সে সময়টা ছিল ইন্টারনেট-বিহীন, মোবাইল-বিহীন, কিন্তু এক অপার আনন্দে পরিপূর্ণ। সকালে মুরগির ডাকেই ঘুম ভাঙত, তারপর দাদির মুখে গল্প শুনে দিন শুরু হতো। আমরা ভাইবোনেরা সকলে একসাথে বসে খেতাম, খেলতাম, ঝগড়া করতাম আবার মিলেও যেতাম খুব সহজে। এ যেন এক স্বপ্নের মতো সময়।

পরিবার ও আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে স্মৃতি:

আমার দাদু ছিলেন একজন কৃষক, আর দাদি ছিলেন অসাধারণ রাঁধুনি। প্রতিদিন দুপুরে তার হাতে তৈরি খেজুরের গুড়ের পায়েস খাওয়ার অপেক্ষায় থাকতাম। মা ছিলেন আমার সবচেয়ে বড় আশ্রয়, আর বাবা ছিলেন আমার হিরো। শৈশবে পরিবারই ছিল পৃথিবীর কেন্দ্রবিন্দু।

চাচা-চাচি, ফুফু, মামা-মামীদের সঙ্গে ঈদের সময় দেখা হতো। সবাই মিলে বাড়িতে ভিড় করত, রান্নাঘর থেকে ভেসে আসত সুস্বাদু খাবারের গন্ধ, উঠানে চলত খেলা, হাসি-ঠাট্টা। এসমস্ত স্মৃতি আজো মনে পড়লে চোখে জল আসে।

খেলা আর দুষ্টুমির দিনগুলি:

শৈশব মানেই খেলার দিন। লুকোচুরি, কানামাছি, কাবাডি, বউচি, গুলি, মার্বেল, বাঘ-বকরি—এইসব খেলার সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমার ছোটবেলা। স্কুল ছুটির পর বই ব্যাগ ছুড়ে রেখে মাঠে ছুটে যেতাম। মাটির গন্ধ, ঘেমে যাওয়া শরীর, পুকুরে ঝাঁপিয়ে পড়া—এগুলোই ছিল প্রতিদিনের রুটিন।

আমরা গাছ থেকে কাঁচা আম পেড়ে খেতাম, ক্ষেত থেকে শিম চুরি করতাম, কখনো গরুর গাড়িতে উঠে চষা জমি দেখে অবাক হয়ে যেতাম। অনেক সময় দুষ্টুমি করে বকা খেতাম, আবার কান্না করে আদর পেতাম। এখন বুঝি, সেই বকা আর কান্নার মধ্যেই ছিল ভালোবাসার বিশুদ্ধতা।

প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দিনগুলি:

আমার স্কুলজীবন শুরু হয়েছিল গ্রামের এক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। স্কুলটা ছিল বাঁশ ও টিনের তৈরি, কিন্তু তাতে কোনো আক্ষেপ ছিল না। সকালবেলা খালি পায়ে হেঁটে স্কুলে যেতাম বন্ধুদের সঙ্গে। একজন বই ধরত, আরেকজন জলভরা কলস। আমাদের শিক্ষক-শিক্ষিকারা ছিলেন অতি মমতাময়ী। তারা আমাদের পড়াতেন শুধু নয়, ভালোবাসতেনও নিঃস্বার্থভাবে।

বিদ্যালয়ে বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা, কবিতা আবৃত্তি, সাধারণ জ্ঞান প্রতিযোগিতা—এইসব কিছু আজও স্মৃতির অ্যালবামে সজীব। শ্রেণিকক্ষে চক দিয়ে লিখে পড়া, দুষ্টুমি করে স্যারের কাছে দাঁড়িয়ে থাকা, কিংবা বন্ধুদের সঙ্গে টিফিন ভাগাভাগি করা—সব কিছুই ছিল অকৃত্রিম।

ঋতুর সঙ্গে শৈশবের সম্পর্ক:

বসন্ত মানেই ছিল শিমুল-পলাশের দিন, গ্রীষ্মে ছিল কাঁঠাল-আম খাওয়ার উৎসব, বর্ষায় নৌকা ভ্রমণ আর কাদা-পানিতে খেলা, শরতে কাশফুল আর পূজোর আনন্দ, হেমন্তে নতুন ধানের সুবাস আর শীতে পিঠা-পুলির মেলা—এই ঋতুগত পরিবর্তনের সঙ্গে আমার শৈশব ছিল গভীরভাবে জড়িত।

বিশেষ করে বর্ষাকালে আমাদের বাড়ির পেছনের পুকুরের পানি বেড়ে উঠত উঠান পর্যন্ত। তখন আমরা কলার ভেলায় চড়ে খেলতাম, চাচা মাছ ধরতেন, আর আমরা কচুরিপানার ফুল দিয়ে মালা বানাতাম। শীতকালে মা পাটিসাপটা, দুধ চিতই আর নারকেলের লাড্ডু বানাতেন—তা খেতে খেতেই চলে যেত গোটা দিন।

তৎকালীন উৎসব ও সংস্কৃতি:

পহেলা বৈশাখ, ঈদ, দুর্গাপূজা, নবান্ন উৎসব—সবই ছিল শৈশবের অভিজ্ঞতার অংশ। বৈশাখে নতুন জামা, হালখাতা, মেলা, নাগরদোলা—সব ছিল মন কেড়ে নেওয়ার মতো। ঈদে সকালে গোসল করে সাদা পাঞ্জাবি পরে নামাজে যাওয়া, পরে আতর মেখে বড়দের সালাম করা আর সেমাই খাওয়ার আনন্দ ছিল অবর্ণনীয়।

এছাড়াও পুঁথিপাঠ, যাত্রাপালা, হাটবারের ভিড়—এসবের সঙ্গে গড়ে উঠেছিল আমাদের লোকসংস্কৃতির প্রতি মমতা। তখন আমরা না বুঝেই এইসব অনুষ্ঠান উপভোগ করতাম, এখন বুঝি সেগুলো আমাদের শিকড়।

বন্ধুদের সঙ্গে সম্পর্ক ও বিচ্ছেদ:

শৈশবের সবচেয়ে মূল্যবান অংশ হলো বন্ধু। আমার শৈশবেও ছিল এমন কিছু বন্ধু—শুভ, কাব্য, লিমা, রাহাত—যাদের সঙ্গে কেটেছে দিনরাত। আমরা একসাথে স্কুলে গেছি, নদীতে সাঁতার কেটেছি, মাঠে বল খেলেছি, গাছের ডালে ঝুলেছি।

কিন্তু সময়ের সঙ্গে তারা ছড়িয়ে পড়েছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে, কেউ বিদেশে, কেউ শহরে। কারো সঙ্গে মাঝে মাঝে কথা হয়, কারো সঙ্গে আর হয় না। তবুও তাদের স্মৃতি মন থেকে কখনো মুছে যায় না।

বর্তমানের আলোকে শৈশব স্মৃতি:

আজ যখন প্রযুক্তির ছোঁয়ায় শিশুরা মোবাইল, গেমস আর টিভিতে বন্দী, তখন নিজের শৈশবকে মনে পড়ে আরও বেশি করে। এখনকার শিশুরা যে নিখাদ আনন্দ, প্রকৃতির সংস্পর্শ কিংবা সম্পর্কের উষ্ণতা পায় না, তা আমরা পেয়েছি পূর্ণমাত্রায়। আমাদের শৈশবের সেই দিনগুলো ছিল ধুলা-মাটির গন্ধে ভরপুর, নিঃস্বার্থ সম্পর্কের ছোঁয়ায় পূর্ণ।

শৈশবের শিক্ষণীয় দিক:

শৈশব আমাদের শেখায় কিভাবে আনন্দ খুঁজে নিতে হয় ছোট ছোট বিষয়েও, কিভাবে সম্পর্ককে মূল্য দিতে হয়, প্রকৃতিকে ভালোবাসতে হয়। শৈশব আমাদের শিকড়, আর শিকড় মজবুত হলে তবেই মানুষ বড় হয়ে ওঠে সুস্থ এবং সুনাগরিক হিসেবে। তাই শৈশবের শিক্ষা, অভিজ্ঞতা ও স্মৃতি সারাজীবন আমাদের চলার পাথেয় হয়ে থাকে।

উপসংহার:

শৈশব এক এমন সময়, যা আর কখনো ফিরে আসে না, কিন্তু চিরকাল মনে থেকে যায়। জীবনের যতই ব্যস্ততা আসুক, একটিবার চোখ বন্ধ করলেই শৈশব ফিরে আসে—খোলা মাঠ, কুয়াশা ভেজা সকাল, মায়ের কোলে ঘুমানো, বন্ধুদের সঙ্গে হাসি, দাদির গল্প—সব মিলিয়ে এক অনন্ত আনন্দভান্ডার।

আমার শৈশব আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ, যা আমাকে আজও উজ্জীবিত করে, সাহস জোগায় এবং ভালোবাসতে শেখায়। সত্যিই, শৈশব—তুমি ছিলে আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়।

Post a Comment